ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

রংপুরে পরাজয়কে সঠিক মাপমাঠি ভাবছে না বিএনপি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রংপুরে পরাজয়কে সঠিক মাপমাঠি ভাবছে না বিএনপি

এস কে রেজা পারভেজ : রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বড় ধরনের পরাজয় সত্ত্বেও এই নির্বাচনের ফলকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। কারণ, রসিকে বিএনপির প্রার্থী ‘প্রতিকূল পরিবেশ ডিঙিয়ে’ যে ভোট পেয়েছেন, বাস্তবে সেখানে দলটির ভোট তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বলে জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। সেই জন্য  ভোটের এই সংখ্যাককে কোনভাবেই দলটির সেখানকার জনপ্রিয়তার সঠিক মাপকাঠি হিসেবে মানতে নারাজ বিএনপি।

জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুরে জনগণের ভেতরে বিএনপির অনুকুলে ‘ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন’ জানিয়ে তারা বলছেন, এ জনপ্রিয়তার প্রতিফলন পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে দেখা যাবে। রাজনীতির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে ভোটের সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও বিএনপি নেতাদের মতে, সমান সুযোগ সুবিধা পেলে এবং প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারলে রসিকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মধ্যে।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই নির্বাচনে একটি সুক্ষ আইওয়াশ হয়েছে, যা খালি চোখে দেখা যাবে না। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ একই জিনিস। তারা রসিক ভাগাভাগি করে নিয়েছে।’

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীর যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে বিএনপির প্রার্থী এক্ষেত্রে বৈষম্যমুলক আচরণের শিকার হয়েছেন বলেও মনে করেন বিএনপির এই নেতা।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে বিএনপির কর্মী সমর্থদের যেমন হয়রানি, ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে; তেমনি প্রার্থীও বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছে। আমাদের মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি। আমরা মাত্র ৬ থেকে ৭ দিন ক্যাম্পেইন চালাতে পেরেছি। যদি সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হতো, প্রচার-প্রচারণার সমান সুযোগ পাওয়া যেতো, তাহলে আরো বেশি ভোট পাওয়া যেতো। কারণ, এর আগে ওই এলাকায় উপজেলা নির্বাচনগুলোতে বিএনপির  অনেক প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।’

বৃহস্পতিবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা লাঙ্গল প্রতীকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার চেয়ে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোট কম পেয়ে হার মানতে হল আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। নৌকা প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। মেয়র পদে ভোটে তৃতীয় হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা। ধানের শীষ প্রতীকে তার ভোট ৩৫ হাজার ১৩৬।

একটিতে ইভিএমসহ মোট ১৯৩টি কেন্দ্রে দিনভর ভোটগ্রহণের পর গণনা শেষে মধ্য রাতে ফল ঘোষণা করেন এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার। তিনি জানান, প্রায় চার লাখ ভোটারের মধ্যে মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৭২৩ জন ভোট দিয়েছেন। ভোটের হার ৭৪ দশমিক ৩০।

বিএনপির সুত্রগুলো বলছে, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির যে পদক্ষেপ তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। এ নিয়ে দলের ভেতরেই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষনে যে আহ্ববায়ক কমিটি করা হয়েছে তা হাইপ্রোফাইল হয়নি বলে মত নেতাকর্মীদের। রসিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে আহ্ববায়ক করা হয়েছে। এখানে স্থায়ী কমিটির একজনকে আহ্ববায়ক করে হাবিব উন নবী খান সোহেলের মতো রংপুরের স্থানীয় একজনকে সদস্য সচিব করা হলে নির্বাচনে আরো ভালো প্রভাব পড়তো বলে দলের মধ্যে পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে।

তাছাড়া প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিএনপি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ রাখতে পারেনি। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে প্রার্থী নির্বাচন করেছে দলটি। অথচ নির্বাচনের অনেক আগেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সেখানে জনসভা করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে এসেছিলেন। এছাড়া বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও সেভাবে যোগাযোগ রাখতে পারেনি বিএনপি। সূত্র মতে, একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে জামায়াতের সঙ্গে ভোটের হিসাব-নিকাশ করেছে বিএনপি। ততক্ষণে বিষয়টি অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে সূত্রের দাবি।

রংপুরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, রংপুরে বিএনপির ভোটের ফল আরো অনেক ভালো হতে পারতো। কিন্তু রংপুর সিটিতে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে দলের যেসব কমিটি রয়েছে সেগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা অত্যথন্ত নাজুক। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে এই কমিটি গঠন না হওয়ায় দলের মধ্যো অভ্যকন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই রংপুর জাতীয় পার্টির শক্ত এলাকা। এই অবস্থায় সেখানে বিএনপি তার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ভোটের মাঠে প্রভাব রাখতে পারেনি।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুরে জয় পরাজয়ের চেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় কিনা এবং প্রার্থীরা সমান সুযোগ সুবিধা পান কী না, তা পর্যবেক্ষণে রেখেছিলো দলটি। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে পুরো কৃতিত্ব দিলেও নির্বাচনের আগের পরিবেশ নিয়ে হতাশ বিএনপি। এক্ষেত্রে বিএনপির প্রার্থীকে হয়রানি এবং দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হয়রানির বিষয়টি উঠে এসেছে। তাছাড়া জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। লাঙ্গলের পক্ষে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর বিষয়টিও বিএনপির অভিযোগের তালিকায় এসেছে।

দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রংপুরে বিএনপির অনেক ভোট রয়েছে। বিশেষ করে এরশাদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ওই জায়গায় গত কয়েক বছরে বেশ ভালোই অবস্থান গেড়েছে বিএনপি। কয়েকটি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে সেই জনপ্রিয়তার ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোটের হিসেব নিয়ে সন্তুষ্ট নন দলটির নেতাকর্মীরা। তারা এটিকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সুক্ষ কারচুপি হিসেবে বিবেচনা করছেন।

এমন অভিযোগ করে রসিক নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এ সরকারের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমার বিজয় নিশ্চিত ছিল কিন্তু ষড়যন্ত্র করে আমাকে হারানো হয়েছে।’

জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নগরীর মহল্লায় মহল্লায় আমার যে জনপ্রিয়তা, তারপরও তারা একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করে হারিয়েছে।’

ফল বর্জনের কারণ ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বলেন, ‘সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বকশী কেন্দ্রে দিনের বেলা সিল-স্বাক্ষরবিহীন ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে। এর মানে কী হতে পারে? আমার কর্মী ও তাদের পরিবারের ৬০ হাজারেরও বেশি ভোট রয়েছে। কিন্তু ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ২০১২ সালের ভোটে দলীয় প্রতীকের বাইরে থেকে নির্বাচন করেও এর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছি। সেখানে এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে আরও বেশি ভোট পাওয়ার কথা কিন্তু হল উল্টোটা। এসবই নির্বাচনে কারচুপির বড় প্রমাণ।’

দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নির্বাচনে সুক্ষ কারচুপির অভিযোগ এনে বলেছেন, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কি হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে।

নির্বাচন কমিশন নির্বাচন সুষ্ঠ, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারেনি অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম এবং ভোটের দিন কেন্দ্র দখলে সেটিরই বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচনের আগে কতগুলো ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ বাধা দিয়েছে, ঠিকমত নির্বাচনের প্রচার করতে দেয়নি। অন্যান্য দলকে যেখানে প্রচার চালাতে বেশি সময় দিয়েছে, তখন আমাদের দলকে বেশি প্রচারণা করতে দেয়নি। এগুলো সমস্যা ছিলই।’
 
নির্বাচনের আগে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, নির্বাচনের আগে যে গতি থাকার কথা তা তিনি সেখানে দেখেননি। সেখানে নির্বাচন নিয়ে কোনো উত্তেজনা ছিল না।’

এর দুটো সম্ভাব্য কারণও বলেছেন বিএনপি মহাসচিব। তার মতে, রংপুরে কোনো দলেরই খুব বেশি ‘সুইটেবল’ প্রার্থী ছিল না। আর দ্বিতীয় কারণটা হতে পারে ‘এরশাদ সিনড্রোম’।

তিনি বলেন, ‘এরশাদ সাহেব নিয়ম ভঙ্গ করে আগের দিন আমার সঙ্গেই গেছেন রংপুরে। উনি সারা রাত ছিলেন, রংপুরে ছিলেন, ভোট দিয়ে এসছেন। তার উপস্থিতিটাই সেখানে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।’

তবে ভোটের ক্ষেত্রে পরাজয় হলেও রংপুরে বিএনপির জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘রংপুরে বিপর্যয় হয়েছে আওয়ামী লীগের, বিএনপির নয়। এই নির্বাচনে বিএনপি প্রতিকূল পরিবেশ স্বত্ত্বেও যে ভোট পেয়েছে জনপ্রিয়তার সেই প্রতিফলন পরবর্তী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মিলবে। তাছাড়া ভয়-ভীতি দেখানোর কারণে অনেকে ভোট দিতে আসতে পারেননি। বিশেষ করে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বাধা দেওয়া হয়েছে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রাইজিংবিডিকে  বলেন, ‘জাতীয় পার্টির এরশাদ সাহেবসহ অনেক স্থানীয় সংসদ সদস্য যারা ওইসব এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন, জনপ্রিয়তা আছে; তারা আইন ভেঙে ক্যাম্পেইন চালিয়েছেন। সুষ্ঠু ভোট হলে এবং সমান সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হতো আর লাঙ্গলের সঙ্গে ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ডিসেম্বর ২০১৭/রেজা/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়