ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

এক দফা দাবিতে শিগগিরই মাঠে নামবে বিএনপি 

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৩ জুন ২০২৩   আপডেট: ০৯:২২, ২৩ জুন ২০২৩
এক দফা দাবিতে শিগগিরই মাঠে নামবে বিএনপি 

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে এক দফা দাবিতে জুলাই থেকে আন্দোলনে নামার বিষয়ে বিএনপি নিজেদের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি রাজধানীতে জুলাই মাসে বড় ধরনের সমাবেশ বা গণজমায়েত করে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন দলের নীতি-নির্ধারকরা।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, তাদের আন্দোলনের মূল দাবি ‘একদফা’র মোড়কে ভেতরে আরও  কয়েকটি দাবি থাকবে। তবে কী কী দাবি থাকবে, তা নিয়ে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিলেও এই ব্যাপারে এখনই কেউ মুখ খুলতে নারাজ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন নেতা জানান, কয়েকটি দফাকে একদফা আকারে ঘোষণার চিন্তা-ভাবনা প্রায় চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে সমমনা শরিকদের সঙ্গে আলোচনাও প্রায় শেষ করা হয়েছে।

একদফা আন্দোলনের বিষয়ে রাজনৈতিক শরিক জোট ও দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা করেছে বিএনপি। গত সপ্তাহে ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে এ ইস্যুতে আবারও তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির মিত্ররা ঈদের পর থেকে একদফা আন্দোলন শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ এবং এক দফা দাবি ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের প্রতিও পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন তারা।

বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি, নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারের দাবি-এসব মিলিয়ে ‘একদফা’ হবে। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করেই তারা ‘একদফা’ দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামতে চায়।

একদফা ও যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে শেষ পর্যন্ত সব সমমনা বিরোধী জোট ও দলের সঙ্গে কোনো কারণে ঐকমত্য না হলে বিএনপি তাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম থেকেও একদফা আন্দোলন ঘোষণা করতে পারে। আর সেক্ষেত্রে দাবি আদায়ে মিত্ররা যার যার অবস্থান থেকে সেই আন্দোলন চালিয়ে যাবে, এমনটাও হতে পারে বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা।

গত সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে একদফা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকের পরও দলের নীতি-নির্ধারকদের বৈঠকে আবারও এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি নিয়মিত যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদেরও মতামত নেওয়া হচ্ছে।

একদফা বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ১০ দফার ভিত্তিতে বিএনপি গত ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে। সেই ১০ দফার আলোকে সরকারের বিদায়ের লক্ষ্যে একদফা ঠিক করা হচ্ছে। একদফার বিষয়ে শরিকদের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে খুব সহসা একদফার ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে একদফা আন্দোলনের পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্তের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আগের কয়েকটি বৈঠকের মতো এ বৈঠকেও ঘোষণাপত্রের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপির সামনে এখন আর খুব বেশি সময় নেই। তাদের যা করার সেপ্টেম্বরের আগেই করতে হবে। ঘোষণাপত্র নিয়ে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। এখন শুরু করতে হবে এক দফার আন্দোলন। আলোচনার মাধ্যমে ‘যৌথ রূপরেখা’ ইস্যুর সমাধান হবে এবং সবাই যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন করে যাবেন বলে আশাবাদী বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা।

বিএনপি এবং তাদের সমমনা শরিক দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটা দাগে তিনটি দফায় আটকে রয়েছে বিএনপি প্রণীত ৩১ দফা খসড়া যৌথ রূপরেখাটি। সেগুলো হলো-সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি ও এমপিদের ক্ষমতা এবং নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম। এ নিয়ে একাধিকবার বৈঠক হলেও বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় সংকট কাটেনি। তবে দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রয়োজনীয় ছাড় দিয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্তকরণের ব্যাপারে একমত হয়েছেন তারা।

‘যৌথ রূপরেখা’ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে যেসব দফা নিয়ে সমমনা যেসব দলের আপত্তি রয়েছে, সেগুলো সমাধানের সম্ভাব্য উপায় লিখিত আকারে বিএনপিকে জানানোর কথা তাদেরকে বলা হয়েছে। সেটা জানালে তারপর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এদিকে গত বেশ কিছুদিন ধরে দলের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, দলের সাবেক এমপি-মন্ত্রী এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এর বাইরে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও কয়েক দফা সমন্বয় বৈঠক করেছেন তারা। গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দলসমর্থিত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার সাবেক ও বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। এসব বৈঠকে সবাইকে দ্রুত এক দফার আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। গত ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত সেজন্য তারা যুগপৎভাবে নানা কর্মসূচি পালন করে। যার মধ্যে ছিল গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। তবে ঈদের পর থেকে বিএনপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে।

সর্বশেষ গত ১৭ মে থেকে ২৭ মে পর্যন্ত দেশব্যাপী পদযাত্রা ও জনসমাবেশ করেছে বিএনপি। এছাড়া লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে গত ৮ জুন জেলায় জেলায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। ঘন ঘন লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগর ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণসহ সারা দেশের মহানগরগুলোতে পদযাত্রা করেছে। গত শুক্রবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরে পদযাত্রা করেছে।

এদিকে, বিএনপির কর্মসূচির মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বড় শহরে ১১ দফার ভিত্তিতে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করেছে দলটির প্রধান তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিন সংগঠনের তারুণ্যের সমাবেশগুলোর মাধ্যমে গত বছরের বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের মতো আবহ তৈরি করতে চান বলে বলে জানান বিএনপি নীতি-নির্ধারকরা।

চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে বলে জানা গেছে। ঢাকায় তারুণ্যের ওই সমাবেশ ঘিরে সরকারকে বড় ধরনের একটা ধাক্কা  দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতাদের অনেকে।

অতীত অভিজ্ঞতায় বিএনপি নেতারা মনে করছেন, চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে হলে রাজধানীতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে কারণে ঘুরেফিরে ঢাকাকে টার্গেট করেই কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি। তাদের লক্ষ্য-চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর আগে দলের ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাই করা। এর অংশ হিসেবে কোরবানির ঈদের পর থেকে ঢাকায় একাধিক কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। অতীত আন্দোলন, সভা সমাবেশের আলোকে বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছে, হামলা-মামলা উপেক্ষা করে প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক; যা তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতারই প্রমাণ।

আপাতত ঈদুল আজহার আগ পর্যন্ত থেমে থেমে কর্মসূচি থাকবে বিএনপির। তৃণমূল ও কেন্দ্রে ঘুরেফিরে একই কর্মসূচি পালিত হবে। আর ঈদের পর আন্দোলন ক্রমেই জোরালো হবে। তখন ঢাকামুখী কর্মসূচির দিকে যাবে দলটি। সেক্ষেত্রে-চলো চলো ঢাকা চলো, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও দেবে দলটি। এছাড়াও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও দিতে পারে তারা।

এদিকে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ এবং কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় বিএনপির সঙ্গে মতানৈক্য সৃষ্টি হলেও- সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে রাজপথে রয়েছেন শরিকরা। রোজার ঈদের পর থেকে যুগপৎ আন্দোলন বন্ধ থাকলেও যুগপতের ধারায় দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে মিত্ররা। গণতন্ত্র মঞ্চ গত ৪ জুন থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঢাকা থেকে দিনাজপুর অভিমুখে রোডমার্চ করেছে। এছাড়া ওই রোডমার্চে বাধা ও হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ছয় দলীয় এ জোট। আর অসহনীয় লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানের দাবিতে ১৯ জুন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ করেছে তারা। ঈদুল আজহার পরে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চের কর্মসূচি দিতে পারে বলে জানান গণতন্ত্র মঞ্চের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা।

/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়