‘এই দেশেই জন্মেছি আমি, এই দেশেই মরতে চাই’
খালেদা জিয়া || রাইজিংবিডি.কম
মা, জননী, জন্মভূমি আমার বাংলাদেশ। এ দেশই আমার ঠিকানা। এর বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশেই জন্মেছি আমি। এই দেশেই মরতে চাই। বাংলাদেশকে নিয়ে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এবং আমাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
ইতোপূর্বে আমাকে দেশ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এখন আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি বাইরে চলে গেলে আজ আমাকে এভাবে গ্রেপ্তার হতে হতো না। আমি বলতে চাই, এই দেশের মাটি ছাড়া আমি এবং আমার পরিবারের কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, কোথাও না।
আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে এ মামলা করা হয়েছে। এই মামলা ষড়যন্ত্রের মামলা। বিএনপি পাঁচবার এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশের উন্নয়ন আর কল্যাণে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, আমার ও বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ দেশের জন্য আমরা নিবেদিতভাবে কাজ করেছি। আমার, আমাদের পরিবারের বা আমার ছেলেদের অর্থের কোনো লোভ নেই, অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। এ দেশের জনগণের ভালোবাসা এবং সমর্থন আমরা সবসময় পেয়েছি এবং পাচ্ছি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমরা সবসময় দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছি।
আমার প্রিয় দেশবাসীকে বিনীতভাবে জানাতে চাই, আমি ও আমার পরিবার সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ। মহামান্য আদালতকে সবিনয়ে জানাতে চাই, আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাই এই মিথ্যা মামলা থেকে সুবিচার চাই। শুধু আমিই নই, যে কোনো নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।
মাননীয় আদালত, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে এ দেশের প্রতিটি মানুষই চেনে। তিনি স্বাধীনতার ঘোষকই শুধু ছিলেন না, সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষকের স্ত্রী হিসেবে আমি বলতে চাই, এ দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান অপরিসীম। এ দেশের যত উন্নয়ন ও কল্যাণ হয়েছে, তা শহীদ জিয়া ও জাতীয়তাবাদী দলের মাধ্যমে হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনি অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন। এ দেশের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন। তাঁর সময় বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি পর্যন্ত হয়েছে। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গোটা মুসলিম উম্মাহসহ বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি বেঁচে থাকলে এ দেশের আরো উন্নতি হতো। তিনি দেশকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত করেছিলেন। সেই চেতনার আলোকে দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দেশের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হতে হয়। তাঁর শাহাদাতের পর কুচক্রীরা ভেবেছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি আর থাকবে না। এই দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা যাবে; কিন্তু জনগণ পরবর্তী সময়ে এই ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল করে দেয়।
আমি রাজনীতিতে আসতে চাইনি। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর এ দেশের মা, বোন ও ছাত্র-জনতা এ দেশের স্বার্থে, বিএনপির স্বার্থে আমাকে রাজনীতিতে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। দেশের কথা ভেবে, দলের কথা ভেবে এবং লাখ-কোটি মানুষের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমি রাজনীতিতে আসি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হই। গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলি। তখনো আমাকে কয়েকবার হাউস অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন থেকে আমি পিছপা হইনি। সেদিন জনগণের সমর্থন নিয়ে আমরা আন্দোলন সফল করেছিলাম এবং স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলাম।
স্বৈরশাসনের অবসানের পর সবাই মিলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারপ্রধান হিসেবে মনোনীত করি। তাঁর অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আমার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বিজয় লাভ করে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করতে আমরা সক্ষম হই। একইভাবে পরবর্তী সময়ে সরকারে এসেও উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাই। এ দেশের যত উন্নয়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগই জিয়াউর রহমান, আমি এবং বিএনপির অবদান।
আমি বাংলাদেশের যত জায়গায় গিয়েছি, আর কেউ সম্ভবত এত জায়গায় যাননি। আমি আজ একটি কথা বলতে চাই- এ দেশের কাজ করতে গিয়ে আমার দুটি পা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে গেছে। এ দেশে বন্যা হলে, টর্নেডো ও ঘূর্ণিঝড় হলে আমি ছুটে গেছি দুর্গত এলাকায়। মানুষের সহযোগিতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এবারের বন্যায় আমি দুর্গত মানুষের পাশে যেতে পারিনি। আমি যদি বন্দি না-ই থাকতাম, তাহলে তাদের কাছে কেন যেতে পারলাম না?
আমার ও আমাদের পরিবারের অর্থের কোনো লোভ নেই, অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কাউকেই প্রভাবিত করিনি, আমাকেও কেউ প্রভাবিত করেনি। আমরা সবসময় দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে এসেছি এবং যত দিন বেঁচে থাকব, এ দেশের কল্যাণেই নিজেকে নিবেদিত রাখব। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং বিএনপি ভাঙার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
আমার ও পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
[ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকার ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। এরপর সকালে ঢাকা সিএমএম কোর্টে হাজির করা হলে আইনজীবীদের বক্তব্যের পর কোর্টের অনুমতি নিয়ে তিনি কথা বলেন। কোর্টে দাঁড়িয়ে ১২ মিনিট মর্মস্পর্শী ভাষায় বেগম খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো]
ঢাকা/তারা//