ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রিয় দিয়েগো এবং হ্যান্ড অব গড

উৎপল দত্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২৮ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:১৯, ২৮ নভেম্বর ২০২০
প্রিয় দিয়েগো এবং হ্যান্ড অব গড

বলটি তিনি হাতের স্পর্শেই জালে ঢুকিয়েছেন, মাথার স্পর্শে নয়। গোল বা স্কোরটি তাই বৈধ নয়। একথা পরবর্তীকালে টেলিভিশন শো-তে ম্যারাডোনা নিজেই বলেছেন। ইংরেজদের ক্রোধের মুখেও, কী জানি কেন, গোলটি বৈধতা পেয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার ওই একই ম্যাচে দিয়েগো অবিস্মরণীয় এবং একইসঙ্গে বিতর্কিত গোলটি করেন। ফুটবলের ইতিহাসে আরেকটি তুলনাহীন গোল একই ম্যাচে হয়। মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে ইতিহাস সৃষ্টি হওয়া ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ এবং ‘হ্যান্ড অব গড’ হয়ে যায় মিথ। ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন হয়ে প্রতিটি মিনিট খেলেছেন ম্যারাডোনা- এই মূল্যায়ন ফিফা’র। ২০০২ সালে ফিফা পরিচালিত অনলাইন জরিপের ফলাফলে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপের সেই গোলটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

‘Taken to soon’ পিটার শিলটনের মন্তব্য। তাড়াতাড়ি তিনি চলে গেলেন- আক্ষরিক অনুবাদে এরকম শোনায়। অন্যরকম করেও মন্তব্যটি চিন্তায় ধরা দেয়। তাড়াতাড়ি তাকে তুলে নেওয়া হলো। এভাবে আক্ষেপ করেছেন পিটার শিলটন। এই আক্ষেপ কাতোরক্তির মতো শোনায়। ১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বিতর্কিত গোলটি এই পিটার শিলটনের বিপক্ষেই হয়েছিল। ম্যারাডোনা নিজে ঘটনাটিকে ‘হ্যান্ড অব গড’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তো এবার সেই ‘হ্যান্ড অব গড’ই তাঁকে তুলে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর মাঠ থেকে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সব ফুটবলপ্রেমী মানুষ, দল ও দেশ নির্বিচারে, ফুটবলের কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার জন্য কষ্ট পাচ্ছে, তারা ব্যথিত ও শোকাহত। বিশ্বকাপের মাঠে তো বটেই, গ্যালারিতেও তাঁকে আর দেখা যাবে না। বিশ্বকাপ চলাকালীন আমাদের দেশের দর্শক দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের সমর্থক লাতিন আমেরিকার খেলার ছন্দ ও সৌন্দর্য্যের কারণে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনা আমাদের কাছে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে মূলত ম্যারাডোনার কারণে। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পরও এই সংস্কৃতি থেকে যায়। বিশ্বকাপ এলেই শহরের ছাদে, গ্রামে, মাঠে, গাছের ডালে দুটি পতাকা উড়তে দেখা যায়। একটি ব্রাজিলের অন্যটি আর্জেন্টিনার। অথচ এই ফুটবলপ্রেমী জাতির কোপা আমেরিকা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ইউরোপিয়ান লিগ নিয়েও সবাই একই রকম উৎসাহী নন। কিন্ত চার বছর পর যখন ফিফা বিশ্বকাপের আসর বসায় তখন তার ঢেউ এসে পড়ে এদেশে। সেই ঢেউ অন্যরকম! হলুদ ও আসমানি-সাদা রঙের প্রবল উচ্ছ্বাস। বিশ্বকাপ চলাকালীন আমাদের দেশের মানুষের মুখ থেকে কিছু কালের জন্য হলেও দুঃখ-ব্যথার ছায়া উধাও হয়ে যায়। বিচিত্র আচরণ ও মাতামাতি লক্ষ্য করা যায় মানুষের মধ্যে। এই ফুটবল ক্রেজের মধ্যে অবধারিতভাবে লুকিয়ে থাকে একটি নাম ও অস্তিত্ব- দিয়েগো ম্যারাডোনা।

ছিয়াশির বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার বিতর্কিত সেই গোল

দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুকে ‘অকাল মৃত্যু’ই বলা যায়। হঠাৎ তাঁর এভাবে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। মাঠ যদি ক্যানভাস হয়, ম্যারাডোনার পা দু’টি চিত্রকরের নিপুণ ক্ষিপ্র ব্রাশের মতো। যুগল পা দিয়ে ফুটবলকে তিনি নান্দনিক করে তুলেছিলেন। ফুটবলারের নয়, যেন একজন শিল্পীর জাদুকরী দৌড় এবং ড্রিবলিং দেখার অপেক্ষায় আমরা টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসতাম। ছিয়াশির বিশ্বকাপে মধ্যমাঠ থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষের প্রায় হাফ ডজন খেলোয়ারকে জাদুর কবুতর দেখিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। অসহায় গোল কিপার তখন সেই পিটার শিলটন। তার বিভ্রান্তিকর মুখ, দৃশ্যত অস্থির ও অস্বস্তিকর আচরণকে সমীহ না করে সুস্থির ম্যারাডোনা যে গোলটি করেছিলেন আজও তা ফুটবলের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ। মেক্সিকোর গ্যালারি আর বিশ্বের শত-কোটি দর্শক সেদিন স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিল এক জোড়া পায়ের কীর্তি ও ক্রীড়া-কৌশল। মাঠের ঘাস আনন্দে হেসেছিল! কয়েক মুহূর্তের জন্য জয়-পরাজয়ের আনন্দকে তুচ্ছ করে সমর্থক ও বিরোধীরা শ্রদ্ধায় ও আনন্দে খেলার নৈপুণ্য দেখেছিলেন। ম্যারাডোনা অনন্য এখানেই। যারা অনন্য প্রতিভাধর তারা নিজেরাই আনন্দের বিস্ময়কর মুহূর্ত নির্মাণ করেন এবং নিজের নির্মিত মুহূর্তের মধ্যে বেঁচে থাকেন। ম্যারাডোনা তাই বেঁচে থাকবেন।

ম্যারাডোনাকে নিয়ে অনেক বিতর্কিত বিতর্ক ছিল, ভালোবাসা ছিল তার চেয়ে বেশি। বিতর্কের জাল বারবার ছিঁড়ে গেছে ভালোবাসার জোয়ারে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রখর। অনেক কথার মধ্যে উইটি, হিউমার শুধু নয়, দর্শনও খুঁজে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকার গ্রীষ্মকালীন বিকেলগুলো অনেক ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনার সাক্ষ্য দেয়। লাতিন আমেরিকার একটি দেশের দরিদ্রপল্লীতে একটি বালককে প্রতিদিন বল নিয়ে ছুটতে দেখেছে পড়ন্ত বিকেল। সমবয়সীরা যখন অন্য কথা-কাজে সময় কাটায়, তখন একটি বালকের মাথায়, পায়ে, উড়ুতে ও বুকে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি ফুটবল। ওই বিস্ময়বালক ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা যেমন ফুটবল ভালোবাসতেন, ম্যারাডোনাকেও প্রতিটি ফুটবল চিনে নিতো তার পায়ের ছন্দে। অথবা এভাবেও বলা যায়, ম্যারাডোনা জানতেন ওই জড়বস্তু যা ফুটবল নামে পরিচিত তার মধ্যে কী করে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করতে হয়। 

মাঝমাঠ থেকে ছয়জনকে কাটিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ম্যারাডোনা। এই গোলটিকে বলা হয় ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’

ম্যারাডোনা যেমন নন্দিত, তেমন নিন্দিত হয়েছেন। তার মাদকাসক্তি, বিতর্কিত উক্তি, খ্যাপাটে আচরণ সংবাদে এসেছে। কিন্তু আজ ফুটবল তারকা, সংগঠক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ম্যারাডোনা একটি অনন্য কাজ করেছেন। একজন আর্জেন্টাইন তার সকল বিদ্রোহীদের আমন্ত্রণ জানাতে পেরেছিলেন তাঁর ইতিবাচক ও নেতিবাচক চিন্তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। ‘An Argentine who transmitted all his rebellion to fight with his positive and negative things.’ ঠিক এই কাজটিই তিনি করেছিলেন মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে বিরোধী পক্ষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তাদের পরাজিত করে স্কোরটি নিশ্চিত করতে। শুধু ফুটবল নয়, ম্যারাডোনার চরিত্রের এই অনন্য দিকগুলোও আমাদের ভাবতে হবে। ব্যক্তি মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী আচরণে প্রকাশ পায়, সবাই জানে। চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিভার মধ্যে প্রকাশিত বা প্রতিফলিত হতে পারে তার উদাহরণ দিয়েগো ম্যারাডোনা। তেতো, বিরক্তিকর, বিতর্কিত যাই হোক না কেন, নিজের সম্পর্কে খোলাখুলি কথা না বললে তা জানা যেত না। এই সাহসটুকু অনেকের থাকে না। ম্যারাডোনার ছিল। ‘হ্যান্ড অব গড’ কথাটি তাই সঙ্গত কারণেই সীমিত অর্থের সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়।

লেখক: কবি ও গদ্যকার

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়