ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মানিক সাহিত্যে রাজনীতি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪১, ১৯ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মানিক সাহিত্যে রাজনীতি

ফেরদৌস জামান :  ১৯০৮ সালের ১৯ মে বাংলা সাহিত্যের আকাশে প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) নামে এক জ্যোতিস্কের জন্ম হয়।

 

মানিকের পৈত্রিক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুর হলেও তার জন্ম সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে। যা ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড প্রদেশের অন্তর্গত। তার মাতা নীরদা দেবী। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় (তিনি ছিলেন একজন সাব-ডেপুটি কালেক্টর)।

 

চাকরির সুবাদে তাকে বহু জায়াগায় বদলি হতে হয়েছিল। পিতা-মাতার সঙ্গে মানিককেও বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন- তার সম্বন্ধে এমন কথার প্রচলন থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যিক হবার জন্য ছিল তার সুদীর্ঘ ও আন্তরিক প্রস্তুতি। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্কে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর শেষ হয়নি। কারণ ততদিনে সাহিত্যিক হবার টান প্রবল হয়ে উঠেছে।

 

মানিক তার সাহিত্য জীবনের শুরুর দিকে অর্থাৎ প্রস্তুতি পর্বে ফ্রয়েডীয় ভাববাদ ও বস্তুবাদের সংঘাতে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। যখন ভাববাদের মোহকে কাটিয়ে উঠতে পারলেন তখনই তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন যে, অর্থনীতিই হল মানুষের জীবনের সব থেকে বড় ও শক্তিশালী নিয়ামক। তারপর তিনি একেবারে স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্দশার প্রধান কারণ অনুসন্ধান করতে ব্যাপৃত হয়েছেন।

 

এ সময়ে মার্কসবাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ফলে ভাববাদকে আশ্রয় করে সমাজের অসঙ্গতিকে বিচার করা পরিত্যাগ করলেন এবং মার্কসীয় ধারায় বিচার বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, তার আগের সাহিত্যকর্মে অনেক ভুল-ভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। ভাববাদ থেকে মার্কসবাদে উত্তরণকালে তিনি যেন পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

 

উত্তরণের এই অন্তর্বর্তীকালে দ্বিধাগ্রস্থ মানিকের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে- সহরতলী ও প্রতিবিম্ব। অস্পষ্টভাবে হলেও সহরতলীতে তিনি শ্রমজীবী মানুষের সম্মিলিত শক্তির সম্ভাবনা ও সেই শক্তির শত্রুকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এ চেষ্টা তার জীবনের শেষ পর্যায়ের রাজনৈতিক উপন্যাস বা রচনাগুলির পূর্বসুরী হিসেবে কাজ করেছে।

 

সমাজের অত্যাচারিত শ্রেণির মধ্যে তিনি শক্তির উন্মেষ লক্ষ করেছেন। সেই শক্তিকে তার সাহিত্যকর্মে চিত্রিত করেছেন। কারণ এখানকার মানুষের মুক্তি বলতে তিনি নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তিকেই বুঝেছেন। ফলে তার সাহিত্যে মিষ্টি কথা তেমন একটা পাওয়া যায় না। রোমান্টিক লেখা যে তিনি লেখেননি তা নয়- তার প্রথম উপন্যাস ’জননী’-তে তা যথেষ্টই আছে। তবে সেই রোমান্টিকতাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমসাময়িক লেখকদের মত জননীকে নিয়ে ভাববিলাসী হবার সুযোগ তিনি নেননি। তিনি তার সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্বে দেশের আপামর শ্রমজীবীদের শোষণমূক্ত হবার খোঁজ পান। তারই পথ ধরে শেষপর্বে হয়ে উঠেছিলেন একজন বিপ্লবী।

 

যে স্বাধীনতায় সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাত্র কিছু সংখ্যক লোক সুবিধা পেয়ে থাকে তাকে তিনি অর্থহীন মনে করতেন। বরং স্বাধীনতা বলতে মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিকেই দেখেছেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে তিনি ভারতবর্ষের একমাত্র শত্রুরূপে দেখাননি, দেখিয়েছেন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে।

 

সুতরাং ১৯৪৭-এ স্বাধীন হবার পরও যে এখানে শোষণের অবসান হয়নি তিনি তার রচনায় বিশ্লেষণ করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। মধ্যবিত্তের দূরত্বকে অতিক্রম করে জনজীবনের কাছাকাছি গেলে যে চরম সত্যটি কাছে চলে আসে তা তিনি উন্মোচিত করে দেখিয়েছেন, যার নাম শ্রেণিসংগ্রাম।

 

মধ্যবিত্ত শ্রেণির হয়েও মানিক নিজ শ্রেণির জন্য একেবারেই কোনো মমতাবোধ করতে পারেননি। তার কারণ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মধ্যবিত্ত যতক্ষণ না শ্রেণিচ্যুত হতে পারছে ততক্ষণ সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর পথে বাধা-বিঘ্ন থেকেই যাচ্ছে।

 

তার রচনায় পরিস্কারভাবে দেখিয়েছেন মধ্যবিত্ত আন্দোলনগুলো প্রকৃতপক্ষে শ্রেণিস্বার্থ আদায়ের আন্দোলন। তা ছাড়া আর কিছু নয়। কখনও বা আন্দোলন গণমুখীতার দিকে বাঁক নিতে চেয়েছে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সুক্ষ প্ররোচনায় তা বিপথে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয়েছে। যে নেতৃত্ব শুধু আপন শ্রেণিস্বার্থের কথা ভেবেছে তাকে তিনি কখনও ক্ষমা করেননি।

 

সন্ত্রাসবাদী ধারার নেতাদের তিনি সমালোচনা করেছেন কিন্ত সে সমালোচনায় ছিল সশ্রদ্ধভাব। অন্যদিকে, যে মধ্যবিত্ত প্রকৃতপক্ষেই শ্রেণিচ্যুত হয়ে মেহনতি মানুষের হয়ে লড়াই করতে চাচ্ছে তাদের প্রতি তিনি বিশ্বাস বা আস্থা রেখেছেন।

 

১৯৪৪ সালে তিনি ভারতীয় কমুউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পার্টির সদস্য ছিলেন। লক্ষণীয় বিষয় হল পার্টি সদস্য থেকেও তিনি একেবারেই নিজের মত করে সাম্যবাদী ধ্যান ধারণার কথা বলে গেছেন। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য যে বিশেষভাবে বিশেষ কোনো বামপন্থী সংগঠনের অনুগত হতেই হবে এরুপ কথা তিনি কোনোখানেই বলেননি। বরং তার রচনায় দেখা যায় অত্যাচারিত শ্রমজীবীরা নিজেরাই প্রতিরোধ করার জন্য দল বেধে দাঁড়িয়েছে। কিংবা  জনগণ নিজেই প্রতিরোধে নেতৃত্ব হাতে তুলে নিয়েছে। তার লেখনীর ব্যাপারে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, তার লেখা সর্বত্রই সুখপাঠ্য নয় এবং সকল ক্ষেত্রেই শিল্পমানের হয়ে ওঠেনি। তার অন্যতম একটি কারণ  হতে পারে তার ধারার লেখার জন্য ঠিক যে ধরনের অবলম্বনযোগ্য ও সহায়ক ঐতিহ্য দরকার ছিল তিনি তা পাননি। সুতরাং বলা যায়, এই ধারার লেখায় তিনি নিজেই পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

 

১৯৩৫ সালে তিনি গ্রন্থকার হিসেবে প্রথম আবির্ভূত হন।  সে বছরই আক্রান্ত হন মৃগী রোগে। এই রোগ তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিল। লেখাই ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান জীবিকা। যার ফলে দারিদ্র ছিল তার চিরসঙ্গী। কোনো গ্রন্থ তিনি কাউকে উৎসর্গ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণই মানবতার প্রতীক তাই ’স্বাধীনতার স্বাদ’(১৯৫১) নামক গ্রন্থখানিই কেবল সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনসাধারণকে উৎসর্গ করেন।

 

১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়