সুনীলের প্রথম আলো: মহামানবদের গল্পগাঁথা
আনিকা তাসনিম সুপ্তি || রাইজিংবিডি.কম
কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক ও সাংবাদিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলাধীন কালকিনি থানার মাইজপাড়া গ্রামে হলেও বাংলাভাষী ভারতীয় সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সর্বাধিক খ্যাত।
২০১২ সালে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি অসাধারণ একজন সাহিত্যিক হিসেবে বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি তিনি।
‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের অমর উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করা যায় এটিকে। বাঙালির নবজাগরণ শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ১৮৮৩-১৯০৭ এই চব্বিশ বছরে ভারতবর্ষে তথা বাংলায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মেছেন। আর পৃথিবীকে মাতিয়ে গেছেন তারা। তাদের নিয়েই মূলত দুই খণ্ডের বিশাল এই উপন্যাস। উপন্যাসের সময়সীমায় জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষই প্রধান ঘটনা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধি।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু এবং চরিত্র বিশ্লেষণ
উপন্যাসটি শুরু করার পরই হারিয়ে গিয়েছিলাম উনিশ শতকের শেষ সময়ের এক মহাযাত্রায়। এ যাত্রার সঙ্গী ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য এবং তার অদ্ভুত সাম্রাজ্য। ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষে অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় ত্রিপুরার তফাত ছিল এটাই যে ত্রিপুরা একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গণ্য হত।
উপন্যাসের অনেকটা জুড়েই ত্রিপুরা রাজ্যের গল্পগাঁথা। কোমলতা ও কঠোরতার সংমিশ্রণ ছিল মহারাজার চরিত্রে। আপাত উদাসীন এই শৌখিন রাজা ব্যস্ত থাকতেন ফটোগ্রাফি আর সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে। তিনি নিজে কবিতা ও গান রচনা করতেন। তৎকালীন সাহিত্যে অগ্রগতির জন্য রাজকোষ থেকে উদারহস্তে দান করেছিলেন তিনি। তার উত্তরাধিকারী রাধাকিশোর মাণিক্যও বাংলা সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের আরো দুইটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র- রাজকুমারদের গৃহশিক্ষক শশীভূষণ সিংহ এবং মহারাজের একান্ত সচিব রাধারমণ ঘোষ। তাছাড়াও রাজপ্রাসাদের ভেতরের রাণীদের কুটিলতা হিংসা বিদ্বেষের কাহিনী, সিংহাসন নিয়ে গোপন রাজনীতি, স্বাধীন এ রাজ্যে ইংরেজদের হস্তক্ষেপের চেষ্টা সবকিছুই এসেছে এই বইতে।
১৮৮২ সালে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের পাটরানী এবং মহারাজের বাল্যসখী ও জীবনসঙ্গিনী ভানুমতী তখন সদ্য-মৃত। অত্যন্ত শোকাতুর এই সময়ে তিনি ‘ভগ্নহৃদয়’ এর কবিতা পাঠ করে স্বান্ত্বনা পেয়েছিলেন এবং নবীন এই কবিকে শিরোপা পাঠিয়েছিলেন যা বিরল ঘটনা।
উনিশ শতকের বিখ্যাত এক পরিবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর। সেই পরিবারের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি পৃথিবীর কাছে বিশ্বকবি হিসেবে পরিচিত। সুনীলবাবু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন, কবিজীবন, কর্মজীবনের এক দারুণ সমন্বয় করেছেন এই উপন্যাসে৷ তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনার অন্তরালের উপলক্ষ্য জেনে পাঠক অদ্ভুত এক আনন্দ পাবেন। রবীন্দ্রনাথের দেশের প্রতি ভাবনা, ধর্মীয় চিন্তা, তার সাংসারিক বিভিন্ন সমস্যা সবকিছুই আছে। ঠাকুর পরিবারে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অন্যান্য সদস্যদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন স্বমহিমায় ভাস্বর। পরিবারের পুরুষদের ছাপিয়ে নারীরাই যেন হয়ে উঠেছিলেন আধুনিকতা আর স্বাধীনতার প্রতীক।
রবিঠাকুরের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি নাম কাদম্বরী। নিজের সৌন্দর্য আর স্বভাবে অনন্য হয়েও ঠাকুর পরিবারে নিজের অধিকার তেমন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি সংসারের প্রতি উদাসীন এই নারী৷ তবু সাহিত্য জগতে নিজের অজান্তেই যে পরোক্ষ অবদান রেখে গিয়েছেন তা নিজে কখনোই জানতে পারেননি আত্নঘাতী এই অভিমানিনী। তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ এবং তার কবিতা লেখার প্রথম ও বিশেষ অনুপ্রেরণাদাত্রী এবং তার প্রথম প্রণয়িনী। তার বৌঠান কাদম্বরীর সম্পর্কের অনেক অজানা আর অন্তরালের ব্যাপার লেখক গল্পের আকারে জানিয়েছেন।
কবিগুরুর সঙ্গে অদ্ভুত এক সম্পর্ক ইন্দিরাদেবীর। যিনি ছিলেন তার ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা। রবীন্দ্রনাথের তাকে লিখা মূল চিঠিগুলো গোপন করে তিনি বিশেষ কিছু অংশ খাতায় তুলে রাখতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিঠি বলে কথা, যত ব্যক্তিগতই হোক সেসবের সাহিত্যমূল্য নিশ্চয়ই অসাধারণ ছিল! যার কথা না বললেই নয় তিনি সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী। ঠাকুর বাড়ির প্রথম সংস্কার ভাঙ্গা তেজী এক নারী যিনি ঠাকুরবাড়ির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সাহস আর জ্ঞানে অতি আত্নমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন।
এছাড়াও কবিগুরুর ভগ্নি স্বর্ণকুমারী অতি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক নারী। তার কন্যা সরলাদেবী অতি সাহসী, স্বাধীনচেতা এবং আধুনিক নারী, যাকে নারী নেত্রী বললেও ভুল হবে না। তৎকালের প্রেক্ষিতে এমন বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের বর্ণনা সত্যিই চিত্তাকর্ষক। তবে সরলার শেষ পরিণতিতে মনে বড় অতৃপ্তির সঞ্চার হয়।
ঠাকুর পরিবারের এসব নারী চরিত্রের মধ্যে কবিগুরুর স্ত্রী মৃণালিনী ছিলেন নিতান্তই ম্লান। আপাত দৃষ্টিতে নির্লিপ্ত এক নারী মৃণালিণী, স্বামীর সহধর্মিণী হতে পেরেছিলেন ঠিকই তবে নর্মসঙ্গিনী হতে পারেননি।
কাদম্বরীর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অত্যন্ত যুগোপযোগি বলেই মনে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়েই ইংরেজদের টেক্কা দিয়ে দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভিন্ন ধারার যে অবদান তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তা অতি বিরল৷ কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। তাই আড়ালেই থাকতে হয়েছিল তাকে।
উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তৃত আরেকটি অংশ লেখা হয়েছে একজন খাঁটি সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়ে। তরুণ উচ্চশিক্ষিত এক যুবক নরেন দত্ত যে ছিলো রামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য। শিষ্য থেকেই পরবর্তীতে উত্থান ঘটে স্বামী বিবেকানন্দের। নরেনরূপী স্বামী বিবেকানন্দের কিছু ব্যাপার চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। প্রথম জীবনে তিনি সবসময় রামকৃষ্ণের সঙ্গে কালীপূজার বিরুদ্ধে, অবতারবাদের বিরুদ্ধে যুক্তি তর্ক করতেন। পরে তিনিই অবতারবাদ মেনে নেন, কালীপূজারি হন।
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোর বিরাট ধর্ম সম্মেলনে বাঘা বাঘা সব বাগ্মীদের টেক্কা দিয়ে তেজের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন উদার ধর্মনীতি বেদান্ত ধর্ম। কিন্তু এর জন্য তাকে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আমেরিকার সেই সংগ্রামের দিনগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। হিন্দু ধর্মের মূল বিষয় থেকে সরে এসে মানুষ যে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার বিপরীতে বিবেকানন্দের এই উদার ধর্মনীতি ঔষধের মতো কাজ করছিল।
স্বামী বিবেকানন্দেরই বিদেশিনী শিষ্যা মার্গারেট নোবল, ভারতে এসে যার নাম হয়েছিল নিবেদিতা৷ ভক্তি শ্রদ্ধা এমন এক জিনিস যার প্রমাণ আলবার্ট হলে নিবেদিতার সেই কালীপূজা ও পশুবলি বিষয়ক বক্তৃতা। বিবেকানন্দের আদেশকে মনে প্রাণে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবেদিতা সেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যদিও এই বক্তৃতার সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের এই যুবতীর কর্মজীবনের কোনো মিল ছিলো না। নিবেদিতা ভালোবেসেছিল ভারতবর্ষের মানুষকে, ভারতে এসেছিল স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার ও মানবসেবার জন্য। স্বামী বিবেকানন্দের এতো জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও অবাক লেগেছিল আলবার্ট হলের সেই জনসভায় তৎকালীন মানুষের প্রতিবাদের স্পৃহা দেখে!
ধর্মীয় উন্মাদনা আর ধর্মের মূল বিষয়কে ছাড়িয়ে যে গোঁড়ামী তার বিপরীতে ছিল বিজ্ঞানচেতনা ও যুক্তিবাদ। এদেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রবর্তক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। উপন্যাসের আদর্শ এক চরিত্র অল্পতেই রগচটা এই ডাক্তার৷ উপন্যাসের মোটামুটি প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গেই তার যোগসূত্র। এই ডাক্তার এতোটাই ক্ষেপাটে যে স্বয়ং সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসের সামনে বসে দেবী কালীর সমালোচনা করেছেন৷ কিন্তু অদৃশ্য এক ভালোবাসার আকর্ষণে বারবার ছুটে গিয়েছেন এই কালীসাধকের কাছে৷ ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য পর্যন্ত শয্যাশায়ী অবস্থায় এই ডাক্তারের ধমক খেয়েছেন!
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর চরিত্রটি এমনভাবে উপন্যাসে এসেছে, প্রথমে আমি ঠিক বুঝতেই পারিনি ইনিই আমাদের সেই মহান বিজ্ঞানী। সাধারণ এক কলেজ শিক্ষক হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নিয়ে কলেজের সুবিধাবঞ্চিত ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানচর্চায় মেতেছিলেন। অকল্পনীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করছিলেন। তবে ত্রিপুরার রাজার কাছ থেকে সময়মতো আর্থিক সাহায্য না পেলে বিদেশে আত্নসম্মান রক্ষা করে নিজের কৃতিত্ব প্রমাণ করতে পারতেন কিনা তা বলা যায় না।
তৎকালীন নাট্যসমাজও এই উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য -প্রথম বাংলা পেশাদারী থিয়েটার মঞ্চ ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং উনিশ শতকের বাংলা মঞ্চের সবচেয়ে বেশি দর্শক মাতানো অভিনেত্রী বিনোদিনী। এদের সঙ্গে আরো কিছু নাম চলে আসে- তুখোড় নাট্য পরিচালক অর্ধেন্দুশেখর ও তরুণ দাপুটে অমরেন্দ্রনাথ যিনি একাধারে নাট্যকার ও অভিনেতা। বাংলা থিয়েটারের উত্থান-পতনের নাটকীয় সব কাহিনীর ধাক্কা সামলাতে হবে পাঠককে। থিয়েটারের ভেতরকার রাজনীতি, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্বার্থপরতা, লোভ আর ক্ষমতার দাপটে একের পর এক মঞ্চ পাল্টানো, দর্শকদের উন্মাদনা সব যেন চোখের সামনে ঘটছে।
লেখক উপন্যাসটিতে বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর প্রসঙ্গ এনেছেন স্বল্প পরিসরে। এই মহিয়সী নারী তখন তার মানবসেবা সাধনার প্রাথমিক পর্যায়ে। পাশে পেয়েছেন দেবতাতুল্য স্বামী দ্বারকানাথকে যার অবদানেই আজ তার নাম ইতিহাসে উচ্চারিত হয়।
স্বার্থ হাসিলের জন্য অখণ্ড বাংলাকে ভাঙ্গনের ছক কষেছিলেন অহংকারী ও সাম্রাজ্যবাদী বড়লাট লর্ড কার্জন। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাঙালির মনে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেওয়ার হীন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদেই বাঙালি প্রথম ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়তে উদ্বুদ্ধ হয়। অনেকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে থাকলেও মুষ্টিমেয় কয়েকজন, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল৷ সেসব ঘটনার ভেতরকার বিশদ খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। হিন্দু মুসলমান একত্রিত হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়টা যেনো চোখের সামনেই দেখছিলাম।
লেখক যেমন উনিশ-বিশ শতকের বিখ্যাত মানুষগুলোর যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি, আর উত্থান-পতনের গল্প বলেছেন, তেমনি মহাত্মা গান্ধীর মতো শান্তিপ্রিয় তরুণ আর ক্ষুদিরামের মত ১২ বছর বয়সের কিশোরের মধ্যেও কিভাবে দেশপ্রেমের বীজ বপন হচ্ছিল তার স্বরূপ দেখিয়েছেন। তাছাড়া উপন্যাসের শেষের দিকে টানটান উত্তেজনায় সশস্ত্র বিপ্লবেরও স্বাদ পাওয়া যায় একদল খেপাটে বিপ্লবীর মধ্য দিয়ে।
এত সব বাস্তব চরিত্র ছাড়াও লেখকের নিজ হাতে তৈরি কিছু চরিত্রের প্রেম, ভালোবাসা, জীবনের উত্থান-পতন আর দ্বন্দের কাহিনীগুলো অন্যান্য বইয়ের মতোই। অসাধারণ আর কৌশলী লেখনীতে এই চরিত্রগুলোও ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
বিশেষ করে ভরত আর ভুমিসুতার চরিত্র দুটি লেখকের অসাধারণ সৃষ্টি। অদৃশ্য এক বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়েছিল যদিও উপন্যাসের বেশিরভাগ অংশেই তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্নই ছিলো। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে করতে ভূমিসুতা যেভাবে নিজস্ব সত্ত্বা আর আত্নসম্মান বজায় রাখতে পেরেছিলো তা আশ্চর্যজনক। এই দুই যুবক-যুবতী বারবার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের স্বীকার হয়েছে। বিশেষ করে ভরত, যে জীবনের শুরু থেকেই ভাগ্য দ্বারা অত্যাচারিত নির্যাতিত হতে হতেই এগিয়ে চলেছে। আসলে বাঁচার প্রবল ইচ্ছা আর অস্বাভাবিক জীবনীশক্তিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল শেষ পর্যন্ত।
তাছাড়া তখনকার দেশীয় রাজাদের অবস্থা, তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তরুণদের নানান বিরোধ, তিনটি ব্রাক্ষ্ম সমাজের বর্ণনা, তাদের মূলনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া হিন্দু সমাজ, দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ রোগ সবকিছু সম্পর্কেই মোটামুটি আন্দাজ করা যাবে সুন্দর কিছু বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে। উপন্যাসের সাহসী নারী চরিত্রগুলো যুগে যুগে নারীজাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবে।
উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাংলার অজস্র ছোট-বড় ঐতিহাসিক চরিত্রের অন্দরমহলে প্রবেশের দরজা এই বই। এসব মহামানবদের নিজেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাত, আলাপচারিতাও ছিল! তাদের মধ্যকার সম্পর্কের অজানা অদ্ভুত সব তথ্য পাওয়া গেছে। ‘প্রথম আলো’ পুরোটা শেষ করে মনে হলো, চোখের সামনে একটা শতাব্দী দেখতে পেলাম। সাধারণ অর্থে আমরা যাদের মহামানব মনে করি তাদেরও ইহলৌকিক চাহিদা আছে, তারাও জীবনের চলার পথে ভুল করে কিন্তু তাতে তাদের অসাধারণত্ব ক্ষুণ্ণ হয় না।
ইতিহাসের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি আমার দূর্বলতা আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অদ্ভুত চমৎকার কায়দায় ইতিহাসকে উপন্যাসে ধারণ করেছেন। ইতিহাসতো যেকোনো উপায়ে জানার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু শুধু জানার জন্য জানা নয়, পাঠকের জন্য নিঃসন্দেহে একটি সুখপাঠ্য ঐতিহাসিক উপন্যাস এটি। কী করে, কোথা থেকে উপন্যাসের কোন অংশে ইতিহাসের বীজ বুনতে হয়, তা তিনি খুব কায়দা করে সাজিয়েছেন। যেন তিনি জানতেন বাঙালি পাঠক নিজের দেশের ইতিহাসকে পুনরাবিষ্কার করে কতটা পুলকিত ও সমৃদ্ধ হবে। সত্যিকার অর্থে ‘প্রথম আলো’ চিত্তাকর্ষক একটি উপন্যাস যা শুধু মনোরঞ্জনই করে না, জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন করে অনন্য এক পন্থায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
কুবি/মাহফুজ/মাহি
রাইজিংবিডি