ঢাকা     শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২০ ১৪৩১

ঝুঁকি নিয়ে জীবনযুদ্ধে শিশুরা

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১ মে ২০২৩  
ঝুঁকি নিয়ে জীবনযুদ্ধে শিশুরা

লেগুনার পিছনে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা-নামানোসহ টাকা তুলছেন মনিুরুজ জামাল (১৩)।  রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-চট্টগ্রাম রুটে কাজ কাজ করছেন।

শুধু রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-চিটাগাংরোড রুট নয় মিরপুর-১ রুটে নয়, মিরপুর, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, গুলশান, সিপাইবাগ-গোড়ান, গুলিস্তান, কদমতলীসহ বিভিন্ন রুটে অনেক শিশু শ্রমিককে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেখা মেলে।

পড়ুন: মহান মে দিবস আজ

জানা গেছে, অভাব-অনাটনের কারণে দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখনও শিশুরা কাজ করছে। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। শিশুদের অধিকার নিয়ে  কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা।

তারা বলছে, দারিদ্র্য, পরিবারের অসচেতনতা ও আইন প্রয়োগের ঘাটতির কারণে শৈশবের উচ্ছ্বলতা হারিয়ে ফেলছে শিশুরা। শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা ও শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরুর পরামর্শ দিয়েছে তারা।

বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন-২০১৮ অনুযায়ী, কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেখানে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ‘শিশু’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ‘কিশোর’ বিবেচনায় কাজে জড়ানোর বৈধতা দেওয়া হয়।

শ্রম আইনে বলা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে। কোনো অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনো কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না।

রোববার (৩০ এপ্রিল) কথা হয় মনিুরুজ জামালের সাথে। তিনি বলেন, বাবা নেই। সংসারে অভাবের কারণে কাজে এসেছি। সারাদিন পরিশ্রম করে দিনশেষে মায়ের হাতে ২৫০-৩০০ টাকা তুলে দেই।  তিন জনের সংসার চালাতে রাস্তায় ফুল বিক্রি করেন মা।

গুলিস্তান-কদমতলী রুটে লেগুনা চালকের সহকারীর কাজ করেন ১১ বছরের ছোটন মিয়া। তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সহকারীর  কাজে এসেছি। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও  আর পড়াতে পারেনি। গাড়ি (লেগুনা) চালাইতে দিলে ভালো লাগে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)  সমীক্ষা (সিএলএস) অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৭৬ লাখ থেকে কমে ৩৫ লাখ  হয়েছে। ১৪ বছরের নিচে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ, যা ২০১৩ সালে ১৭ লাখ ৭০ হাজার হয়েছে।

সমীক্ষা অনুযায়ী, শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৬৩ শতাংশ শিশু স্কুলে যায় না। এদের মধ্যে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কখনো স্কুলে যায়নি। ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ছেলে ছিল এবং ২০১৮ সালে ১০ জনের মধ্যে ছয় জন ছেলে।

গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, দেশে শিশু শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন (দেশে ১৭ লাখ শিশু)। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী এর আগে ২০০৩ সালের সমীক্ষায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন।

বাংলাদেশ কাউন্সিল ও লেবার রাইটস সাংবাদিক ফোরাম (আইটিইউসি) তথ্য অনুযায়ী, আগে দেশে শিশু শ্রম ছিল, তা এখন অনেক কমেছে। তারপরও বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ। শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আইটিইউসি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা পরিবহন খাতে কোনো শিশু শ্রমিক দেখতে চাই না। পরিবহন খাত শিশুশ্রম মুক্ত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কাজ করতে হবে। কোনো পরিবহনে হেলপার ও ড্রাইভার হিসেবে যেন কোনো শিশু না থাকে, সে বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা যে অর্থ উপার্জন করে, সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠাতে হবে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটি পরিবহন খাত। ঝুঁকির মধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে শিশুরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে শিশু শ্রম অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করলে ১০ থেকে ২০ হাজার শিশুশ্রমিক যাবে কোথায়? এ কারণে পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন  অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সেখানে শিশুশ্রম থাকতে পারে না।

শিশুরা দোকান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিলে শিশুশ্রমিক হ্রাস পাবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমমুক্ত করতে চাই। সবার সহযোগিতায় আমরা ২০৩০ সালের আগেই শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারব।

তিনি বলেন, ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ১ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এক লাখ শিশুকে দশ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দশ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে নির্বাচিত ১০ হাজার শিশুর প্রত্যেককে ১৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

/এএএম/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়