ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বাংলা চ্যনেলে রুদ্ধশ্বাস সাড়ে চার ঘণ্টা: শেষ পর্ব

হোমায়েদ ইসহাক মুন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৮, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৬:৫৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২
বাংলা চ্যনেলে রুদ্ধশ্বাস সাড়ে চার ঘণ্টা: শেষ পর্ব

ইভেন্ট শুরু হতে আর একদিন বাকি আছে। এর মধ্যে সব সাঁতারুরা সেন্টমার্টিন চলে এসেছেন। আগের বছরগুলোতে যারা বাংলা চ্যনেল পাড়ি দিয়েছিলেন তাদের গল্প শুনেই সময় পার করছিলাম। রোমাঞ্চকর সব অনুভূতির গল্প! জেলি ফিশ গায়ে লাগলে কেমন লাগে? কীভাবে নিজেকে সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, ঢেউয়ের সঙ্গে কী টিকে থাকতে হবে সব কথাই বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম। আয়োজকরা সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার পর ব্রিফিং-এ বসলো। কয়জন এসে পৌঁছালো? টি-শার্ট বিতরণ এবং বাংলা চ্যনেলের রুট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলো।

পড়ুন সূচনা পর্ব: বাংলা চ্যানেলে রুদ্ধশ্বাস সাড়ে চার ঘণ্টা

আগের বছরগুলোতে যারা বাংলা চ্যনেল পাড়ি দিয়েছেন তাদের মুখ থেকেও অভিজ্ঞতাগুলো শুনলাম। লিপটন ভাই, সিনা ভাই প্রথম বাংলা চ্যনেল পাড়ি দেওয়া টিমের অন্যতম। তাঁরা সবার সামনে বিগতদিনের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরেন আর আমাদের মনে সাহস দেন। বাংলা চ্যনেল পাড়ি দেওয়া আসলে কঠিন কিছু না, মনোবল দৃঢ় রাখাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাইলেই পারব, বাকি সব ধরনের সহযোগিতার জন্য বাংলা চ্যনেল কর্তৃপক্ষ সর্বদা প্রস্তুত আছেন। তবে আমাদের মধ্যে কিছুটা ভীতি কাজ করা শুরু করলো যখন ঘোষণা এলো এবার প্রতি সুইমারের সঙ্গে সিঙ্গেল বোট থাকছে না। এ বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাঁতারু অংশগ্রহণ করবে যার সংখ্যা গিয়ে দাড়িয়েছে ৮০ জনে। সর্বসাকুল্যে ৪০টির মতো বোট জোগাড় করা গেছে যা সাঁতারুদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে এবং প্রতি বোটে সঙ্গে থাকবে অভিজ্ঞ ভলেন্টিয়ার দল। 

শাহপরির দ্বীপ থেকে সাঁতার শুরু হলে প্রতি ৩ কিলোমিটার পরপর রঙিন পতাকাযুক্ত বড় নৌকা থাকবে যা দেখে সাঁতারুরা দিক নির্নয় করতে পারবে। অন্যবারের মত এবার রুট কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। শাহপরির দ্বীপের সৈকত ধরে এক কিলোমিটার এগিয়ে যেতে হবে। এরপর হলুদ পতাকাযুক্ত বোটকে বামে রেখে ডান দিকে মোড় নিয়ে সাঁতারুরা সেন্টমার্টিন এর দিকে সাঁতার কাটা শুরু করবে। ইভেন্ট এর আগের দুইদিন সবাইকে ভালো করে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া হলো। দুই ধরনের টি-শার্ট বিতরণ করা হলো। একটা হলুদ অন্যটা সাদা। হলুদ টি-শার্ট পরে আমাদের নানা ভাবে ফটো সেশন, ভিডিও শুট, ড্রোন শট নেওয়া হলো। 

আমরা পরম আনন্দ আর অতি উৎসাহ নিয়ে সবকিছুতে অংশগ্রহণ করতে থাকলাম। একদিন পরেই আমাদের ভাগ্যে কি হতে যাচ্ছে তার কোনো ধারণা কারো ছিল না। আগের দিন বিকেল বেলা সৈকতে সবাই জড়ো হলাম তারপর ওয়ার্ম আপ করে সমুদ্রে নেমে পড়লাম অনুশীলনের জন্য। ৩কিলোমিটার সমুদ্রের প্রতিকূলে যাবো আবার ফিরে আসবো। আগামীকাল আমাদের কঠিন পরীক্ষায় পাস করতে হবে। অনেক আশা আর ত্যাগের পরে সমুদ্র পাড়ি দিতে এখানে আসা। বাংলা চ্যানেল ইভেন্ট আয়োজকদের প্রতি সাঁতারুকে দিতে হয়েছে এবার ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে আছে টি-শার্ট, ইভেন্ট এর দিন সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবার আর নৌকা সার্ভিস। পাড়ি দিতে পারলে আরো একটা টি-শার্ট এবং ক্রেস্ট সর্টিফিকেট।

রাতে ডিনার করে সব গুছিয়ে জলদি শুয়ে পড়লাম। সকাল ৭টায় সেন্টমার্টিন থেকে বোট ছেড়ে যাবে শাহপরির দ্বীপের দিকে। তার আগে নাস্তা করে রেডি থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সাঁতারু লারিসা রোজান যার বয়স দশ বছর তেরো মাস, তারপরে আছে লারিসার ভাই আরবিন, বয়স পনেরো। তাদের বাবা আখতারুজ্জামান, তিনিও একজন দক্ষ সাঁতারু। গত দুই বছর ধরে আমরা এক সঙ্গে বাংলা চ্যানেলের জন্য সাঁতারের প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি। বাচ্চাদের সঙ্গে পানিতে সর্বাত্মক সাপোর্ট লাগবে, তাই তাদের জন্য আয়োজকরা আলাদা একটা বোট বরাদ্দ রাখলো। আখতার ভাই লারিসার সঙ্গে সাঁতার কাটবে আর আমি থাকবো আরবিনের সঙ্গে। আমরা চারজন কাছাকাছি থাকবো সুতরাং একটা নৌকা থেকে পানি খাবারসহ যাবতীয় সহোযগিতা পাওয়া যাবে। লারিসা এবং আরবিনের মা খাদিজা ভাবিও সেই নৌকাতে থাকবেন। সঙ্গে ভলেন্টিয়ার তো  থাকছেই। একটু আশা পেলাম অন্তত একটা নৌকা আমাদের আশেপাশে থাকবে। বাকিরা নৌকার ব্যাপারে গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। নানা জন নানা কথা বলা শুরু করেছে। প্রতিজনের জন্য নৌকা না দিতে পারলে এত টাকা কেনো নিলো? এতদূর পথ এভাবে নৌকা ছাড়া থাকলে জীবনের রিস্ক হয়ে যাবে। পারসোনাল জিনিসপত্র কোথায় কোন নৌকায় থাকবে, দরকার মতো খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি নানা কথা সবার আলোচনার মূল বিষয় ছিল ইভেন্ট এর আগের রাতে। 

ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। ভোর ৫টা, সেন্টমার্টিনে এখন জোয়ার শুরু হয়েছে। ভাটা শুরু হলে শাহপরির দ্বীপে আমরা সাঁতার শুরু করবো। ৭টায় রওনা হলে ২ঘণ্টায় পৌঁছে যাবো। ৯টায় সাঁতার শুরু করলে ভাটা অতিক্রম করে জোয়ার শুরু হলে সেন্টমার্টিনের দিকে সবাই এগিয়ে যেতে পারবো। 
সকালে নাস্তা দেওয়া হলো চিড়া, কলা, গুঁড়া দুধ, ডিম সেদ্ধ, দই, খেজুর এবং পানি। খেয়ে দেয়ে ৭টার মধ্যে চলে গেলাম জেটিতে। সম্মিলিত মোনাজাত হলো, একে অন্যকে সাহস দিয়ে আমরা নির্ধারিত নৌকায় চড়ে বসলাম। সাগরের ঢেউ দেখে এবার সত্যিই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু দমকা হাওয়া আর উত্তাল ঢেউ থামে নাই। এসব ছোট নৌকা সাগরের ঢেউয়ের কাছে কাগজের নৌকা সমতুল্য। তার উপর আগামীকাল পূর্ণিমার রাত। পূর্ণিমার আগে-পরে তিনদিন সাগর বেশ উত্তাল থাকে, এই কথা মাঝিদের অজানা নয়। আজকে ২৫ ডিসেম্বর ইভেন্ট এর দিন ধার্য করা। মিডিয়াতে প্রচারণা হয়েছে সুতরাং কর্তৃপক্ষ এই তারিখ পেছানোর কথা হয়ত মাথায় আনেননি। এই উত্তাল ঢেউ কেটে আমাদের সবার নৌকা শাহপরির দ্বীপ অভিমুখে আগাতে শুরু করলো। উত্তেজনা, ভয়, শঙ্কা সব কিছু এক করে মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর মধ্যে নৌকার দুলুনিতে আমার মাথা ঘোরা শুরু করে দিয়েছে, দেখলাম আরবিন বমি করতে শুরু করেছে। রোলিং এ নৌকা ধরেও বসে থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে ছিটকে পড়ে যাবো সমুদ্রে। লারিসাকে শুইয়ে দেওয়া হলো। আমি, শাবাব আর আখতার ভাই এক কোণায় পড়ে থাকলাম। মাথা পেট সব গুলিয়ে আসছে। দূরে দেখলাম দুটি ডলফিন ঝাঁপ দিয়ে চলে গেলো। আমরা পানিতে থাকা অবস্থায় এমন ডলফিন যদি গায়ের উপর দিয়ে চলে যায় কেমন অনুভূতি হবে চিন্তা করতেই উত্তেজনায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। অন্য নৌকায় দেখলাম বেশিরভাগ সাঁতারু বমি করছে। সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।

শেষের দিকে এসে আখতার ভাইও বমি করে দিলো। এদিকে আরবিন বমি করতে করতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। শাহপরির দ্বীপের কাছে এসে শুনি সৈকতের কাছে নৌকা যেতে পারবে না, প্রপেলার বালিতে ঠেকে যাবে। আমাদের সাঁতার কেটে সৈকতে উঠতে হবে। উপায় না দেখে আমরা সুইমিং কস্টিউম পরে একে একে সমুদ্রে লাফ দিলাম। সৈকতে ততক্ষণে বেশিরভাগ সাঁতারু পৌঁছে গেছেন। এবং তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থাই বেগতিক। কেউ কেউ আট-দশবার বমি করেছে। সিনা ভাইসহ আরো যারা বাংলা চ্যনেল বেশ কয়েকবার পাড়ি দেওয়া অভিজ্ঞ সাঁতারু আছেন, তাঁরাও অনেকবার বমি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পাড়ে নেমে সবাই পানির জন্য হাহাকার করছে, কারণ পানি আছে নৌকাতে, আর নৌকা আছে এক কিলোমিটার দূরে। এ কি কঠিন পরীক্ষাতে ফেললে মাবুদ! স্থানীয় মানুষ, সংবাদকর্মীসহ বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছে বিচে। এবারের বাংলা চ্যনেলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আমাদের লারিসা, কারণ সবচেয়ে কনিষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে এই চ্যনেল পাড়ি দিতে পারলে তা বাংলাদেশের জন্য এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও একটা রেকর্ড হিসেবে সুনাম বয়ে আনবে। সংবাদিকরা বারবার লারিসার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। পরদিন ‘প্রথম আলো’সহ বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকাতে লারিসার ছবি কভারে ছাপা হলো। পতাকা উত্তোলন করা হলো লারিসাকে দিয়ে। ওয়ার্ম আপ করে, ছবি তুলে, আরো ফর্মালিটিজ শেষ করে সাঁতার শুরু করতে করতে ১০টার বেশি বেজে গেলো। ভাটা এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

আমরা চারজন একসঙ্গে কাছাকাছি থাকবো এমন মনস্থ করে সাঁতার শুরু করলাম। নির্ধারিত নৌকা একটু সামনে এগুলেই আমাদের ধরে ফেলবে এমনটাই পরিকল্পনা। সাঁতার শুরু করার নির্দেশ পেলে সবাই সাগরে ঝাঁপ দিলো। কে কোথায় চলে গেলো কারো আর দেখা পেলাম না। সৈকতের কিনারা ধরে সব সাঁতারুদের যাওয়ার নির্দেশনা ছিল, সেভাবেই আমি আর আরবিন আগাতে থাকলাম। কিন্তু অন্যরা পাড় ধরে না এগিয়ে সোজা ভাবেই এগিয়ে গেলো। আরবিন এমনিতেই বমি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তার উপর বড় বড় ঢেউ কেটে আগাতে হচ্ছিল। বেশ অনেকক্ষণ কিনারা ধরে সাঁতার কেটে যাচ্ছি, কোথাও হলুদ পতাকা দেখতে পারছি না, বেশ উতলা হয়ে পড়লাম। এদিকে গতিও বাড়াতে পারছি না, তাতে আরবিন পিছনে পড়ে যাবে। অন্যদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, আখতার ভাই আর লারিসাকেও না। তাহলে কি আমাদের সাথে নির্ধারিত নৌকাটা আর পাচ্ছি না? মনের মধ্যে শঙ্কা নিয়ে সাঁতার কেটেই যাচ্ছি, ঢেউ মনে হচ্ছে এক দিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যাবে। রিতীমত যুদ্ধ করে যাচ্ছি লোনা পানি আর ঢেউয়ের সাথে। যতবার মাথা তুলে দেখছি মনে হলো আমরা শাহপরির দ্বীপেই আছি, এক চুলও আগাইনি। অনেকক্ষণ পর নির্ধারিত সেই হলুদ পতাকার দেখা পেলাম। এবার ডান দিকে মোড় ঘুরে সাঁতার কাটা শুরু করতে হবে। 

আরবিন হাঁপিয়ে উঠছে, তার গতি কমে আসছে। আমাদের নৌকাটা সাথে থাকলে একটু মানসিক মনোবল পাওয়া যেতো। আমি বারবার আরবিনকে সাহস দিচ্ছিলাম একটু জোরে হাত পা চালাও, আমরা আরো কিছুদূর গেলে লারিসাদের ধরে ফেলতে পারবো। আমরাই সবার শেষে আছি তার ফলে একটা দুইটা নৌকা আমাদের আশেপাশে এসে ঘুরে দেখে যাচ্ছে। একটা নৌকা আমার কাছে আসার পর মাঝি হঠাৎ বলে উঠলো আপনারা উঠে যান, এক জায়গাতেই ৩ ঘণ্টা ধরে সাঁতার কাটতেছেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম তার কথা শুনে! কি বলে এই বেটা! এত দিন এত পরিশ্রম করলাম সমুদ্রে সাঁতরাবো বলে, আর এখন এত অল্প দূরত্বেই আমাকে উঠে যেতে বলছে! মানসিক ভাবে দমে গেলাম কিছুটা সময়। আমি একটু এগিয়ে গেলাম যদি কারো মাথা দেখা যায়। ভলেন্টিয়ার ভাইদের অনুরোধ করলাম, আরবিনের মা যে নৌকাতে আছেন সেই নৌকাটা খুঁজে তাকে যেনো খবর দেয়। মাকে দেখলে অন্তত কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি পাবে আরবিন। আমাদের সঙ্গে যেন একটা নৌকা থাকে তার জন্য বারবার অনুরোধ করলাম। গভীর সমুদ্রে সাঁতার কাটা যেখানে এত চ্যালেঞ্জিং সেখানে সাঁতার করতে করতে বারবার আমাকে মাথা তুলে দিক ঠিক করতে হচ্ছিল। ৩০মিটার পরপর পতাকা থাকবে বলা হয়েছিল, যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে একটাই রঙ হলুদ দেখতে পাচ্ছি। নৌকা ঢেউয়ের তোড়ে এক জায়গায় অবস্থান নিতে পারছে না। আমি কি সঠিক দিকে যাচ্ছি না ভুল পথে যাচ্ছি বারবার কনফিউজড হচ্ছিলাম। মাথা তুলে বারবার জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কোন দিকে যাবো। এদিকে নৌকায় থাকা ভলেন্টিয়াররা আমাদের সেবা দিতে এসে নিজেরাই সবাই বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যে কয়টা নৌকা কাছে এলো, মাঝিরা কথা বলেছে। একটা নৌকার কাছে পানি চাইলে আমাকে ৩লিটারের একটা বোতল ছুড়ে মারলো মাঝি। অনেক কষ্টে এই পানিতে ভাসতে ভাসতে ভারী বোতল থেকে একটু পানি খেলাম, কিন্তু বিপত্তি হলো তার পরেই। বোতলের সঙ্গে দড়ি বাঁধা ছিল, আর নৌকা আমার খুব কাছে চলে আসলো, আমি নৌকার তলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে জোরে জোরে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে গিয়ে পায়ে মাসল পুল করলো। প্রচণ্ড ব্যথায় কুকড়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ ডেড ফিশ হয়ে পানিতে ভেসে থেকে পায়ের মাসলপুল ছাড়ালাম। পানি খাওয়ার সাধ মিটে গেলো। 

বারবার অনুরোধ করার পরে আরবিনের কাছে একটা বোট এলো। এর মধ্যে প্রায় ৩ ঘণ্টা কেটে গেছে, ধীরে সাঁতার কাটলে আর বেশি দূর আগাতে পারবো না। আখতার ভাই আর লারিসাদের দেখা পেলে আরো একটু সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। আমি আরবিনকে আশ্বস্ত করলাম তোমার সাথে এখন নৌকার সাপোর্ট আছে, তুমি সময় নিয়ে সাঁতার কাটতে থাকো, আমি একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তটা বেশ বেদনাদায়ক ছিল। কারণ আমি আরবিনকে একা রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার আর বিকল্প কিছু ছিল না। আমি সাঁতার কেটে আগাতে থাকলাম, হঠাৎ শাবাব দূর থেকে আমাকে ডাক দিতেই মনে হলো সাহস তিনগুণ বেড়ে গেলো। ভাবি আর শাবাব আমাকে সান্ত্বনা দিলো লারিসা আর আখতার ভাই আমার খুব কাছেই আছে। আমি জোরে জোরে সাঁতার কাটা শুরু করলাম। ভাবি জানালো আরবিন নৌকাতে উঠে গেছে। জেনে স্বস্তি পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ একা সাঁতার কাটার পর আখতার ভাইদের দেখা পেলাম। চোখে পানি চলে আসলো আমার। এই মহা সমুদ্রে একা একা সাঁতার কেটে কীভাবে এতদূর আসলাম নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আরবিনকে ছেড়ে আসার পরে কখন কারো দেখা পাবো তার অপেক্ষায় অনবরত সাঁতার কেটে গেছি। লোনা পানিতে অস্বস্তি লাগছিল, কিন্তু আবার নৌকার ধাক্কার ভয়ে আর পানিও খেতে চাইনি। আখতার ভাইদের পেয়ে মনে হলো এবার বাংলা চ্যনেল পাড়ি দিতে আমাকে আর কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এদিকে লারিসা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সাঁতার কেটে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু এমন আবহাওয়া আর ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এতটুকুন মেয়েটা আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। 

আখতার ভাই লারিসার সঙ্গে থেকে সাহস দিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তার নিজের গতিও বাড়াতে পারছিল না, এভাবে ১০ কিলোমিটারের কাছাকাছি আমরা চলে এলাম। এখনো আরো ৬ কিলোমিটার পথ সাঁতরে পাড়ি দিতে হবে। এদিকে কুয়াশায় সামনের পথ ঢেকে যাচ্ছে। সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। শীতের পড়ন্ত বিকেল কখন যে ফুরিয়ে গেলো এত কিছুর মধ্যে আর হদিস করতে পারলাম না। গভীর জলে কি আছে কি নাই, জেলি ফিশের ভয় কিছুই এতক্ষণ মাথায় কাজ করেনি। শুধু ভেবেছি আমাকে এগিয়ে যেতে হবে। এই মহা সমুদ্রে কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেতে হবে। না হলে এই পথটুকুন আমার জন্য পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে। সাঁতার কাটার সময় কত কিছু যে মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। শুধু অথই সাগরে ভেসে চলা, একবার ডানে আর একবার বামে পানির বুদবুদ অনুভব করা। বেলা বয়ে যাচ্ছে, সূর্য হেলে পড়েছে, দ্রুত আলো নিভে যাবে। আমরাই সবার শেষে আছি। বাকিরা যুদ্ধ করতে করতে তীরে পৌঁছে যাচ্ছে। বেলা শেষে এখন বেশ কিছু নৌকা আমাদের কাছাকাছি জড়ো হয়েছে। ভলেন্টিয়ারদের প্রধান শওকত ভাই আমাদের নির্দেশ দিলো কুয়াশায় সব ঢেকে যাচ্ছে আর আমরা যে দূরত্বে আছি তাতে করে সেন্টমার্টিন পৌছাতে পৌঁছাতে পারবো না। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে, যতই সাঁতার কাটি একই জায়গায় পরে থাকবো। আখতার ভাই লারিসাকে নৌকায় তুলে দিলো। আমি ভেবেছিলাম বেলা শেষ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা সাঁতার কেটে যাবো। কিন্তু আখতার ভাই আয়োজকদের নির্দেশকে সম্মান করে নৌকায় উঠে যেতে রাজি হলো। আমি অনুরোধ করলাম, এখনো যেটুকু শক্তি বাকি আছে তাতে আরো কিছু দূর আমরা যেতে পারবো। অন্তত এতো দিনের পরিশ্রম আর সাধনার কিছুটা হলেও মনের সান্ত্বনা পাওয়া যাবে। আখতার ভাই আমাকে এক প্রকার জোর করেই নৌকায় উঠে যেতে বললেন। আমাদের এই যাত্রায় সমাপ্তি টানতে হলো। চোখ ভিজে এলো শেষ না করতে পারার বেদনায়, আরবিনকে মাঝ পথে ছেড়ে আসার কষ্টে, সবাইকে একটা করে নৌকার সাপোর্ট না দেওয়ার ক্ষোভে। তারপরও শুকরিয়া কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। সবাই নিরাপদে সেন্টমার্টিন পৌঁছাতে পেরেছিল। 

সেদিন ৮০ জনের মধ্যে ৫০ জন বাংলা চ্যনেল পাড়ি দিতে পেরেছিলেন। আমি আমার অর্ধেক পথের অভিজ্ঞতার কথা জানালাম, সেন্টমার্টিনের সৈকতে এসে অন্যদের আরো ভয়াবহ কাহিনী শুনে আরো শিহরিত হয়েছি। অনেকেই সাঁতার কাটা অবস্থায় বমি করেছে অনেকবার, পানি দেওয়ার মতো আশেপাশে কেউ ছিল না। নিরুৎসাহিত করে বারবার বলেছে নৌকাতে উঠে যেতে। যেখানে এমন কঠিন কাজে একটা পজিটিভ কথা তার মনোবলকে কতটা দৃঢ় করে সেখানে বারবার নেগেটিভ কথায় আপনার মনোবলকে নষ্ট করে সেখানেই থামিয়ে দিতে পারে। অ্যাডভেঞ্চার এক্টিভিটিতে মানসিক শক্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকতে হয় তা না হলে লম্বা সময় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষ চাইলেই পারে, আশা করি পরের আয়োজনে আবারও নিজেকে তৈরি করে সমুদ্র পড়ি দিতে পারব।            

লেখক: সাঁতার প্রশিক্ষক, সুইম বাংলাদেশ 


 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়