সাক্ষ্যে যা বললেন মডেল তিন্নির বাবা
নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম
দীর্ঘদিন পর মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম ও বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম সাক্ষ্য দিয়েছেন।
বুধবার (৫ জানুযারি) ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে মাহবুব করিমের সাক্ষ্য শেষ হয়। তবে রেজাউল করিমের সাক্ষ্য এখনও শেষ হয়নি। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ভোলা নাথ দত্ত।
জবানবন্দিতে তিন্নির বাবা মাহবুব করিম বলেন, ‘‘তিন্নি আমাকে ৫ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে টেলিফোনে ধানমন্ডি যেতে বলে। আমি সেখানে যাই। তিন্নি আমাকে বাবু নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিন্নি তখন অলরেডি জানতো যে, ওই বাবুই অভি। আমাকে তিন্নি এটাও বলে যে, বাবু ভাই হচ্ছেন অভি। আমাকে অনেক সম্মান করলো। জুস খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করলো। পরে আমি তিন্নিকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। আসার সময় আমি তিন্নিকে জিজ্ঞাসা করি, অভির সাথে এই ঘুরাঘুরি কেন? তিন্নি বলে- অভির সাথে তার অ্যাফেয়ার। অভি তাকে বিয়ে করবে।
‘তখন আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কীভাবে অভিকে বিয়ে করবা। এমন বিয়ে মানি না। তিন্নি বলে, আমি পিয়ালের সাথে থাকতে চেয়েছি কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পরের দিন রাত ১০টায় অভি আমাকে তিন্নি-পিয়ালের বাসায় ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে পিয়াল ছিল। পিয়ালের ভাই রিয়াল এবং কাজের দুই মেয়েও ছিল। অভি আমাকে বলে, পিয়ালের কাছ থেকে সে তালাক নিয়ে নেবে। তারপর অভি পিয়ালকে ধমকের সুরে বলে, সে দুটি ডিভোর্স লেটার ব্যাকডেটেট পাঠাবে। সেগুলো পিয়াল ব্যাকডেট দিয়ে সিগনেচার করবে।
‘অভি পিয়ালকে জিজ্ঞাসা করে, এই বাসার মধ্যে তোমার কী কী জিনিস আছে? পিয়াল বলে এই বাসায় যা আছে সবই তার। তারপর অভি বলে- রোজার ঈদের পরেই সে তিন্নিকে বিয়ে করবে। তখন রোজা চলছিল। অভি বলে মেয়ে আনুষ্কা পিয়ালের কাছে থাকবে। তারপর অভি অদ্ভুত ধরনের চেহারা করে তিন্নিকে চার্জ করে বলে- সে কত জনের সঙ্গে রাত যাপন করেছে। এটা তাকে খুলে বলতে। তিন্নি আমার সামনে সব স্বীকার করে। তারপর অভি তিন্নিকে বলে তার ব্যাংকে কত টাকা আছে? তিন্নি বলে -৭০ হাজার টাকা আছে। মাঝে পিয়াল বলে- ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ছিল। তখন অভি তিন্নিকে বলে সে কেন মিথ্যা বললো?
‘এক পর্যায়ে পিয়াল অভিকে বলে, অভি ভাই আপনাকে নাকি তিন্নির বাবা দেখে নিবে। আসলে এতোদিন আমি পিয়ালকে তিন্নিকে তুমি সাপোর্ট করো বলেছিলাম এবং আমি অভির বিষয়টা দেখতে বলেছিলাম। অভি সাথে সাথে পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমার মাথার ডান পাশে তাক করে বলে- ওই সালার বেটা, তোর সাহস আছে আমাকে দেখে নিবি? আমি তখন ভয়ে বলি, অভি ভাই আমি তো আপনারে চিনি নাই। তখন অভি বলে- এখন বুঝছোস তো আমি কে? এরপর অভি পিস্তল নামায়। তারপর আমাকে বলে- এই বাসায় আর আসবি না। আরো বলে সে তিন্নিকে নিয়ে হজ্জ করতে যাবে। আমি তখন বলি-তুমি কোন আইনে বিয়ে ছাড়া তিন্নিকে নিয়ে ওমরাহ করতে যাবে? পরের আমাকে চলে যেতে বললে আমি রাত ১২টার দিকে বাসায় চলে আসি। এদিন সম্ভবত ৬ নভেম্বর তারিখ ছিল।”
মাহবুব করিম বলেন, ‘‘৭/৮ তারিখ আমি আর তিন্নি কেউ কারো বাসায় যায়নি বা দেখা হয়নি। দুজনই আমরা লজ্জা পাচ্ছিলাম। ১০ তারিখ সন্ধ্যার পর আনুমানিক ৭টা বা সাড়ে ৭টার সময় আমার বাসায় আসে। সেখানে আমার বাবা-মাও থাকতো। তিন্নিকে কিছু খেতে দেওয়া হয়। ও বলে সে রোজা রাখে। তিন্নি ৫-৭ মিনিট, বেশি হলে ১০ মিনিট ওই বাসায় ছিল। দাদাকে সে পা ধরে সালাম করে। বুকে জড়িয়ে আদর করে। আমাকে সরি বলে। বলে যে, ওই দিনের জন্য দুঃখিত। তাকে মাফ করে দিতে বলে। তারপর ছাদে গিয়ে আমার মা যেখানে মারা গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে সালাম করে। তিন্নি দাদা-দাদির কাছেই বড় হয়েছিল। এরপর আমি তিন্নিকে থাকতে বলি। তিন্নি বলে অভি এসে নাকি ফাংশনে নিয়ে যাবে। তিন্নি বলে- তাকে যেতে হবে। তারপর তিন্নি চলে যায়। বাসার কাজের ছেলে মহসিন তিন্নিকে নামিয়ে দেয়। তখন আটটা বাজে হয়তো।
‘৯টার সময় তিন্নির বাসার কাজের মেয়ে বীনা আমার বাসায় এসে জিজ্ঞাসা করে তিন্নি আপু কোথায়? আমি বলি, ও তো চলে গেছে আরো আগে। বীনা বলে, অভি ভাই আইসা তিন্নিকে না পাইয়া রাগারাগি করতেছে। রাত ১০টা পর্যন্ত বীনা ২/৩ বার আসে তিন্নিকে খুঁজতে। আমরাও অস্থির হয়ে পড়ি। খুঁজতে শুরু করি। রাত ১১টার দিকে আব্বা বড় ভাইকে বলে- তোরা রাতে বাসায় থাকিস না, অভি এসে শাসিয়ে গেছে। আব্বা আমাদের কোথাও চলে যেতে বলে। ভাইয়া তখন আমাকে রামপুরার এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যায়। পরেরদিন আমাকে ওখানে রেখে ভাইয়া কলাবাগানের বাসায় চলে আসে। ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমি ওখানেই ছিলাম।
‘১৫ তারিখ সকাল ৯/১০টার সময় মামাতো ভাই পেপারে তিন্নির লাশের ছবি দেখে আমাকে দেখায়। আমি লাশ দেখে চিনতে পারি। তারপর আমরা কেরানীগঞ্জ থানায় যাই। আমি লাশ দেখতে চাই। তার পরদিন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করে জুরাইন কবরস্থান থেকে। আমরাও ছিলাম। লাশ চিনতে পারি। পরে আমরা পত্রিকায় এবং মানুষের মুখে শুনতে পারি যে, অভিই তিন্নিকে হত্যা করেছে। তিন্নির লাশ যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয় সেদিন সকাল বেলা কলাবাগানে অভির সাথে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলেছে- তিন্নিকে খুঁজতে হবে না। অভি ভাইয়াকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ভাইয়া নেয়নি।”
এরপর তিন্নির বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু তা শেষ হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ১৫ নভেম্বর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। ওইদিন তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি রায় থেকে উত্তোলন করে সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন করে। আদালত তা মঞ্জুর করেন।
ঢাকা/মামুন/সনি