ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

একটি পোড়া আলুর দাম দুই ডলার  

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৩০ জুন ২০২১   আপডেট: ২০:৪৮, ৩০ জুন ২০২১
একটি পোড়া আলুর দাম দুই ডলার  

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ১১তম পর্ব

রঙ্গমঞ্চের পেছন দিয়ে একটা পথ নেমে গেছে নিচের দিকে। পথের দুই ধারে শুধু উপহার সামগ্রীর দোকান আর রেস্টুরেন্ট। দোকানে থরে থরে সাজানো জিনিসপত্রের সবই লুফে নিতে ইচ্ছা করে। রেস্টুরেন্টের প্রধান খদ্দের পর্যটক।

সান্ধ্যকালীন আড্ডায় প্রতিটি রেস্টুরেন্ট যেন একেকটা মিলনমেলা। ফুটপাথের দখল ব্ল্যাক মং নারীদের হাতে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাজার বন্ধ হয়ে গেলে তারা এই ফুটপাথে দোকান বিছিয়ে বসে। ফাঁকে ফাঁকে কিছু খাবারের দোকানও বসেছে। হাঁটতে হাঁটতে খাবারের দোকানগুলোর মধ্য থেকে বেছে বেছে চোখ গিয়ে পড়ল একটা মিষ্টি আলুর দোকানে। কাঠকয়লার আগুনের উপর শিকের তাওয়ায় পোড়ানো হচ্ছে বড় আকারের মিষ্টি আলু। দাম শুনে মাথায় হাত, প্রতিটি পোড়ানো আলু বিক্রি হচ্ছে দুই ডলার! এক সময় বাংলাদেশে এর ব্যপক উৎপাদন হতো এবং প্রধান ভোক্তা ছিল গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। বর্তমানের চিত্র ভিন্ন হলেও প্রতি কেজি বোধহয় ত্রিশ টাকার বেশি হবে না। খদ্দেরের ভিড় দেখে মনে হলো ভিয়েতনামে মিষ্টি আলুর কারবার করলে মন্দ হয় না। 

ফিরে এলাম শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে। ঠিক মাঝখানে স্থাপিত ফুলগাছের একটি সুন্দর বিন্যাস দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। একটা কাঠামোর শরীরে ফুল গাছের টবগুলো এমন করে স্থাপন করা হয়েছে; তাকে পর্বত চূড়া না ভেবে উপায় নেই। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের স্বার্থে পশেই স্থাপিত আছে একটা সাইনবোর্ড। এমন সাইনবোর্ড কমবেশি সবখানেই দেখা যায় কিন্তু সেগুলোর থেকে এর তফাৎ অন্য জায়গায়। খামাখা আদেশ, নিষেধ, পরামর্শ, হুঁশিয়ারি, সাবধান বাণী ইত্যাদির আলোকপাত না করে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ছয়টি লাইন। তার মধ্যে দুইটি লাইন আমার অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় বলে মনে হলো। অনুরোধ সূচক চিহ্ন ব্যবহার করে লেখা লাইন দুটির সারকথা হলো, স্থানীয় শিশু বা লোকেদের অযথা ক্যান্ডি জাতিয় জিনিস অথবা টাকা-পয়সা দেবেন না, তাতে ভিক্ষাবৃত্তি উৎসাহিত হয়ে সা পা’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; লোকালয়ের স্থানীয় হস্তশিল্পের বাজার থেকে পণ্য কিনে তাদের বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় উৎসাহিত করতে সহায়তা করুন। এমন সুন্দর এবং যুযোপযোগী লেখা স্থানীয় সার্বিক ব্যবস্থাপনার একটা পরিচায়ক বলে মনে হলো।

দুপুরের খাবারের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, পেটের মধ্যে তা যেন আস্তই রয়ে গেছে। সুতরাং, রাতে বেশি কিছু খেতে পারবো বলে মনে হলো না। চত্বরে হালকা পায়চারী করতে করতে কিছু খাবার সংগ্রহ করে ফেললাম। বিক্রি হচ্ছে তাজা ফল, দামে খুব সস্তা। ভ্রমণে ফল সব থেকে নির্ভরযোগ্য এবং উপাদেয় খাবার। সেই ভাবনা থেকে কিছুটা ফল কিনলাম। দেখতে আপেলে মতো তবে আপেল নয়। নাম কি তাও জানি না কিন্তু স্বাদে বেশ ভালো। একটা বেকারীর দোকান থেকে লম্বা কয়েকটা পাউরুটিও কিনে নিলাম। প্রতি পিস রুটি ছয় হাজার ডং। এখানে টাকা তেজপাতা। এক বোতল পানি কিনতেও পকেট থেকে হাজার হাজার বেরিয়ে যায়। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ডং এর নোট পেলাম। জানি না এর উপর দিয়ে আরও বড় কোনো কিছু আছে কি না। দশ বিশ ডং এর তো চেহারাই দেখলাম না।

রাত পেরিয়ে হাজির হলো আরেকটা নতুন দিন। ঘর থেকে বের হতেই মেঘ এসে মুখমণ্ডলে নরম পরশ ছুঁয়ে দিলো। ঘুম থেকে উঠেই প্রকৃতির পক্ষ থেকে এমন একটা সম্ভাষণ এবং ঠিক তারপরই এক পেয়ালা পানীয় পান করে শরীর ও মন উভয়ই চনমনে হয়ে গেল। বড় ফ্লাস্কে চব্বিশ ঘণ্টা ভেষজ পানীয় পরিবেশন করা থাকে, অতিথিরা যখন খুশি ঢেলে নিয়ে পান করতে পারে। সকালবেলা আমার একক আসরে বিনয়ের সঙ্গে যোগ দিলেন একজন পর্যটক। হোস্টেলের পক্ষ থেকে অতিথিদের জন্য সকালের নাস্তা কমপ্লিমেন্টারি। নাস্তা খেতে খেতেই তার সঙ্গে একটা নাতিদীর্ঘ আড্ডা হয়ে গেল। আড্ডাজুরে বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেল ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও পরবর্তী পরিকল্পনা। দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের জীবনে ঘুরে দেখেছেন পৃথিবীর অনেক জায়গা। একজন অর্থনীতিবিদ হওয়ার কারণে তার আলোচনা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে বের হতে পারল না। সেটা অবশ্য আমার কাছে ভালো লেগেছে। তাতে আমার জানার থলিতে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু নতুন তথ্য। প্রসঙ্গক্রমে মাউন্ট ফান্সিপানের কথা উঠে আসায় নিজ ব্যাগ থেকে একটা মানচিত্র এনে বিছিয়ে ধরল। বৃষ্টির কারণে ট্র্যাকিং করে আরোহণ করা অসম্ভব। বিকল্প হিসেবে আছে ক্যাবলকার। সেক্ষেত্রে কোনো ভ্রমণ পরিবেশক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। অথবা একটা ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিতে হবে। অধিকন্তু, বিকল্প হিসেবে আছে পদযুগল।

মাথার উপর ছাতা মেলে ধরে রওনা দিলাম ফান্সিপানের উদ্দেশ্যে। হোস্টেলের রাস্তাটাই উঠে গেছে ক্যাবলকার স্টেশনের দিকে। অচেনা পথ, বৃষ্টি ঝড়ছে তার আপন খেয়ালে। খানিকটা শীতও পড়েছে। কোনো পথিকের সম্ভাবনা নেই। হঠাৎ দু’একটা গাড়ি ছুটে চলছে সানন্দে। হালাকা ঢালু উর্ধ্বমুখী পথ ক্রমেই উঠে গেল লোকালয় ছেড়ে পাহাড়ের নির্জনতায়। দুই ঘণ্টা পর উপস্থিত হলাম সুবিস্তৃত এক সমতল প্রাঙ্গণে।  ঢালাই করা প্রাঙ্গণের দূর প্রান্তে মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একাকি একটা লাল রঙের বাস। অপর প্রান্ত থেকে সুরম্য পথ এগিয়ে গেছে অজানার উদ্দেশ্যে। পথের মুখে আরোহীদের জন্য অপেক্ষা করছে চারপাশ খোলা একটা ছোট্ট কোস্টার গাড়ি। পর্যটকদের কেবলকার স্টেশনের বাকি পথ এই গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। পছন্দ মতো একটা আসনে বসে পড়লাম। অন্য কোনো যাত্রী না থাকায় দশ মিনিট পর আমাকে একা নিয়েই গাড়িটা ছেড়ে দিলো। পুরো গাড়িতে একা যাত্রী হয়ে রওনা দিলাম। পথের দুই ধারে ফুলগাছ। গাছে গাছে ফুটে আছে লাল, হলুদসহ হরেক রঙের অজস্র ফুল। দশ মিনিটের মধ্যে পথের শেষ হলো। নামিয়ে দেয়া হলো কৃত্রিম পর্বত চূড়াসদৃশ্য একটা স্থাপনার কিছুটা আগে। এখান থেকে আবারও পায়ে হেঁটে স্টেশন। এই পথটুকুর দৈর্ঘ্য আধা কিলোমিটার। ফুল আর পাতাবাহার গাছে এত সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা, যেন অনন্তকাল ধরে হাঁটলেও ক্লান্তি অনুভব হবে না। চোখের সামনে ধরা দিলো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আর একটা প্রাঙ্গণ এবং তার শেষ প্রান্তে পর্বতের কিনারে বৃহৎ দালান। এগিয়ে যেতে যেতে বিলীন হয়ে গেলাম মেঘের পড়তের মধ্যে। দালানের সম্মুখভাগের দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ফুলে ফুলে পূর্ণ গাছগুলো অনুক্ষণ শোভা ছড়াচ্ছে।

যথারীতি টিকিট কাটতে হলো। মূল্য সাত লাখ ডং। দীর্ঘ চলন্ত সিঁড়ি ধরে কয়েক তলা নিচে নেমে ক্যাবলকারে আরোহণ করতে হলো। প্রতিটি কারে বিশ-পঁচিশ জনের মতো বসার ব্যবস্থা। কিন্তু আরোহী আমিসহ মাত্র পাঁচজন। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর থেকে শুরু হলো এক বিষম উর্ধ্বগতি যাত্রা। সবুজ প্রকৃতির উপর দিয়ে চলতে চলতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আস্ত কারটি হারিয়ে গেল মেঘের দুনিয়ায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সম্পূর্ণ পথে যা কিছু আছে তার সব দেখা যায়। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা লাল, সাদা আর হলুদ রঙের কারগুলো নিকটে এলে তবেই দেখা গেল। আকাশের এতটাই কাছাকাছি চলে গেলাম যে, নিজের অবস্থানকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গায় মনে হলো। 

আধাঘণ্টা রোমাঞ্চকর একটা উড়াল শেষে অবতরণ করলাম অপর প্রান্তের স্টেশনে। এখান থেকে এঁকেবেঁকে প্রায় ছয়শ সিঁড়ি ও একাধিক সমতল চত্বর পেরিয়ে গেলে পা পড়বে ফান্সিপান শীর্ষে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আছে উর্ধ্বমুখী ট্রেন। এই পথটুকু কেউ চাইলে টিকিট কেটে ট্রেনে যাতায়াত করতে পারে। এক কামরার ছোট্ট ট্রেন, সুরসুর করে এগিয়ে চলে। মাত্র কয়েক মিনিটেই পৌঁছে দেয়। স্টেশনের ভিতর একটা ফুডকোর্ট। অনেক পর্যটকের সমাগম। কেউ সিঁড়ি ভেঙে উপরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তো কেউ ফিরে এসে খাবার খাচ্ছে। আবার অনেকেই জমে তুলেছে আড্ডার তুফান। আমি বরং এক মগ গরম কফি পান করে পূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে যাত্রা করলাম। মাত্র চল্লিশটি সিঁড়ি অতিক্রম করেছি অমনি শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। ভরসা হিসেবে আমার সঙ্গের সাথী ছাতা তো আছেই। তাতে খুব একটা কুলানো গেল না। আমার দুর্গতি দেখে একজন সামিট ফেরৎ পশ্চিমা নারী তার ব্যাগ থেকে পুটলি করে রাখা পাতলা পলিথিনের ওয়ানটাইম রেইন কোর্ট আমাকে দান করে দিলো। তার আগে ভদ্রতাস্বরূপ সে তার দুর্গতির কথা তুলে ধরল, যাতে আমি আবার অপমান বোধ না করি। এমন সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম। (চলবে)

পড়ুন দশম পর্ব : ভিয়েতনামে পাহাড়ের কোলে সবুজ ঢেউ

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়