ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ডিপিডিসিতে দুর্নীতি

টাকা দিলে অনিয়মকে ‘নিয়ম বানান’ মোস্তাফিজ

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২১, ৬ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ২২:৫৩, ৬ মার্চ ২০২৪
টাকা দিলে অনিয়মকে ‘নিয়ম বানান’ মোস্তাফিজ

নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করলেও টাকা না দিলে কোনও কাজ করেন না ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) বনশ্রীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। আবার অনিয়ম থাকলেও টাকা দিলে সব বৈধতায় রূপ দিয়ে সংযোগ দিয়ে দেন তিনি। এক্ষেত্রে ডিপিডিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশকেও বুড়ো আঙুল দেখান তিনি। এসব কারণে ডিপিডিসিতে প্রশ্ন উঠছে, মোস্তাফিজুরের খুঁটির জোর কোথায়?   

পড়ুন- ডিপিডিসিতে চক্রান্তকারীরা থেমে নেই!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রাহকভোগান্তি, রাজস্ব ফাঁকি, নতুন সংযোগের নামে ঘুষ, ভুল রিডিং দিয়ে অতিরিক্ত বিলসহ নানা অনিয়ম-কেলেঙ্কারিতে ভরপুর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’র (ডিপিডিসি) বনশ্রী ডিভিশন। সব ক্ষেত্রেই টাকা দিতে হয় বনশ্রীর এই নির্বাহী প্রকৌশলীকে। বনশ্রীর শীতল প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রাজ্জাকের একটি ১০ তলা ভবনের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে নতুন সংযোগের প্রক্রিয়া করে দিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। এক্ষেত্রেও মানেননি কোনও নিয়মকানুন। ভবনের প্রয়োজনীয় চাহিদাকৃত লোড, ৪৫টি ফ্ল্যাটের জন্য ৩২৭ কিলোওয়াট লোডের আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু, নথিতে লোডের চাহিদা ২৪৪ কিলোওয়াট মাত্র। অর্থাৎ, লোড কম দেখিয়ে ডিপিডিসিকে আর্থিকভাবে ‘ডুবিয়ে’ নিজে লাভবান হয়েছেন।  

ভুক্তভোগী গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি নিয়ম অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করে ডিপিডিসি থেকে সংযোগ নিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাকে বোঝানো হয়েছে, এভাবে সংযোগ নিতে বিপুল পরিমাণ টাকার দরকার হবে। এজন্য চাহিদা কম দেখিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে অতিরিক্ত টাকা তার না দেওয়া লাগে। এটি নিয়ে বারবার ডিপিডিসি থেকে তাগিদ দেওয়া হলেও মোস্তাফিজুর রহমান বিষয়টিকে আমলেই নেননি। বরং, ঠিক রেখেছেন তার অনিয়মের রাজত্ব। এ নিয়ে চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম। চিঠিটি এখন রাইজিংবিডির হাতে রয়েছে।  

সরেজমিনে ভবন মালিকের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নতুন সংযোগ নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন শীতল প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রাজ্জাক। ১০ তলা ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ৩০ লাখ টাকা দাবি করে নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর। সেই অনুযায়ী তাকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ছাড়াই সংযোগ দিতে সুপারিশ করেন। কিন্তু, বিষয়টি তড়িঘড়ি করায় ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলমের সন্দেহের চোখে পড়লে তদন্তে বেড়িয়ে আসে আসল ঘটনা। এরপর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কৈফিয়ত তলব করে নির্বাহী প্রকৌশলীকে (বনশ্রী) চিঠি দেন (স্বারক নং ৮৭.২২৭.৪২০.০০.০০.১০.২০২৪.২২৩)। সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলেও এখনও উত্তর যায়নি প্রধান প্রকৌশলী সেন্ট্রালের দপ্তরে।

নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বনশ্রীতে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া সুপারিশ করেন না। টাকা পেলে অবৈধ কাগজপত্র বৈধ হয়ে যায়। বনশ্রী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহায়তা করছেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আসিফ মাহমুদ, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মকসেদ, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আসাবুর রহমান, বনশ্রী ডিভিশনের অফিস পিয়ন ফোরকান, কম্পিউটার অপারেটর হাকিম। নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে সারাদিন এসব ব্যস্ত থাকেন তারা।

এ ব্যাপারে গ্রাহক শীতল প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ করে ডিপিডিসি থেকে সংযোগ নিতে চেয়েছি। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী টাকা ছাড়া সংযোগ দেবে না বলে টাকা দিতে হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৩০ লাখ টাকা চুক্তি হয়। ২৫ লাখ টাকা দেওয়াও হয়েছে। বাকি টাকা সংযোগ পেলে দেব। ৬ মাস পার হয়েছে, এখন পর্যন্ত সংযোগ পাইনি। সংযোগ না পেয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন যাচ্ছে। সারা জীবনের সব উপার্জন শেষ করে এই ভবন নির্মাণ করেছি। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। কবে পাব তা-ও জানি না। আর সংযোগ না পেলে ফ্ল্যাটও বিক্রি করতে পারব না।’

ডিপিডিসির কৈফিয়ত তলবের ওই চিঠিতে বলা হয়, রাজধানীর বনশ্রীতে এম এ রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর নতুন মধ্যম-চাপ সংযোগের আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি খসড়া কারিগরি প্রত্যায়নপত্র প্রস্তুত করে বনশ্রী এনওসিএস’র অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার কেএম হায়াত, এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, গ্রিড নর্থ-২ মো. আব্দুল ওয়াহেদ হালীম, সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মো. রুহুল আমিনের স্বাক্ষর এআর আইডিতে পেশ করা হয়েছে। খসড়া কারিগরি প্রত্যায়নপত্রে অনুমোদন প্রদানের জন্য নথিটি উপস্থাপন করেন। নথিটিতে লোডের হিসাবে গড়মিল থাকায় বনশ্রীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে ভবনটি পরিদর্শন করে গ্রাহকের প্রকৃত ফ্ল্যাট সাইজের ভিত্তিতে ন্যূনতম লোডের হিসাব (কিলোওয়াট) চেয়ে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনও তথ্য না দিলে ২৭ ডিসেম্বর প্রধান প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম নথিতে অনুমোদন দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের আইডিতে প্রেরণ করেন। 

চিঠিতে আরও বলা হয়, গত ৩ জানুয়ারি খসড়াপত্রে প্রধান প্রকৌশলীর (সেন্ট্রাল) স্বাক্ষর হয়নি নথিতে উল্লেখ করে নিম্নস্বাক্ষরকারী বরাবর প্রেরণ করেন। কিন্তু মৌখিক নির্দেশনার তথ্য নথিতে উপস্থাপন করেননি নির্বাহী প্রকৌশলী। পরবর্তীতে ১৭ জানুয়ারি নিম্নস্বাক্ষরকারী নথির অনুচ্ছেদ ৩৫.৫ এ সাবস্টেশন ক্ষমতা এবং নম্বর: ২৭.৮৭.০০০০.২০২.০০৩.২২.৫৩ তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ মোতাবেক প্রকৃত ফ্ল্যাট সাইজের ভিত্তিতে ন্যূনতম লোড (কিলোওয়াট)’র হিসাবে নথিটি পুনঃউপস্থাপনের জন্য বলেন। কিন্তু অদ্যাবধি নথিটি চাহিদাকৃত তথ্যসহ পুনঃউপস্থাপন করা হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আপনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা দুঃখজনকভাবে অবজ্ঞা করেছেন অথবা চরমভাবে নিজ দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। 

এতে আরও বলা হয়, গ্রাহকের প্রয়োজনীয় চাহিদাকৃত লোড ৪৫টি ফ্ল্যাটের জন্য ৩১৫ কিলোওয়াট কমন সার্ভিসের জন্য ১২ কিলোওয়াট মোট ৩২৭ কিলোওয়াট লোডের আবশ্যকতা রয়েছে, কিন্তু নথিতে লোডের চাহিদা ২৪৪ কিলোওয়াট মাত্র। এই লোড চাহিদার অসামঞ্জস্যতার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ কেন মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার জবাব চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।

অভিযুক্ত ডিপিডিসির বনশ্রী নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনারা কাছে কোনও প্রমাণ আছে। আর এই বিষয়ে আমি কোনও কিছু বলতে চাই না।’

ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। প্রয়োজনে আবারও করবো। অপরাধী যে-ই হোক কোনও ছাড় দেব না।’

জানতে চাইলে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানে নতুন। তাই অনেক কিছু এখনও জানি না। তবে যে ঘটনা বললেন, আমি কাল অফিসে গিয়ে বিষয়টি খোঁজখবর নেব, তদন্ত করবো।’

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়