ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কৃষিকাজে কিশোরীর সাফল্য

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ০৮:৪৯, ৮ মার্চ ২০২১
কৃষিকাজে কিশোরীর সাফল্য

বয়স তার সবেমাত্র ১৭ ছুঁই ছুঁই। পড়ছেন এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে। এ বয়সেই কৃষিকাজ করে লাভবান হয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন এক কিশোরী। নাম তার ফারিয়া নুরুদ্দিন। বাড়ি নেত্রকোণা সদর উপজেলায়। বাবা-মা দুজনেই পেশায় আইনজীবী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেজ সে।

ব্রকলি, স্কোয়াশসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন ফারিয়া। ২০১৯ সালে মাত্র ২০ শতক জমি নিয়ে চাষাবাদ শুরু করলেও এ বছর সেই সংখ্যা প্রায় ২১০ শতক ছাড়িয়েছে। বর্তমানে শীতকালীন চাষবাদ শেষে আগাম গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে ফারিয়ার।

নিজের পরিচয়ে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন থেকেই গল্পের শুরুটা। যখন সে নবম শ্রেণিতে পড়ে সেসময় থেকেই কিছু একটা কাজ করার চিন্তা তার মাথায়। তখন থেকেই অনেক কিছু নিয়ে রিসার্চ শুরু করে। তখন অনেক ধারণাও পায় সে। কখনো ভাবলো হাতের তৈরি বিভিন্ন জিনিস তৈরি করবে, কখনোবা অনলাইন বিজনেস, কখনো কখনো ফ্রিল্যান্সিং করার ভাবনা তার মাথায় আসলো। কিন্তু কোনোটাতেই মন টিকেনি তার। আগে থেকে তার উৎপাদন বিষয়টা ভালো লাগতো। সেই সূত্রে স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে পরবর্তীতে কৃষিতে নেমে পড়ে।

ফারিয়া বলছিলেন, ‘২০১৯ সালের আগস্টের দিকে আমার এলাকার একজন বড় ভাইয়ের সঙ্গে সবজি চাষ নিয়ে একদিন কথা হয়। তিনি সে বছর ব্রকলি চাষ করবেন বলে জানায়। তো তার কাছে প্রাথমিকভাবে জেনে ইন্টারনেট রিসার্চ করে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ব্রকলি চাষ করবো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেবার ২০ শতক জমিতে ব্রকলি চাষ করেছিলাম। তখন থেকেই শুরু আমার কৃষি যাত্রার। এরপর আরও বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি।’

এই কিশোরী বলেন, ‘এ বছর (২০২০-২০২১) ২০০ শতক জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি। ব্রকলি, স্কোয়াশ, রেড ক্যাবেজ এবং অল্প অল্প করে লেটুস, বিটরুটও করেছি। শীতকালীন সবজি শেষ। এখন ২১০ শতক জমিতে গ্রীষ্মকালীন আগাম বিভিন্ন সবজি চাষ করার প্রস্তুতি চলছে।’  

পরিবারের কেউ কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না জানিয়ে নেত্রকোণা সরকারি মহিলা কলেজে পড়ুয়া এই কিশোরী আরও বলেন, ‘আমি ছোট থেকে কৃষিকাজ দেখে বড় হইনি। কারণ শহরেই আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা। সেইক্ষেত্রে গুগল রিসার্চ করে এবং বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়ে চাষাবাদ করে আমি যে সবজি ফলন ফলাতে পারছি, আমার কাছে এটাই আমার সফলতা। আর আমার ফলন-ই আমার উপার্জন।’

কৃষিকাজে আসার অনুপ্রেরণার কথা বলতে গিয়ে ফারিয়া বলেন, ‘আমার অনুপ্রেরণা আমি আসলে নিজেই। নিজের ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব সম্ভব। পরিবার থেকে কোনো নিষেধ ছিল না। বরং পরিবার সব বিষয়ে সাহায্য করেছে। আমার সফলতায় তারা খুশি হয়, আমার ব্যর্থতায় তারা ব্যথিত হয়। আমার পরিবার আমার স্বপ্নের মাঝে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।’

এই কিশোরী আরও বলছিল, ‘এই কাজ করতে গিয়ে সমালোচনা যদি আমার পেছনে হয়ে থাকে সেটা তো আর আমি জানি না। তবে আমার চেনা-জানা অনেকে বলেছে তোমার পরিবার তো বেশ স্বচ্ছল। তোমার তো টাকা পয়সার দরকার নেই। পড়াশোনা করে বড় হয়ে অ্যাডভোকেট হবা। কৃষিকাজে আসলা কেন।’

ফারিয়ার কৃষিকাজে অনেকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। সে সম্পর্কে এই কিশোরী বলেন, ‘এ ব্যাপারটা বেশ আনন্দের। প্রথম যখন আমি ২০ শতক জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ শুরু করি, তখন আমি একাই কাজটা করি। কিন্তু এখন আমার চাষবাস ২০০ শতক জমি নিয়ে। তাই জমি সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার জন্য লোক নিয়েছি। এছাড়া সবজি উৎপাদন ও সবজি চাষবাস করার সময় আরো লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন হয়তো ছয়-সাত জন জমিতে নিয়মিত কাজ করে। এতে কর্মসংস্থান পেয়ে তাদের উপকার হচ্ছে।’

চাষাবাদ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে পড়াশোনা করেছে জানিয়ে ফারিয়া বলেন, ‘এখন যুগ অনেক পাল্টেছে। আমরা চাইলেই যেকোনো মুহূর্তে ইন্টারনেট থেকে সব তথ্য জানতে পারি। আমিও ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেই কৃষিকাজে নামি। তারপরও একটা বাস্তবজ্ঞান লাগে; সেটা জেনেছি চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার কৃষি অফিসার রাসেল ভাই থেকে। তিনি আমাকে বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে সাহায্য করেছেন।’

ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে ফারিয়া বলেন, ‘অসংখ্য কৃষক কৃষিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। পাশাপাশি আরও অনেক কারণ রয়েছে। আগাম চাষে ভালো মূল্য পেলেও সেই সময়টা খুবই অল্প। আর এই যে কৃষকরা কৃষি থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছেন এটা আমাদের দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তো সেই জায়গা থেকে কৃষকরা যেন কৃষিবিমুখ না হয়ে উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারে এবং উন্নত এবং জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করতে পারে সেগুলো নিয়ে  ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছে আছে।’

এই কিশোরী আরও বলেন, ‘আরেকটা ইচ্ছে আছে আমার। আমরা অনেকেই যেমন ছোট থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই বা একটা ভালো চাকরি করবো এরকম ভাবনা থাকে; তেমন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ছোট থেকেই এমন ভাবতে পারে যে, বড় হয়ে আমি একজন কৃষক হতে চাই। কৃষিটাকে যেন সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই।’

ঢাকা/ফিরোজ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়