ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘যৌতুকের আপডেট ভার্সন উপহার’  

মাহবুবুর রহমান সাজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৯ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৬:৫৯, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘যৌতুকের আপডেট ভার্সন উপহার’  

‘যৌতুক দেবেন না, যৌতুক নেবেন না।’ মুখে মুখে বুলিটি সবাই আওড়াই। অথচ যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়ার পরিসংখ্যান নীরবে বেড়েই চলছে। কিন্ত কেউই আজকাল সেটি যৌতুক বলে গ্রহণ কিংবা প্রদান করেন না। এর নতুন নাম হয়েছে উপহার বা উপঢৌকন। 

যৌতুকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেই, যৌতুককে ঘৃণা করি, আবার মেয়ের বিয়ের সময় সেটি দিয়ে থাকি বা দিতে বাধ্য হই। আবার ছেলের বিয়ের সময়ে কনে পক্ষ থেকে অনুরূপ কামনা করি। কখনো ভাবি না যে এটিই যৌতুকের আপডেট ভার্সন।

এই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন প্রায় শতভাগ লোক। দেশের প্রচলিত আইনে উপঢৌকন বলে যৌতুক হিসেবে কোনো কিছু গ্রহণের বিধান নেই। তবুও এই বেআইনি প্রথা চলছে। বেআইনি কাজ যখন সবাই করে তখন সেটা প্রথায় রূপান্তরিত হয়। সেটাকে কেউ আর অপরাধ মনে করে না।

এমন প্রথার মূলোৎপাটন রীতিমত দুঃসাধ্য। দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। কেননা, এই বাঙালি সমাজেই বহু বছর ধরে সতীদাহ প্রথার মতো মানবতাবিরোধী প্রথা সদর্পে বিদ্যমান ছিল। কৌলীন্য প্রথা, বিধবাবিবাহ বিরোধী প্রথা, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি প্রথাগুলোও বাঙালি সমাজকে ক্যান্সারের মতো যুগ যুগ ধরে আক্রান্ত করে এসেছে।

যৌতুক প্রথা বাঙালি সমাজে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রথায় পরিণত হয়। ফলে সতীদাহ প্রথা, কৌলীন্য প্রথা, বিধবাবিবাহবিরোধী প্রথা বিলুপ্ত হলেও যৌতুক প্রথা প্রচ্ছন্নভাবে বাঙালি সমাজে রয়েই গেছে।

কুসংস্কার এবং অনৈতিক প্রথাকে সমাজে টিকিয়ে রাখতে সবসময় খোঁড়া যুক্তির আশ্রয় নেওয়া হয়। নীরবতা, নিমরাজি কিংবা নাম পরিবর্তন করে চালিয়ে নেওয়া হয় এসব। উদাহরনস্বরূপ- সুদ খাওয়া হারাম কিন্ত মুনাফা নামে আমরা অবলীলায় খাচ্ছি।

বিয়ের সময় মেয়েদের সঙ্গে কোনো উপঢৌকন প্রদান যৌতুক প্রথার আধুনিক ভার্সন। আজকাল আমরা সভ্য হয়েছি। তাই এটিকে যৌতুক বলে গ্রহণ করতে নারাজ। অথচ এটি গ্রহণের লোভও সামলানো কঠিন। তাই ছলাকলার আশ্রয় নিই।

বর পক্ষের উক্তি, ‘আমরা শুধু মেয়েকে চাই। অন্য কিছু নয়। আপনাদের যা ইচ্ছে হয় আপনাদের মেয়ের সঙ্গে দেবেন। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।’ অনেকে আবার চাতুর্যতার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা শুধু মেয়েকে চাই। তবে যেভাবে চলছে সমাজে যেমন একটা মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, সোফাসেট এসব কি আর বলতে হয়!’

কেউ বলেন, ‘আমরা কিছু চাই না। তবে তারা খুশি হয়ে যা দেবে তা নিতে দোষ কী।’ কেউ বা বলেন, ‘আমরা তো কিছু চাই না। তারা খুশি হয়ে দিলে কেন গ্রহণ করবো না।’

আজকাল বড় কর্মকর্তারা কিংবা নেতারা চাকরি কিংবা অন্য কোনো সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেন না। চা-নাশতার পয়সা গ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে এই পয়সার পরিমাণ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হয়। ঈদ সালামির নামে কোটি টাকা দাবির গল্প আমরা জানি। তেমনিভাবে যৌতুক প্রদান এবং গ্রহণ হচ্ছে উপহারের নামে।

‘আমার মেয়ে অপরের বাড়িতে গিয়ে কার জিনিসে হাত দেবে।’ সেই ছুতোয় কনে পক্ষ মেয়ের সঙ্গে উপহারের নামে যৌতুক প্রদান করেন। একবারও ভেবে দেখেন না যে বরের বাড়ি অপরের বাড়ি নয়। এটা মেয়ের নিজের বাড়ি। সত্যিকারার্থে এই ধারণাটা মানসিক সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ।

রোগ শনাক্ত না হলে যেমন নিরাময় করা কঠিন। অধিকার কি না জানলে যেমন অধিকার সচেতন হওয়া কঠিন। নিজেকে না জানলে যেমন জগৎ কঠিন। তেমনি কোনটি অপরাধ, কোনটি কুসংস্কার সেটি না জানলে সংস্কারমুক্ত হওয়াও কঠিন।

গভীর ঘুমে নিমগ্ন ব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলা সহজ। কিন্ত যে জেগে থেকে ঘুমিয়ে রয়েছে, তাদের জাগিয়ে তোলা বড্ড কঠিন। প্রচ্ছন্ন এই যৌতুকের ব্যাপারে আমাদের সমাজ তেমনি জেগে ঘুমাচ্ছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, সমাজের ক্ষত এই কুসংস্কার কিংবা বেআইনি প্রথা নির্মূলে যুগে যুগে কতিপয় মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। দাস প্রথা উচ্ছেদে আব্রাহাম লিংকন, বর্ণবাদ বিলোপে মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন ম্যান্ডেলা, সতীদাহ প্রথা নির্মূলে রামমোহন রায় কিংবা বিধবাবিবাহ প্রচলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি মনীষী। প্রচ্ছন্ন এই যৌতুক প্রথা নির্মূলে তেমনি কোনো মহাপুরুষের বড্ড প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহফুজ/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়