ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কান্তজীর মন্দির

মো. সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কান্তজীর মন্দির

মো. সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ : কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যশিল্পের অপরূপ নিদর্শন ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। মন্দিরটি বিভিন্ন নামে পরিচিত- কেউ কান্তজীউ মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বলেন, অনেকের কাছে নবরত্ন মন্দির নামেও এটি পরিচিত। ১৮ শতকে নির্মিত মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর-তেতুঁলিয়া সড়কের প্রায় এক মাইল পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে এক শান্ত নিভৃতগ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত।

কালের সাক্ষী কান্তজীর মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনি। লোকমুখে প্রচলিত আর লিখিত কাহিনি থেকে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মন্দিরটির শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৭০৪ সালে দিনাজপুরের রাজা মহারাজ প্রাণনাথ তাঁর স্ত্রী রুক্ষ্মিনীর আদেশে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও রাজা প্রাণনাথ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। পরে ১৭২২ সালে রাজা প্রাণনাথের মৃত্যু হলে তার দত্তক পুত্র রাজা রামনাথ পুনরায় মন্দিরের নির্মাণ কাজে মনোযোগী হন। আবার লোকমুখে শ্রুত আছে যে, শতাধিক শ্রমিক টানা ৪৮ বছর কাজ করে ১৭৫২ সালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন।

চোখ ধাঁধানো জমকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলোর উপরে মোট নয়টি অলঙ্কৃত শিখর বা রত্ন ছিল, যা দেখে মনে হতো একটি উঁচু ভিত্তির উপর রথ দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই নামকরণ হয় নবরত্ন। তখন কান্তজীর মন্দিরটি ৭০ ফুট উঁচু ছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, বর্তমানে এর উচ্চতা ৫০ ফুট।

‘নয় শিখর’ যুক্ত মন্দিরটির চূড়ায় আদিতে যে নয়টি শিখর ছিল তাও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে রাজা গিরিজিনাথ এর ব্যাপক সংস্কার করলেও চূড়াগুলোর সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে যাতে যেকোনো দিক থেকেই পূজারী ভেতরের পবিত্র স্থানে রাখা দেবমূর্তি দেখতে পান। বর্গাকৃতির মন্দিরটি একটি আয়তকার প্রাঙ্গনের উপর স্থাপিত। এর চারদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান যা ঢেউটিন দ্বারা আচ্ছাদিত। আর এই বর্গাকার প্রধান প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ ইমারত।

ভিত্তি থেকে শুরু করে মন্দিরের চূড়া পর্যন্ত ভেতরে ও বাইরে দেয়ালের প্রতিটি অংশে তিনটি পৌরাণিক কাহিনির অনুসরণে মনুষ্য মূর্তি ও প্রাকৃতিক বিষয়াবলি বিস্ময়করভাবে ফুঠিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণ-এর বিস্তৃত কাহিনি এবং অসংখ্য পাত্রপাত্রীর বিন্যাস ঘটেছে এখানে। বর্গাকার এই মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটা টালি বা পোড়ামাটির ফলকে কৃষ্ণের নানা কাহিনি, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার অভিজাতদের বিনোদনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।

পোড়ামাটির এ শিল্পগুলোর বিস্ময়কর প্রাচুর্য, মূর্তির গড়ন কোমল ভাব ও সৌন্দর্য এত যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দেখে বিস্মিত হতে হয়। কেউ যদি মন্দির দেয়ালের অলঙ্করণের দৃশ্য যেকোনো দিক থেকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখেন এবং বিষয়বস্তু সমন্বিত করেন তবে এর বিষয় বৈচিত্র্য দেখে নিঃসন্দেহে অভিভূত হবেন। ৩০০ বছরের পুরোনো টেরাকোটা শিল্পের অপূর্ব সুষমামণ্ডিত মন্দির দেখতে আসা দর্শনার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম হয় না। আপনি যদি ভ্রমণ পিপাসুদের দলভূক্ত হন তাহলে ছুটির দিন বেরিয়ে পড়ুন, আর অভিভূত হোন নয়নাভিরাম কান্তজীর মন্দির দেখে।

যাবেন যেভাবে

ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আপনি বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাসে উঠে দিনাজপুরের কালিতলা বাসস্টান্ড-এ নামুন। এরপর লোকাল বাস, সিএনজি কিংবা অটোতে যেতে পারবেন কান্তজির মন্দির। ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর থেকে দিনাজপুর রেলস্টেশনে নেমে সিএনজি কিংবা অটোতে করে যেতে পারেন কারুকার্যময় ৩০০ বছরের পুরাতন স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন কান্তজীর মন্দিরে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়