ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মুরাদ চত্বরের প্রিয় কালাম ভাই

ইমন ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৮, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৭:২০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
মুরাদ চত্বরের প্রিয় কালাম ভাই

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এক প্রিয় নাম ‘কালাম ভাই’। কমবেশি সবার জীবনের স্মৃতিতেই যেন খানিকটা এই নামটি জড়িয়ে আছে দারুণ এক মুগ্ধতায়। যে নামটি মনে পড়তেই চোখের সামনে ক্যাম্পাস জীবনের হাজারো মধুর স্মৃতি ভেসে ওঠে। অনেকে এই নামটি শুনতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। 

‘কালাম ভাই’ নিতান্তই একজন চা বিক্রেতা। ক্যাম্পাসের মুরাদ চত্বরে তার রয়েছে একটি চায়ের দোকান। একেবারেই সহজ-সরল অবয়বে গড়া মানুষটি দিনরাত চা সরবরাহ করে যান শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, ঘুরতে আসা পর্যটক সবাই-ই কমবেশি তার চায়ের ভক্ত। আর এ কারণেই কালাম ভাই-এর চায়ের দোকানে সবসময় উপচেপড়া ভিড় বিরাজ করে। সকাল হতেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হয়। কালাম ভাইয়ের চা পান করতে করতে নানা আলোচনায় মুখর হয়ে ওঠে মুরাদ চত্বরের আঙিনা। যে আলোচনায়  ক্লাসের পাঠক্রম থেকে শুরু করে রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক, গল্প, প্রেম-ভালোবাসার মতো বিষয়গুলো জায়গা পায়। শিক্ষার্থীদের কাছে তাই এক আস্থার নাম কালাম ভাই। 

নতুন কলা ভবনের ঠিক পাশেই অবস্থিত মুরাদ চত্বর।  ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শহিদ সালাম-বরকত হলের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান মুরাদুর রহমান। ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তাকে স্মরণে নির্মাণ করা হয় তার স্মৃতিফলক। 

মুরাদ চত্বরের ঠিক সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। ছোট্ট দোকান। দাঁড়িয়ে চা বানাতে ব্যস্ত কালাম ভাই। কাঠের বেঞ্চিতে একদল শিক্ষার্থী খোশগল্পে ব্যস্ত। একজন হুংকার ছেড়ে বললো কালাম ভাই চারটা চা দাও, দুটো চিনি কম। দোকানে মালপত্র তেমন কিছু নেই। চারটে চায়ের কেটলি, চৌদ্দ কি পনেরোটা কাপ, দড়িতে ঝুলছে দুটো পাউরুটির ব্যাগ, দুটো খোলা বিস্কুটের কাচের জার, খোলা কেকের ঝোলানো দুটো পলিথিন, কয়েকটা চিপসের প্যাকেট, আর বাহারি আইটেমের কিছু সিগারেটের প্যাকেট। 

‘কালাম ভাই’ সবসময় হেসে কথা বলেন। চোখে মুখে নেই বিরক্তের ছাপ। কাকে কীভাবে সম্মান জানাতে হবে তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। তরুণ শিক্ষকদের অনেকেই মুরাদ চত্বরে এসে চুটিয়ে আড্ডা দেন। এছাড়াও সিনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তার সখ্যতাও বেশ পুরোনো। রং চা খাবে নাকি দুধ চা খাবে, তারা কখন, কোথায় চায়ের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এসব বিষয় তার নখদর্পণে।

তার পুরো নাম মো. আবুল কালাম। বেড়ে ওঠা বরিশালের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। কর্মজীবনের শুরুতে একটি স্কুলের পিয়ন ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় চলে আসেন বেশি আয় রোজগারের আশায়। কাজও পেয়ে যান তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য দারোয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। এভাবেই মায়ায় পড়ে যান এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে এলে তার কাজ চলে যায়। তার অনুরোধে বিভাগের দুজন শিক্ষক তাকে মুরাদ চত্বরে একটি চায়ের দোকান করে দেন। এভাবেই আবুল কালাম হয়ে ওঠেন একজন চায়ের দোকানদার।

আবুল কালাম ওরফে কালাম ভাই ভেজা ভেজা চোখে এভাবেই জানাচ্ছিলেন তার আত্মপ্রকাশের কথা। জানালেন তার অনুভূতিগুলো-

‘আমি একজন চা বিক্রেতা। চা বিক্রির টাকায় আমার সংসার চলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো। তাদের সহানুভূতি ও সহযোগিতা না থাকলে আমি আজ ‘কালাম ভাই’ হয়ে উঠতে পারতাম না। এসব কথা মনে হলেই কান্না পায় আমার। করোনার সময় ক্যাম্পাস যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন আমার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরার মতো অবস্থা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্যের কথা ভুলবো না কখনো। তারা সাহায্য না করলে মরেই যেতাম। এজন্য এতো মায়া এই ক্যাম্পাসের প্রতি, ক্যাম্পাসের মানুষগুলোর প্রতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসি বলেই এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যাইনি। আমি বিশ্বাস করি, আমি যদি মরেও যাই তাহলে এই ছাত্ররাই আমাকে আমার বাড়িতে ঠিক পৌঁছে দিয়ে আসবে।’ 

ক্যাম্পাস জীবনে আড্ডার রয়েছে প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস। চায়ের আড্ডা সেই উচ্ছ্বাসে আনে নতুন মাত্রা। আড্ডা দৈনন্দিন জীবনে এক অন্যরকম আবেশ তৈরি করে। একঘেয়ে জীবনের ধারায় আড্ডা যে নিদারুণ আবহের সূচনা করে তার ছাপ পড়ে প্রতিটা মানুষেরই মনে। কী পুরুষ, কী নারী সবার মাঝেই আড্ডার প্রশান্তিময় আবেগ ছড়িয়ে দেয় অসীম আনন্দের মূর্ছনা। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জীবনে হাঁসি-ঠাট্টা আর গল্প-আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া মানুষ মাত্রই একজন আরেকজনের সঙ্গে একপশলা গল্প করে পাঁচ-দশ মিনিট পার করে দেবে- এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। 

সকাল গড়িয়ে দুপুর। মুরাদ চত্বরে সবার উপচেপড়া ভিড়। ক্লাস শেষ। তাই একটু গলা ভেজাতে এসেছেন অনেকেই। হাতে হাতে চায়ের কাপ পৌঁছে দিচ্ছেন কালাম ভাই। কারোটা লাল চা, কারোটা আবার দুধ চা।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একদল শিক্ষার্থী জানালেন, পরীক্ষা ছিল আমাদের। মনটাকে একটু সতেজ করার জন্য কালাম ভাইয়ের দোকানে আসছি। 

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এভাবেই মুরাদ চত্বরের আঙিনায় ফুটে ওঠে কাপের আড্ডার এক দারুণ প্রতিচ্ছবি। 

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/ফিরোজ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়