ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভিয়েতনামে পাহাড়ের কোলে সবুজ ঢেউ

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২২ জুন ২০২১   আপডেট: ২০:১০, ২২ জুন ২০২১
ভিয়েতনামে পাহাড়ের কোলে সবুজ ঢেউ

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ১০ম পর্ব

নমফেন-এর মতো হ্যানয়েও দূরপাল্লার যাত্রীদের নিজ নিজ ঠিকানা থেকে তুলে নিয়ে বাস কাউন্টারে জড়ো করা হয়। স্লিপিং বাস। বাসে আরোহণের আগে কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা পলিথিন ব্যাগে জুতা খুলে ভরে নিতে হলো। শুয়ে থেকে এতটা পথ ভ্রমণ করতে হবে, বিষয়টা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম!

সামান্য সুবিধার মধ্যে যা আছে তা হলো আসনের মাথার অংশটা একটু উঁচু-নিচু করা যায়, এর বেশি নয়। সামনে পা বাড়িয়ে চিৎ হয়ে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়। আমার আসন উপরে। অর্থাৎ উপর-নিচে একটা করে আসন। হাতে গোনা দুই একজন বাদে প্রায় সব যাত্রী বিদেশি পর্যটক। তাদের বেশিভাগ বাসে আরোহণের পর কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভ্রমণে বেড়িয়ে মানুষ এমন বেরসিক হয় কি করে আমি ভাবতেই পারি না। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার পথ। মাঝপথে একটা বিরতি মিললো। যাত্রী নামার আগেই দরজার নিচে দুই বাক্স রাবারের স্যান্ডেল রাখা হলো, যে যার ইচ্ছা মতো একজোড়া করে পায়ে পরে নেয়ার জন্য।

ইতোমধ্যেই পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করেছি। পাহাড় বেষ্টিত উপত্যকার বুকে ফুটবল মাঠ সমান প্রাঙ্গণ সামনে নিয়ে একাকি এক রেস্টুরেন্ট। মনে হলো কত কাল পর চোখ দুটো শান্তিতে মেলে ধরতে পারলাম। মনে পড়ল দাস যুগের সেই নির্মম ঘটনার কথা। তৎকালে আফ্রিকার গ্রামকে গ্রাম উজার করে বন্দীদের নির্মমভাবে পশ্চিমের দেশে নিয়ে যাওয়া হতো। বাহন হিসেবে জলযান ছিল একমাত্র মাধ্যম। জাহাজের মধ্যে ঠিক একজন মানুষের আকারে খাঁচা থাকতো। প্রতিটি খাঁচায় একজন করে ভরে নিয়ে রওনা। হতভাগ্য মানুষগুলোকে দিনের পর দিন সটান হয়ে খাঁচাতেই বন্দী থাকতে হতো। এমনকি প্রস্রাব পায়খানার মতো কাজ খাঁচার মধ্যেই সারতে হতো। এই নির্মম যাত্রায় কোনো কোনো দাসের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতো। আমার এই সুখ যাত্রার হাল নিঃসন্দেহে তেমন নয়, তবে শুয়ে শুয়ে ভ্রমণ অপছন্দের একটা ব্যপার। একইসঙ্গে যারপর নেই অস্বস্তিকর। চোখ-কান খোলা রেখে দেখতে দেখতে ভ্রমণ করা আমার অভ্যাস। 

যাহোক, খাবার খেয়ে একটু পায়চারীর উদ্দেশ্যে সামনে এগিয়ে দেখি বাসের গাইড একজন স্থানীয় যাত্রীর সঙ্গে গল্প জমিয়ে তুলেছে। ফাঁকে ফাঁকে ধূমপান করার বাঁশের উপকরণটাতে কষে একটা করে টান। আমার কৌতূহলী চাহুনি দেখে প্রস্তাব করল। আমি রাখঢাক না করে হাতে তুলে নিলাম। ওদিকে তামুক সাজাতে ও তাতে আগুন দিতে গাইড নিজেই প্রস্তুত। তার আগে সঠিক টান দেয়ার পদ্ধতিটা বুঝিয়ে দিলেন। প্রথম টানে পুরোপুরি ব্যর্থ, দ্বিতীয় টানে আংশিক সফল হতে পারলেও তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করলাম- এই জিনিস দ্বিতীবার মুখে নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। 

ভিয়েতনামের রাইস টেরেজ বা জুম-এর দৃশ্যাবলীর সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। বাস প্রবেশ করলো জুমে আবৃত পাহাড়ের বুকের মধ্যে। দুই ধারে মাইলের পর মাইল শুধু জুম। পাহাড়ের চূড়া থেকে গোড়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে জুম সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। সা পা বাসস্ট্যান্ডে নামার পর থেকে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ‘ব্ল্যাক মং’ নারীরা পিছু নিলো। শুধু বলে ‘হোম স্টে, হোম স্টে’! কেউ বলে পঞ্চাশ ডলার, কেউ বলে পয়তাল্লিশ। দূরের পাহাড়ে তাদের বাড়িতে দুই-একদিন থাকা-খাওয়া এবং তাদের সংস্কৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা নিতে পর্যটকদের অনেকেই এই হোম-স্টে সেবা গ্রহণ করে। 

তাদের মধ্যে একজন অনেকক্ষণ আমার পিছু ধরে থাকল। পিঠে একটা বাঁশের ঝুরি। টুকটাক ইংরেজি জানে। এক পর্যায়ে প্রার্থনার সুরে বলল, প্রয়োজনে আপনার ব্যাগ আমার নিজের ঝুরিতে বহন করবো! তার এই সেবা কেনা যে আমার পরিকল্পনার বাইরে তা বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নিজের মতো হাঁটতে থাকলাম। হোস্টেল খুঁজতে খুঁজতে ভুলক্রমে অন্য পথে চলে গিয়ে দেখি, আমার গতিবিধি বুঝতে পেরে সামনের মোড়ে গিয়ে সে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার তার জন্য খুব মায়া হলো। আমার উচিত সব পরিকল্পনা বাতিল করে তার পথ ধরা। শেষবারের মতো আবারও বুঝিয়ে বলার পর শুধু মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এতক্ষণ পিছে ঘুরতে ঘুরতে আমার উপর তার যেন একটা অধিকার জন্মে গেছে। এরপর একটি কদমও আর পিছিয়ে এলো না। দিনটি তার বৃথা গেল। কোনো গ্রাহক পায়নি। কাউকে পাবার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হলো না। সা পা ভ্রমণের শুরুতেই একজন নিরীহ মানুষের আশা ভঙ্গ করে বড় কষ্ট হলো।

অন্যের আশা ভঙ্গের বেদনায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল এবং তা বেশ খানিকক্ষণ তাড়া করে বেড়াল। চোখের সামনে তার মলিন মুখ বারবার ভেসে বেড়ালো। হোস্টেল খোঁজার পেরেশানির কাছে তা বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। সা পা’র উচ্চতা প্রায় দেড় হাজার মিটার। এই উচ্চতায় ছোট্ট শহরটা গড়ে উঠেছে একটা প্রাকৃতিক হ্রদকে কেন্দ্র করে। হ্রদের চারিদেকে ছড়িয়ে পড়েছে শহরের শাখা-প্রশাখা। তার পর দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের প্রাচীর। হ্রদের অপর পাড়ে পাহাড়ের গায়ে দুই কি তিন-চারতলা দালানগুলো ছবির মতো ফুটে আছে। এরই মধ্যে শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উপস্থিত হলাম হ্রদের একেবারে এক মাথায়, যেখানে শহরের কেন্দ্রবিন্দু। দুই যুবক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। 

শহরের প্রধান বিনোদন কেন্দ্র স্টোন চার্চ পেরিয়ে পথ উঠে গেছে পাহাড়ে। তাদের সহযোগিতায় সে পথেই উঠে গিয়ে পেয়ে গেলাম আমার বুক করা ‘গো সা পা’ হোস্টেল। তার আগে স্টোন চার্চ এলাকায় উপস্থিত হতেই একে একে দুইজন পেশাদার গাইড জানতে চাইল মাউন্ট ফান্সিপান আরোহণ করতে এসেছি কিনা? যদি তাই হয় তাহলে তারা নির্দিষ্ট সংস্থা বা এজেন্সির মাধ্যমে আমাকে দুই দিন পরে যে দল যাচ্ছে তাদের সাথে যুক্ত করে নেবে। 

হোস্টেলের অবস্থান পাহাড়ের ধারে। উপরে দৃশ্যমান মাত্র একতলা, নিচে আছে আরও দুইতলা। আন্তরিক অভ্যর্থনার পর এক তলা নিচে গিয়ে একটা ডরমেটরিতে আমার থাকার ব্যবস্থা। হোস্টেলের বারান্দা অনেক বড়, বিশ-ত্রিশজন অনায়াসে বসার মতো। দূর পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা মেঘমালার পরশ ভেসে আসে সারাক্ষণ। ভিয়েতনামে সা পা আমার প্রধান গন্তব্য আর অন্যতম লক্ষ্য ইন্দো-চীন পেনিনসুলার সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া মাউন্ট ফান্সিপান। এমন একটা থাকার জায়গা পেয়ে মনে হলো বিরূপ আবহাওয়ার কারণে যদি বের হতে নাও পারি তাহলে বারান্দায় বসে বসে অনায়াসে কয়েকটা দিন ঠিকই পার করে দেয়া যাবে। কারণ আগামী তিন-চারদিন বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। আর দেরি না করে ফ্রেশ হয়েই বাইরে ছুটলাম। সর্বপ্রথম ঢুঁ মারলাম টুরিজম বোর্ডের কার্যালয়ে। সা পা কেন্দ্রীক পর্যটনের যত আকর্ষণ আছে তার সবিস্তার তুলে ধরা আছে। কার্যালয়ের সাথে বড় ঘরটায় ছোটখাটো একটা পাঠাগারের মতো সাজানো; পর্যটন সংক্রান্ত বিভিন্ন ছবি, ব্রুশিয়ার, বই, মানচিত্রসহ আরও অনেক কিছু। এই মুহূর্তে আমার দরকার বিস্তারিত উল্লেখ আছে এমন একটা মানচিত্র। ভ্রমণে বেরিয়ে এই জিনিসটার বিকল্প আমি আজও খুঁজে পাই না। জানতে চাইলে চেয়ার থেকে একজন উঠে এসে বললেন, পর্যটক তার প্রয়োজন মতো যে কোনটা নিতে পারে। পরিশেষে তার সাথে কথা বলে সা পা এবং তার আশপাশ সম্বন্ধে মোটামুটি একটা প্রাথমিক ধারণা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 

স্টোন চার্চ এলাকায় গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর আদলে একটা বড় উন্মুক্ত মঞ্চ আছে। একসঙ্গে কয়েক হাজার দর্শক বসতে পারার মতো বৃত্তাকার গ্যালারির মাঝে নিচু জায়গাটার প্রান্তে সুবিশাল মঞ্চ। মঞ্চের সামনের ফাঁকা জায়গাতে শিশু কিশোরের দল নানা রকম খেলাধুলায় মত্ত। বিকেল হওয়ার সাথে সাথে চারিদিকের মেঘ এসে ক্রমেই সম্পূর্ণ এলাকার উপর এক পাতলা আচ্ছাদন দিয়ে স্থির বসে রইল। মঞ্চের একপাশে খ্রিষ্টধর্মীয় চার্চ, আরেক পাশে একটা বাজার। কাঠের মোটা মোটা খুঁটি আর কাঠামোর উপর টালি দেয়া চারচালা চারটি বড় ছাউনি। পণ্য বলতে স্থানীয় ব্ল্যাক মং জনগোষ্ঠীর হস্তশিল্পজাত জিনিসপত্র। তাদের আদি নিবাস মূলত চীন দেশের ইয়োলো রিভার অঞ্চল। আঠারো শতকের দিকে এই ক্ষুদ্র জাতীসত্তার মানুষেরা দুর্ধর্ষ চীনা হানদের সাথে সংঘর্ষের ফলস্বরূপ উত্তর ভিয়েতনামে অভিবাসন শুরু করে। সারা বিশ্বে চৌদ্দ থেকে পনেরো মিলিয়ন ব্ল্যাক মং জনগোষ্ঠীর প্রায় এক মিলিয়নের বসবাস ভিয়েতনামে। সা পা’য় বসবাসরত অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে ব্ল্যাক মংদের সংখ্যা সর্বাধিক। তাদের বিচিত্র পোশাক আকর্ষণের মূল বিষয়বস্তু। কালো পেশাকের ব্ল্যাক মং নারীরা প্রত্যেকেই একেকজন সুদক্ষ শিল্পী। ছাউনির নিচে শুধু তাদেরই দোকান। মাফলার, চাদর, পিরান, ব্যাগ, অ্যালুমিনিয়ামের অলঙ্কার এবং খেলানা সামগ্রী তাদের প্রধান পণ্য।

প্রতিটি দোকানে ঐতিহ্যের পোশাক পরা একজন করে নারী। কাছে ভেড়া মত্রই বিক্রির জন্য এটা সেটা এগিয়ে ধরে। কোউ কেউ দোকানে বসেই বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত। আমার এখনই কোনাকাটায় তাড়াহুড়ো নেই, তার চেয়ে বরং ঘুরে ঘুরে দেখতেই ভালো লাগল। (চলবে)

নবম পর্ব: হ্যানয়ের পথে বাংলাদেশের রিকশা 

অষ্টম পর্ব : হো চি মিনের সমাধিতে একদিন                    

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়