ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সোয়া ২ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা!

এম এ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ২৮ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সোয়া ২ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা!

এম এ রহমান : মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের স্টেশনারি অফিসে কাগজ কেনার নামে সোয়া দুই কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ ষ্টেশনারি অফিসের ব্যবস্থাপক মো. সাদেক হাসানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে।

তাই ষ্টেশনারি অফিসে কাগজ কেনার এমন দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতা অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই সঙ্গে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হেলাল উদ্দিন শরীফকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, এক সময় সরকারি স্টেশনারি অফিসে বাংলাদেশি কাগজ টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার বিধান থাকলেও রহস্যজনক কারণে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যেখানে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার উন্নতমানের কাগজ রপ্তানি হয়। সেখানে বর্তমান টেন্ডারে বিদেশি কাগজের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে অধিদপ্তরের অফিসিয়াল নির্দেশে ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর টেন্ডারের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদিত এক লাখ চার হাজার ৭৩২ রিম এ-ফোর সাইজ অফসেট কাগজ আমদানি করা হয়েছে। বাজারে এই কাগজের খুচরা মূল্য প্রতি রিম ৩৫০ টাকা। অথচ কেনা হয়েছে ৪৪২ টাকা দরে। যেখানে কাগজের দাম হওয়ার কথা সাড়ে তিন কোটি টাকা, কিন্তু তা কেনা হয়েছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৪ টাকায়। অতিরিক্ত দুই কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৪ টাকার ভাগবাটোয়ার হয়েছে। বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের ব্যবস্থাপক মো. সাদেক হাসানসহ কিছু কর্মকর্তা ও টেন্ডারবাজদের মধ্যে এই ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, এ কাজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাকে ব্যবহার করে দেশি কাগজের পরিবর্তে বিদেশি কাগজ কেনার জন্য একটি দাপ্তরিক চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। সরকারি অর্থের এমন অপচয়ের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও ঠিকাদারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

দুদক থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ সূত্রে আরো যে সকল বিষয়ে জানা যায় তা হলো-

ভাগবাটোয়ারার নাটের গুরু : বাজারে যেখানে রিমপ্রতি কাগজ সর্বোচ্চ তিন থেকে সাড়ে তিন’শ টাকা দরে পাওয়া যায়, তা টেন্ডারে সাড়ে পাঁচ’শ থেকে ৬০০ টাকা দরে কেনা হয়েছে। এর নাটের গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ও সহকারী পরিচালক মো. সাদেক হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্টেশনারি অফিসের বাজারদর কমিটির প্রধানও তিনি। আর ব্যবস্থাপক হিসেবেও তিনি ব্যাপক ক্ষমতাধর। তাঁর নির্ধারিত দরের ভিত্তিতেই টেন্ডার বিবেচনা করা হয়।

টেন্ডারবাজির কৌশল: অভিযোগে বলা হয়েছে টেন্ডারবাজির কৌশলের অংশ হিসেবে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পথ প্রকৃত অর্থে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। টেন্ডারে কিছু উদ্ভট শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণে নির্দিষ্ট কয়েক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই কেবল টেন্ডারে অংশ নিতে পেরেছেন। যে সকল ব্র্যান্ডের কথা বলা হয়েছে, তাতে হাতেগোণা প্রতিষ্ঠানই কাগজ আমদানি করার যোগ্যতা লাভ করেন। ফলে তাঁদের কাছ থেকে কাগজ কেনা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় থাকে না। এরই ধারাবাহিকতায় টেন্ডারে এফএফ এন্টারপ্রাইজ ২৫ শতাংশ এবং এসএএস এন্টারপ্রাইজ ৭৫ শতাংশ কাগজ সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। এসএএস এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদারি লাইসেন্সটি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কামালউদ্দিন তালুকদারের স্ত্রী শারমিন সুলতানার নামে। তাঁর তদবিরেই কাগজ সরবরাহ ছাড়াও মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের কাজ পাচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠান। আর এসব এসব টেন্ডারবাজকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সাদেক হাসান। 

এ বিষয়ে আরো জানা যায়, এফএফ এন্টারপ্রাইজের মালিক ফরহাদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে স্টেশনারি অফিসের টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত। তিনি সন্ত্রাসী দিয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাকেও সহযোগিতা করছে সাদেক সিন্ডিকেট।

ইচ্ছামতো কাগজের ব্র্যান্ড নির্ধারণ: দেশি কাগজ কেনা বাধ্যতামূলক করা হলে, বন্ধ হবে টেন্ডারবাজি, বন্ধ হবে দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের ইচ্ছেমতো ব্যয় নির্ধারণ, থেমে যাবে লুটপাট। আর এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চালু রাখার জন্যেই স্টেশনারি অফিস এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির সূত্র ধরেই টেন্ডারবাজদের উত্থান হয়েছে। লুটপাটের এ প্রক্রিয়াটি জায়েজ করতেই কাগজ কেনার প্রতিটি টেন্ডারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাগজের ব্র্যান্ড উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে মূলত উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনকারীদের টেন্ডারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্যই এ ধরনের অনৈতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কর্মকর্তা-টেন্ডারবাজ একাট্টা: স্টেশনারি অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও টেন্ডারবাজদের সমন্বয়ে সক্রিয় সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বরের ওই টেন্ডারে  সিলিকোন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ফেলে। কিন্তু সিলিকোন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের দরপত্রটি না খুলেই ফেরত দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিজ্ঞপ্তিতে টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় ২৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা এবং খোলার সময় বিকেল ৩টা নির্ধারণ করা হলেও, তা লঙ্ঘন করে দুপুর ২টার সময় একজন সহকারী পরিচালক ও অন্য একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দুটি টেন্ডার জমা দেন। মূলত তাঁরাই স্টেশনারি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকশ না করার শর্তে দুদকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ইতিমধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে কাগজ কেনার দরপত্রসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করা হয়েছে। নথি হাতে পেলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

দুদকের উপপরিচালক মো. বেনজির আহম্মদ অনুসন্ধানটি তদারক করছেন।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৫/এম এ রহমান/লেনিন/সন্তোষ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়