ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুর্গম আদম পাহাড়ে ওঠার আগে রেকি

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৩ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্গম আদম পাহাড়ে ওঠার আগে রেকি

উদয় হাকিম : শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত অ্যাডামস পিক বা আদম পাহাড়। এই আদম চূড়া নিয়ে অনেক মিথ আছে। আছে অনেক রহস্য, গল্পকাহিনী। শুনেছিলাম এই চূড়ায় ওঠা কষ্টসাধ্য। খুব কম মানুষের পক্ষেই সেখানে যাওয়া কিংবা সৃষ্টির প্রথম মানব আদমের পায়ের ছাপ দেখার সৌভাগ্য হয়। আদম (আ.) না কি এই পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম পা রেখেছিলেন। সেই পায়ের ছাপ না কি এখনো আছে !

অ্যাডামস পিকের উচ্চতা ৭ হাজার ২৪২ ফুট। আদম পাহাড়ে যারা যেতে চান, তাদের যাত্রা শুরু করতে হয় রাতে। রাতের বেলা কেন? ওই চূড়া থেকে সূর্যোদয় দেখার বাসনা থাকে প্রায় সবারই। তাই ভোরবেলা সেখানে পৌঁছতে হলে রওনা দিতে হয় মধ্য রাতে। তা ছাড়া দিনে মানুষ অল্পতে হাঁপিয়ে ওঠে। শিখরের উচ্চতা দেখে ভয়ে অনেকেই আগেই রণভঙ্গ দেন। তাই রাতের আঁধারে শুরু করাটাই প্রচলন হয়ে গেছে। এখন ওটাকেই আরোহীরা নিয়ম হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তবে দিনের বেলাতেও যেতে মানা নেই।

রাতের আঁধারে আরোহণে এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার থাকে। এইতো সামনে, আর কিছুদূর গেলেই চূড়ায় ওঠা যাবে-এরকম ধারণা থেকে মানুষ সাহস পায়। বোকার মতো অন্ধকারে শুধু উঠতেই থাকে। সেইসঙ্গে এটি আসলে এক ধরনের ব্যবসায়ও পরিণত হয়েছে। কয়েক’শ দোকান গড়ে উঠেছে পর্বতে ওঠার শুরুর দিকের রাস্তায়। রাতের বেলা দোকানগুলো দিব্যি খোলা রাখে।

রেকি করতে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম সেই বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে। বিশাল মূর্তির কনুইয়ে মৌমাছির চাঁক। মন্দিরের ছাউনিতে বেশকিছু মৌচাক। ছবি তুলে চলে গেলাম রাস্তায়। ৫০ গজ দূরেই সেই নদী বা ঝর্ণায় অনেক শব্দ করে জলের ধারা বইছিল। অ্যাডামস পিকসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে এসেছে ওই জলধারা। এখানকার পাহাড়ি অঞ্চলে এরকম কয়েক’শ ঝর্ণা রয়েছে। সেরকম বেশকিছু ঝর্ণা একসঙ্গে মিলিত হয়ে এই নদীর সৃষ্টি।

পুরো এলাকায় লোকজন খুবই কম। অথচ ইউটিউব ভিডিওতে দেখেছিলাম- এক সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ অ্যাডামস পিকে ওঠার চেষ্টা করে। পুরো এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়। কিন্তু জুলাই থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত ওই পর্বত শিখরে যাওয়ার লোক থাকে খুবই কম। আমরা গিয়েছি আগস্টে, তখন পুরো অফ সিজন।

নদীর ওপরে একটি ব্রিজ। তার উপর দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলছিলাম। নদীটি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিয়ে বয়ে গেছে। ব্রিজ উত্তর দক্ষিণে। পশ্চিমে কোথা থেকে নেমেছে বোঝা দায়। গহীন জঙ্গলে হারিয়ে গেছে আগমনী চিহ্ন। পূব দিকে অনেকটা দেখা যায়, ভাটির প্রবাহ। ছোট বড় পাথুরে পথ মাড়িয়ে ভাটিতে গেছে হারিয়ে। দুপাশে ঝোঁপঝাড় আর সুন্দর বৃক্ষরাজি।

ছবি তোলা শেষ। ইচ্ছে হচ্ছিলো নিচে নেমে স্বচ্ছ জল ছুঁয়ে দেখার। বাম পাশে দেখলাম খালে নামার পথ তালা দিয়ে বন্ধ। ডানে নামা যাবে, পথটা কিছু দূরে। ওখানে একটা ছোট্ট হোটেল। হোটেলের সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। সেখান দিয়ে আরো কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম। নিচে নামার সিঁড়ি ছিল। পাথর বসিয়ে বানানো। একেবারে জলের ধারে চলে গেলাম। পাথরের উপর দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছিল। হাত দিয়ে দেখলাম ঠাণ্ডা পানি। যাওয়ার সময় ওখানে এক কিশোর জিজ্ঞেস করছিল কোথায় যাচ্ছি। বললাম, নিচে নামবো জল ছুঁতে। ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। মিলটনকে বললাম ছবি তুলতে। কিছুক্ষণ পর আসলেন ফিরোজ আলমও।

কিশোর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই খালের নাম কি? বললো, খাল না এটা নদী। ওই হলো, নাম কি এটার। বললো, এর কোনো নাম নেই। সবাই রিভার বলেই ডাকে। তাই হয়! নাম নেই। ঠিক আছে তাহলে আমিই একটা নাম দিই। ধরি এর নাম উদয় রিভার। ছেলেটা আমার মজা বুঝতে পারলো না। বললাম, আজ থেকে এর নাম উদয় রিভার। ঠিক আছে? তোমরা সেটাই বলবা, ওকে? কিশোর মাথা নাড়ে, ঠিক আছে। তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলাম। কী নাম তোমার? ডানো। হুম, নাইস নেইম, স্মার্ট নেইম।

ডানোর হাতে একটা কাঠের ব্যাট ছিল। আরেক হাতে ক্রিকেট বল। বলটা এতো জীর্ণ যে সেটা দিয়ে ক্রিকেট খেলা মুশকিল। চলো আমরা ক্রিকেট খেলি, প্রস্তাব দিলাম আমিই। খুব খুশি হলো সে। ডানো বল করলো, আমি ব্যাট। ডানোকে বললাম, এখানে ছোট মাঠে ক্রিকেট বল দিয়ে খেলা রিস্কি। নদীতে বল চলে যাবে।  জলে হারিয়ে যেতে পারে। পাশেই একটা প্রাইভেট কার রাখা। ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যাও একটা টেনিস বল কিনে নিয়ে আসো। আমি মানিব্যাগে হাত দেয়ার আগেই ফিরোজ শ্রীলঙ্কান ১০০ রুপি ধরিয়ে দেয় তার হাতে। ছেলেটা দৌড়ে চলে যায় বল আনতে। সে খুবই খুশি। বোঝা গেলো, দেহাতি পাহাড়ি এলাকায় খেলার সাথী পাওয়াও মুশকিল। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে ডানো। বল পায়নি কোনো দোকানে। মন খারাপ তার। টাকাটা ফেরত দিচ্ছিলো। বললাম, ফেরত দিতে হবে না। তুমি রেখে দাও। রেখে দিলো, কিন্তু সে হ্যাপি হতে পারলো না। বল পেলেই বরং খুশি হতো।  বিষন্ন মনে কাঠের ক্রিকেট বল দেখিয়ে বললো, এই বলগুলোর দাম কতো? অনেক দাম। মিলটনও বলটা হাতে নিয়ে বললো, অনেক দাম! ছেলেটা ভাবছিলো, এরকম নতুন একটা বল যদি তার থাকতো! একটা বলের জন্য তার আঁকুতি দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। এরা কতটা ক্রিকেট-অন্তঃপ্রাণ! অথচ একটা বল কেনার সামর্থ নেই।

তখনো কিছুটা বেলা ছিল। ভাবছিলাম, অ্যাডামস পিকে ওঠার জন্য রেকি একটু পরে করি। আগে ডানোর মনটা ভালো করে দিই। ডানো চলো আমরা খেলি। ছেলটা ভীষণ খুশি হলো। এক ওভার করে একেকজন বল করলাম। প্রথমে আমি ব্যাট নিলাম, পরে নিলাম বল। এরপর ফিরোজ, মিলটন ও ইমন। ডানো যখন ব্যাট করছিল, ওর ব্যাটিং ঠিক মতো হচ্ছিলো না। বল স্পিন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ব্যাটে লেগে উঠে যাচ্ছিলো। ওকে ব্যাট ধরা শেখালাম। এরপর মিলটন গিয়ে কিছুক্ষণ কোচিং করালো। এদিকে খেলার সময় ইমন ফেসবুকে লাইভ করছিলো। অ্যাডামস পিকের পাদদেশে এভাবে ভীনদেশীরা আগে কখনো হয়তো ক্রিকেট খেলেনি।

একটু পর দুই বছরের একটা মেয়ে শিশু আসলো সেখানে। ডানো বললো এটা তার বোন। নাম কী? অজন্তা। মনে পড়ে গেলো শ্রীলঙ্কান স্পিনার অজন্তা মেন্ডিসের কথা। ডানো বললো, অজন্তা ভালো স্পিন বল করতে পারে। তাই নাকি! কীভাবে সম্ভব! মাত্র দুই বছরের বাচ্চা মেয়ে। বল তুলে দিলাম অজন্তার হাতে। দেখলাম আসলেই দুর্দান্ত। বল ভালোই স্পিন করে। বয়স অনুযায়ী সে চমৎকার বল করে। ঠিকমতো যত্ন নিলে রত্ন ফলবে।

খেলা শেষ করে ব্রিজের পাশে একটা দোকানে গিয়ে বসলাম। দোকানটি অজন্তার বাবার। তার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলেছি বলে কি না, লোকটি খুব সমাদর করলো আমাদের। আমরা তরমুজ ও কলা খেলাম।

যে পথ দিয়ে আদম চূড়ায় উঠতে হয় সেই পথে ধরলাম। মূল প্রবেশ পথে একটা মন্দির। সম্ভবত শিব মন্দির। হিন্দুরা অনেকে এই চূড়াকে শিবা’স পিক বলে থাকেন। মূল মূর্তি প্রধান বেদিতে। একেবারে বাইরের দিকে দুটি মূর্তি দাঁড়ানো। তাদের মোটা পেটে সাপ প্যাঁচানো। ফিরোজ আলম বললেন, শাপ দিয়ে বেল্ট পড়েছে কেন? তাইতো! সবাই মজা পেলাম।

নদীর পাড় থেকে উঠেই পশ্চিমে ঘুরতে হয় অ্যাডাম পিকে যেতে হলে। প্রথম মন্দিরের পরেই কয়েকটা বাঁধানো সিঁড়ি। সেটা পেরিয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম। ওই পথে একটু পর পরই বৌদ্ধ মন্দির। এক জায়গাতে এতো মন্দির কেন? ব্যবসা, যত মন্দির তত টাকা। মিনিট পনেরো হাঁটার পর সূর্য ডুবে গেলো। ঠিক সেই সময় দেখলাম ডান পাশে বিশাল একটা বৌদ্ধ মন্দির। রাস্তাটা কায়দা করে ওই মন্দিরের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো। ইনকামের ধান্দা!

শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে নিয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, সেখানে মৌলবাদীদের আগ্রাসন অনেক বেশি। বাংলাদেশে এক তেঁতুল হুজুর নিয়ে সবাই আলোচনা সমালোচনায় মুখর। অথচ শ্রীলঙ্কাতে মৌলবাদী তেঁতুল বুদ্ধিস্ট ধর্মব্যবসায়ীর সংখ্যা হাজার হাজার। মৌলবাদের শেকড় সেখানে অনেক গভীরে!

যাহোক, বিশাল মন্দিরের মূল রাস্তা বাইরে থাকলেও সবাই মন্দিরের ভেতর দিয়েই যাবে এবং যায়। বিষয়টা বুঝতে চাইলাম। দেখলাম, ওই মন্দিরে ভক্তিমূলক গান বাজছিলো। অথচ কোনো মানুষজন নেই। দান বাক্সের কাছে আলো জ্বলছিলো। মন্দিরে বিশাল বিশাল মূর্তি একেকটা। উত্তর দিকটা নিচু, খোলা। পশ্চিমে চা বাগান। উত্তরে বের হওয়ার রাস্তায় শুয়ে আছে এক বৌদ্ধমূর্তি! ইমন মিলটনরা তখন বাইরে ছিল। এসব দেখছিলাম একাই। লোকজন নেই, ইনকাম নেই দেখে সন্ধ্যেবেলায় সবাই অন্যকাজে ব্যস্ত ছিল হয়তো।

মন্দির দেখা শেষ করে আরো সামনে এগোতে থাকলাম। দু’পাশে অসংখ্য দোকান। সবই বন্ধ। অন্ধকার হয়ে আসছিলো চারদিক। আর সামনে এগোতে চাইলাম না। রাস্তাটা দেখে নিলাম ভালো করে। ফেরার পথ ধরলাম।

হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেলাম। একটা ছোট মিটিং করলাম। মধ্যরাতে রওনা দেব। সবাই ঘুমিয়ে পড়বেন আগেভাগে। ফেসবুকিং আপাতত বন্ধ। সঙ্গে ক্যামেরা ও টর্চ লাইট নিতে হবে। সম্ভব হলে পানির বোতল। তৃষ্ণা লাগবেই। ভালো হয় হাতে লাঠি থাকলে। অন্ধকারে সাপ ব্যাঙ ছাড়াও জন্তু জানোয়ারের ভয়। শোনা যাচ্ছিলো ওখানে নাকি চিতা বাঘ, বাগডাস, বন্য হাতি, শেয়াল, বানরসহ বণ্য প্রাণির আক্রমণের ভয় আছে। সঙ্গে ছাতা থাকলে ভালো হতো। সেটা আর উপায় নেই। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। মুদ্দা কথা মেঘের ভেতর দিয়েই অ্যাডামস পিকে উঠতে হয়। ডানোর বাবার পাশের দোকানে একটা রেইন কোট দামাদামি করছিলাম। অনেক বেশি দাম চাইছিলো বলে আর নেয়া হয়নি।

শুয়ে পড়েছিলাম আগে ভাগেই। টেনশনে ঘুম হচ্ছিলো না। অ্যাডামস পিক’র নিচে শুয়ে আছি। পৃথিবীর প্রথম আদম সন্তান সেইখানে নেমেছিলেন। হয়তো আমি যেখানে শুয়েছিলাম সেখান দিয়েই তিনি নিচে নেমে গিয়েছিলেন! তারপর হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন কোথায়, কে জানে?

আমার ভাবনা ছিলো একটাই- সত্যি আদম পাহাড়ে উঠতে পারব?

পড়ুন : **

         **



শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়