ঢাকা     মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

নিষিদ্ধ এলাকায় || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিষিদ্ধ এলাকায় || শান্তা মারিয়া

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে : চতুর্থ পর্ব)

ছুটির দিনের সকাল। পরদিন নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করতে হবে। এই ছুটির দিনটাতে আমাদের আমস্টারডাম ঘুরিয়ে দেখাবে অক্সফ্যাম নভিবের কর্মী কারেন ও তার বস। আমাদের সঙ্গে কারেনের স্বামী ও দুই মেয়েও আছে।

ওরা আমাদের নিয়ে যাবে ক্যানেল ট্রিপে। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী এরপর নেবে রিকস মিউজিয়ামে। এমন সময় আমার সহযাত্রী পার্থ প্রস্তাব করলেন, আমাদের ‘ডি ভালেন’-এ নিয়ে যেতে। প্রস্তাবটি শুনেই কারেনের তরুণ স্বামী পার্থর দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করলেন। তার মুখে লাল ছোপ পড়লো যেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হুজ আইডিয়া ইজ দিস?’

কারেনের সুন্দরী বস একটু যেন বিব্রত হয়ে অন্যদিকে তাকালেন। কারেন তার স্বামীকে বললেন, তুমি লাইলাকে নিয়ে চিলড্রেন’স পার্কে যাও। আমি মিয়াকে ওদের সঙ্গে যাচ্ছি। লাইলার বয়স ৭-৮ বছর। আর মিয়া বছরখানেকের। একটা প্র্যাম-এ চড়ে সে চললো আমাদের সঙ্গে। লাইলা তার বাবার হাত ধরে চলে গেল অন্যদিকে। এইভাবে ভাগাভাগির কোনো মানে বুঝতে পারলাম না। কোথায় যাচ্ছি আমরা?

ক্যানেল ট্রিপ, রিকস মিউজিয়াম, ডাম স্কোয়ার দেখে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেলাম লেকের পাশ ঘেঁষে যাওয়া একটা সুন্দর রাস্তা দিয়ে। সরু ক্যানেল। পাশে সারি সারি তিন-চারতলা বাড়ি। সবগুলো বাড়ির নিচ তলায় বড় বড় কাচের উইনডো। একটু কাছে যেতে বুঝলাম উইনডোর ভিতরে ম্যানিকুইন দাঁড় করানো আছে। আরেকটু কাছে যেতেই আরেক চমক। ওরা ম্যানিকুইন নয়, জীবন্ত মানুষ!

অন্তর্বাস পরা মানুষ কাচের শোকেসের মতো জানালার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ইশারা করে কাকে যেন ডাকছে। কেউ চেয়ারে বসা। কেউ নানা রকম অঙ্গভঙ্গীও করছে। বেশিরভাগই নারী। তবে দুচারজন পুরুষও আছে। কারা এরা? আমি তখনও অন্ধকারে। কারেন আমাকে বুঝিয়ে বললেন, এরা সব সেক্স ওয়ার্কার। এটি হল্যান্ডের এবং শুধু হল্যান্ডের নয়, ইউরোপরে সবচেয়ে বড় ব্রোথেল এলাকা। এ কারণেই তার স্বামী লাইলাকে নিয়ে এখানে আসেনি। লাইলার মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগবে। সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে বিব্রত হতে হবে তাদের। মিয়া ছোট্ট। ও কিছু বুঝবে না।

 



পার্থর আইডিয়া অনুসারে এখানে আসা। আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। পার্থ বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে বললেন, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি এখানে এসেছি। তারপর বাংলায় বললেন, ‘আপনি তো সাংবাদিক ও মানবাধিকার লেখক। আপনি কি বিষয়টা ধরতে পারছেন না? যারা মানবাধিকারের বড় বড় বুলি সব সময় কপচায়, তাদের দেশে এই যে যৌন ব্যবসা ব্যাপক আকারে চলছে, এখানে কি কোনো মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে না বলে মনে করেন?’

আমি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবলাম। তারপর প্রশ্নটি ইংরেজিতে ছুঁড়ে দিলাম দুই ডাচ নারীর উদ্দেশ্যে। দুজনেই বললেন, পুলিশ এই এলাকার উপর কড়া নজর রাখে। এখানে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি বেশ ভালো। যারা সেক্স ওয়ার্কার তাদের নিয়মিত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। একেকজন কর্মী নাকি এত রোজগার করেন যে, কয়েক বছর কাজের পর পরবর্তী জীবনে বসে খেতে পারেন। এদের ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। এই পেশার প্রতি সম্মান জানিয়ে ডি ভালেন এলাকায় প্রবেশ পথেই স্থাপন করা হয়েছে একজন যৌনকর্মীর ভাস্কর্য।

যত কথাই বলা হোক, আমার বিষণ্ন লাগছিল। এই ব্রোথেলে যারা আছে তারা বেশিরভাগই পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়া থেকে আসা মেয়ে। এশিয়ার মেয়েরা বেশিরভাগই এসেছে পাচার হয়ে। ইউরোপের উন্নত জীবনের প্রলোভনে তারা ঠাঁই নিয়েছে এখানে। প্রকাশ্যে না হলেও দালালদের শোষণ, নির্যাতন সবই আছে। এই এলাকার সাথে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রও অবধারিতভাবেই জড়িত।

এই এলাকার আয়তন প্রায় ৬ হাজার ৫শ’ বর্গমিটার। আমস্টেল নদীর তীরে এই এলাকাটি গড়ে ওঠে ১২৭০ সালের দিকে। এটি বন্দর এলাকার মধ্যে অবস্থিত। নাবিকরা এখানে আসতো শুঁড়িখানায়। তার আশপাশেই গড়ে ওঠে ব্রোথেল। এদিকটা ছিল ভবঘুরে, উদ্বাস্তু মানুষদেরও আস্তানা। ব্রোথেলে দাসী হিসেবেও বিক্রি হয়ে যেত হতভাগ্য নারীরা। সর্দারনী আর দালালদের পকেটে চলে যেত যন্ত্রণার বিনিময়ে অর্জিত সব অর্থ। ১৫৭৮ সালে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে মেয়েদের দুর্ভোগ আরও বাড়ে। তখন এই এলাকার মেয়েরা অন্যত্র যেত খদ্দের ধরে আনতে। ধরা পড়লে শাস্তি জুটতো তাদের কপালেই। ১৮১১ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এই এলাকায় তখন দামি আসবাবে বাড়িঘর সাজিয়ে বসে মেয়ে এবং সর্দারনীরা। সে সময় থেকেই জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া ও ক্রেতা আকর্ষণের রীতি শুরু হয়।

 



১৯১১ সালে আবার নিষেধাজ্ঞা। অনেক মেয়ে চলে যায় অন্য এলাকায়। কেউ কেউ ছদ্মপরিচয় বা অন্য ব্যবসার আড়ালে চলে যায়। রেস্টুরেন্ট, বার, বিউটি পার্লার, ম্যাসেজ পার্লারের নামে ব্যবসা চলতে থাকে। সর্দারনী, দালাল, পাচারকারীদের পকেট ভারি হয়। মেয়েরা নির্যাতিতই থেকে যায়। বিভিন্ন যুদ্ধের সময় এই এলাকাটি ছিল সৈন্যদের আমোদ ফুর্তির স্থান। মেয়েদের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে অনেক মানবাধিকার সংগঠন কাজ শুরু করে। তাদের প্রচেষ্টার ফলে এদের অবস্থা অনেকটাই উন্নত হয়েছে। এখন নাকি এখানে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তেমন একটা ঘটে না বললেই চলে। এখন এখানে নারী-পুরুষ-ট্রান্সজেন্ডার সব রকম যৌনকর্মীই আছেন।

শুনছিলাম কারেনের বর্ণনা। আর আমার চোখে ভেসে উঠছিল রোমের দাসবাজারের দৃশ্য। শিকলে বেঁধে যেখানে বিক্রি করা হতো দাসদাসীদের। মানবতার চরম অপমান হতো যেখানে। এই এলাকাতেও কান পাতলে শোনা যাবে সেই ১২৭০ সাল থেকে চলে আসা নির্যাতনের ইতিহাস। শোনা যাবে অপমানিত মানবতার কান্না।

পরিবেশটা ভারি হয়ে উঠছে। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে লাইভ শো, পিপ শো, আর উইনডোতে জমজমাট এলাকায়। সন্ধ্যার সাথে সাথে আরও যেন বাড়ছে রোশনাই, বাড়ছে আলোর খেলা। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছিল শত শত আলোও এ এলাকার অন্ধকার দূর করতে পারবে না কিছুতেই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়