মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারক ছিলেন আবদুল ওদুদ
সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম
মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারক আবদুল ওদুদ
সাইফুল আহমেদ : আজ ১৯ মে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭০ সালের এই দিনে কলকাতায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে কাজী আবদুল ওদুদের জন্ম হয়েছিল। পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন পেশায় ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। মায়ের নাম খোদেজা খাতুন।
কাজী আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আইএ এবং ১৯১৭ সালে বি এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে মামাতো বোন জমিলা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষকের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রিডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করে কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তার একটি গল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’ (১৯১৮) এবং উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়।
এমএ পাস করার পর তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরো বেগবান হয়ে ওঠে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তার চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র শিখার প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তার সক্রিয় প্রয়াসপ্রযত্ন ছিল। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় কাজী আবদুল ওদুদের প্রধান পরিচয় চিন্তাশীল লেখক হিসেবে। তবে তার লেখালেখি শুরু হয় কথাসাহিত্যের মাধ্যমে। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ মীর পরিবার পাঁচটি গল্পের সংকলন। এরপর তিনি তিনটি গল্প রচনা করেন, যা পরবর্তী সময়ে ‘তরুণ’ (১৯৪৮) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘নদীবক্ষে’ ও ‘আজাদ’ (১৯৪৮) তার দুটি উপন্যাস। নাটকও রচনা করেন দুটি, ‘পথ ও বিপথ’ (১৯৩৯) এবং ‘মানব-বন্ধু’ (১৯৪১)। ‘মানব-বন্ধু’ পরবর্তীকালে ‘তরুণ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কাজী আবদুল ওদুদের কয়েকটি গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। তার মননশীলতা এবং বৈদগ্ধের প্রকাশ লক্ষ করা যায় ‘শাশ্বত বঙ্গ’ (১৯৫১), ‘বাংলার জাগরণ’ (১৩৬৩), ‘কবিগুরু গ্যেটে’ (১ম ও ২য় খন্ড ১৩৫৩), ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ’ (১ম খণ্ড ১৩৬৯, ২য় খণ্ড ১৩৭৬), ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ (১৩৭৩) গ্রন্থে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, যারা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ নামে পরিচিত ছিলেন, কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বিচার-বুদ্ধিকে সংস্কার মুক্ত ও গতিশীল করার প্রচেষ্টায় যে সকল চিন্তা ও বক্তব্য নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ ও তার সহকর্মীদের অগ্রসর হতে দেখা যায়, ‘শাশ্বত বঙ্গ’ তার একটি মূল্যবান দলিল। তার উদারনৈতিক মনোভাব এবং নিজের সমাজ ও সম্প্রদায়ের দৈন্যের জন্য আক্ষেপ এ গ্রন্থের আর একটি দিক। পরিবেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর ভালোবাসার, প্রেম তার বক্তব্যের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ তাই সাজাত্যবোধে উজ্জ্বল। তার ‘শাশ্বত বঙ্গ’ অনৈতিহাসিক সোনার বাংলা এবং আদর্শায়িত রূপকথার কাহিনী নয়। প্রকৃতপক্ষে এ বঙ্গে মানুষের জীবন দীনহীন ও নানা সংস্কারে পীড়িত। অনগ্রসরতার গ্লানি তার নিত্য সঙ্গী। কিন্তু সে দীনতাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করেন না তিনি। তার বঙ্গ সৃষ্টিশীল ও সম্ভাবনাময়।
এ বঙ্গদেশে, কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, উনিশ শতকে একটি রেনেসাঁস সংঘটিত হয়, যার একটি বড় বক্তব্য ছিল, স্বদেশপ্রেমে দোষ নেই যতক্ষণ স্বাদেশিকতা না হয় বিশ্ববিমুখ। তার বাংলার জাগরণ বিষয়ক আলোচনার এক প্রধান প্রেরণা ছিল এটা। এ প্রেরণায় তিনি লিখেছেন বাংলার জাগরণ গ্রন্থ। তার মতে রামমোহন থেকে ঢাকার ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন পর্যন্ত যে প্রয়াস, সেটা এ প্রেরণার ফল। অন্যদিকে তার ‘কবিগুরু গ্যেটে’ গ্রন্থের বক্তব্যও এ প্রেরণাজাত। গ্যেটের স্বচ্ছ ও সবল মুক্তবুদ্ধি এদেশের মানুষকেও সাহায্য করবে জীবনের দায়িত্ব, প্রতিভা, ধর্ম, স্বদেশপ্রেম, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে তুলতে। তিনি অনুপ্রাণিত হন গ্যেটের সত্যাশ্রয়ী ব্যাপক জীবনবোধ ও বিশ্ববোধের মন্ত্রে ও দৃষ্টান্তে।
কাজী আবদুল ওদুদ স্বদেশচেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত লক্ষ করেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কর্মক্ষেত্রের নিবিষ্ট পাঠক ও আলোচক ছিলেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার গভীর সাহিত্যবোধ ও ব্যাপক মননশীলতার পরিচয়বাহী গ্রন্থ।
‘হজরত মোহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম’ তার পরিণত বয়সের রচনা। তিনি এ গ্রন্থে হজরত মোহাম্মদকে (সা.) রক্ত-মাংসের মানুষ এবং ঐতিহাসিক এক সঙ্কটকালের মহৎ পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি যার ছিল অপরিসীম দরদ ও দায়িত্ব। হজরত মোহাম্মদ (সা.) মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্যদৃষ্টি ও জ্ঞানানুরাগের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ এ বক্তব্যটি তার উক্ত গ্রন্থে বিশেষভাবে তুলে ধরেন।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় কাজী আবদুল ওদুদের ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’। আধুনিক বাংলা ভাষার একটি জনপ্রিয় অভিধান সংকলনে তার ভাষা সচেতন মনের পরিচয় মেলে এখানে। অভিধানটির বিশেষত্ব হলো, এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরবি, ফার্সি ও তুর্কি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের প্রয়াস আছে এবং বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে।
কাজী আবদুল ওদুদের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, প্রবন্ধ ও সাহিত্যসমালোচনা: নবপর্যায় (১ম খণ্ড ১৩৩৩, ২য় খণ্ড ১৩৩৬), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪২), ফান্ডামেন্টাল অব ইসলাম (১৩৫৭), স্টেট অ্যান্ড লিটারেচার (১৩৬৪), ট্যাগোরস রোল ইন দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব ইন্ডিয়ান থট (১৩৬৮), আজকার কথা (১৩৪৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৩৫৮), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), নজরুল-প্রতিভা (১৩৫৬), শরৎচন্দ্র ও তারপর (১৩৬৮); জীবনীগ্রন্থ: অনুবাদ গ্রন্থ: ক্রিয়েটিভ বেঙ্গল (১৩৫৭), পবিত্র কোরআন (১ম ভাগ ১৩৭৩, ২য় ভাগ ১৩৭৪)। এ ছাড়া রয়েছে কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী (১ম খণ্ড ১৯৮৮, ২য় খণ্ড ১৯৯০, ৩য় খণ্ড ১৯৯২, ৪র্থ খণ্ড ১৯৯৩, ৫ম খণ্ড ১৯৯৪ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড ১৯৯৫) এবং কাজী আবদুল ওদুদের পত্রাবলী (১৯৯৯)।
কাজী আবদুল ওদুদের গদ্যের প্রধান ভিত্তি যুক্তি, পরিমিতিবোধ এবং আত্মপ্রত্যয়। বাংলা গদ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই ত্রিবিধ গুণসম্পন্ন বাংলা রচনার উদাহরণ খুব বেশি নেই। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট গদ্যশিল্পীরূপে চিহ্নিত করা যায়। পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৫/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম