ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৭ম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৪৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৭ম পর্ব

আজ অক্টোবরের ৮ তারিখ। মুহিত ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। কম্বলের উষ্ণতা থেকে বের হতে কষ্ট হচ্ছে। কম্বলের ভেতরেই কিছু সময় কাটিয়ে শরীরের অলসতা দূর করার চেষ্টা করছি। মুহিত ভাইকে আগে বাথরুমে যেতে বললাম, যেন এই সুযোগে আরো কিছুটা সময় কম্বলের উষ্ণতায় শুয়ে থাকতে পারি। এখান থেকে গোসল করার ঝামেলা আর নেই। কারণ বরফজমা ঠান্ডা পানি আর সকাল ও সন্ধ্যায় হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা।

কাঠমান্ডুতে গোসল করে এসেছি, আবার গোসল করা হবে সেই মাসখানেক পর। আমি জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। চোখ জুড়িয়ে এলো! আকাশ ছুঁয়ে সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের কারণে সূর্যের আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি। তবে আকাশে কোনো মেঘ নেই। পরিষ্কার নীল আকাশে তুলার মতো সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজ পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা একটুখানি পর্বতচূড়া দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলো সেই পর্বতচূড়াকে সোনালি আলোয় উজ্জ্বল করে রেখেছে।

কোটুতে বাড়ির আঙিনায় আপেল গাছ

চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা ছোট একটি গ্রাম কোটু। এর উচ্চতা ২ হাজার ৬২২ মিটার বা ৭ হাজার ৮৬৬ ফুট। মার্শিয়ান্দি নদীর পাশে পাহাড়ের গায়ে এই গ্রামের অবস্থান। তবে গ্রামটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড় এখানে প্রায়ই ধসে পড়ে। পৃথিবীখ্যাত অন্নপূর্ণা সার্কিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এই কোটু। এই গ্রামকে ‘মেঘেদের গ্রাম’ বললেও ভুল হবে না। এখানে বেশ কিছু ভালো লজ আছে ট্রেকারদের থাকার জন্য। হট শাওয়ার, আধুনিক পরিষ্কার টয়লেট, রুম হিটার অথবা ফায়ার প্লেস থেকে শুরু করে নানান সুবিধা রয়েছে, আর বিভিন্ন পদের মুখরোচক ইউরোপিয়ান এবং নেপালের স্থানীয় সুস্বাদু খাবার তো আছেই। যেহেতু অন্নপূর্ণা সার্কিটে প্রচুর পরিমাণে ট্রেকার আসে, তাই এখানে সব সময়ই ট্রেকারে ভরপুর থাকে। কেউ যদি পুরো অন্নপূর্ণা সার্কিট সম্পন্ন করতে চায় তাহলে তাকে দুইশ ত্রিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই কম-বেশি আপেল গাছ আছে। গাছগুলোতে আপেল ধরেছে। দেখতে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে বলে বোঝানো কঠিন। আমি আগে এতো আপেল গাছে ধরে থাকতে দেখিনি। গাছের সবুজ পাতার চেয়ে লাল আপেলই বেশি মনে হচ্ছে।

আজকেই আামদের ট্রেকিং শুরু এখান থেকে। তাই বেশি সময় নষ্ট না করে ডাইনিং রুমে চলে এলাম। আরো কয়েকজন ট্রেকার সকালের নাস্তা করছে। সবাই এই লজে উঠেছে। আমাদের টি-শার্টে বাংলাদেশের পতাকা আছে। সেটা দেখে কেউ একজন মুহিত ভাইকে জিজ্ঞেস করলো- আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি কি-না? আমি উল্টো দিকে মুখ করে বসা বলে দেখতে পেলাম না কে কথা বলছে। মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে লোকটির কথা হলো। লোকটি জানাল, তার একজন বন্ধু আছে বাংলাদেশে; নাম ইকরামুল। লোকটির গলার শব্দ আমার পরিচিত মনে হচ্ছিল। যখন আমার নাম বললো তখন আর মাথা না ঘুরিয়ে থাকতে পারলাম না। এতো দূরে এসেও বন্ধুর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। তাকিয়ে দেখি হার্শবর্ধন যশি। আমার বন্ধু। ছোটখাটো গড়নের আমার মতোই দেখতে হার্শ। আমরা একসঙ্গে ভারতের নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং (এনআইএম)-এ পর্বতারোহণের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সে মুম্বাই থাকে।

বন্ধু হার্শবর্ধন যোশির সঙ্গে

আমরা প্রশিক্ষণে একমাস কাটিয়েছিলাম একসঙ্গে। খুবই বন্ধুসুলভ সে। তাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছিলো তখন। আমরা একই তাবুতে ঘুমিয়েছি, একসঙ্গে খেয়েছি, প্রশিক্ষণে একে অপরকে সাহায্য করেছি। এতো দিন পর আজ তাকে পেয়ে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আমরা একসঙ্গে বসে গল্পে গল্পে সকালের নাস্তা শেষ করলাম। একটি আন্তর্জাতিক দলের সঙ্গে সেও এসেছে হিমলুং অভিযানে। এই অভিযান এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি। আজ তারা এখানেই থাকবে, কাল সকালে ট্রেকিং শুরু করবে। আর আমরা আজকেই ট্রেকিং শুরু করবো। তাই হার্শের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারলাম না। আমাদের আবার দেখা হবে হিমলুং বেসক্যাম্পে। সেখানে বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে হবে আমাদের।

সকাল নয়টার দিকে আমরা ট্রেকিং শুরু করলাম। আমাদের দুই ডাফল ব্যাগ নিয়ে পোর্টার আগেই বেরিয়ে গেছে। আমাদের আজকের গন্তব্য মেটা। কোটুর মেইন রোড চলে গেছে চামে হয়ে মানাং। আর আমরা কোটু থেকে ডান দিকে নার-ফু ভ্যালির পথ ধরবো। প্রথমেই চলে এলাম অন্নপূর্ণা কনজার্ভেশন এরিয়া প্রজেক্ট (Annapurna Conservation Area Project -ACAP) চেকপোস্টে। এই অন্নপূর্ণা কনজার্ভেশন এরিয়া প্রজেক্ট নেপালের ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর ন্যাচার কনজার্ভেশন (National Trust for Nature Conservation-NTNC)-এর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। চেকপোস্টে আমাদের এই অঞ্চলে অভিযানের অনুমতিপত্র দেখিয়ে এন্ট্রি করে নিলাম। অনুমতিপত্র এজেন্সি আগেই করে রেখেছিলো। ট্রেকিং করতেও অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় নির্দিষ্ট ফি দিয়ে। চেকপোস্টের ডান দিক দিয়ে খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এলাম। প্রথমেই মার্শিয়ান্দি নদীর উপরের বেশ লম্বা ঝুলন্ত ব্রিজ পার হলাম। এখানেই মার্শিয়ান্দিতে এসে মিলিত হয়েছে নারখোলা। নারখোলা হলো একটি ছোট নদী। নেপালে ছোট নদীকে ‘খোলা’ বলে। বড় নদীকে বলে ‘কোশি’।

মার্শিয়ান্দি নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ পাড় হচ্ছি

আমরা এখন নারখোলার পাড় ধরেই হেঁটে যাবো। এই পথটা এখনো ভীষণ বুনো রয়েছে। এর কারণ এখনো ট্রেকারদের ভিড় হয়নি এই ট্রেইলে। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত এই নার-ফু অঞ্চল পর্যটক বা ট্রেকারদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো। এই ট্রেইল খুলে দেওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ট্রেকারদের থাকার জন্য নতুন নতুন লজ হচ্ছে।

আমরা সবুজ পাইন বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি। পথেই দেখা হলো কয়েকজন ট্রেকারের সঙ্গে। আমরা যে লজে ছিলাম তারাও একই লজে ছিলেন। তাই তাদের সঙ্গে সকালে ডাইনিং রুমে কথা হয়েছিলো। তারা কিছুটা পথ হেঁটে হাইট গেইন করছে। তারা আজ কোটুতেই থাকবে। তারা আমাদের শুভকামনা জানিয়ে ফিরতি পথ ধরছে। আমরাও কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পানি ও চকোলেট খেয়ে আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। এই ট্রেইলটি যতটা সবুজ ততটাই ধূসর পাথুরে। পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট ফাটিয়ে কঠিন পাথর ভেঙে পথ বানানো হয়েছে। সেই কাজ এখনও চলছে। নারখোলার স্বচ্ছ বরফ শীতল পানির খরস্রোতের শব্দ আর সবুজের আড়াল থেকে ভেসে আসা পাখিদের গান মনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে। নানান রকমের নানান রঙের বুনো ফুল আর ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো রঙিন প্রজাপতিও যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আমাদের।

নারখোলা নদীর পাড় ধরেই আমাদের পথ

নারখোলার উপরে ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে দুপুর ১২টার দিকে চলে এলাম ছা ছা-২ (Cha Cha) নামক একটি ছোট গ্রামে। গ্রামে ঢোকার আগেই ছোট একটি রেস্টুরেন্ট ও লজ আছে। এখানেই আমাদের আজকের দুপুরের খাবার বিরতি দেওয়া হলো। রেস্টুরেন্টের নাম ‘ন্যাচারাল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড লজ’। এই লজে খাবার খেলে রাতে থাকা ফ্রি। এখানে তাবু করেও থাকার ব্যবস্থা আছে। যেহেতু এখানে আমরা থাকবো না, থাকবো মেটাতে, তাই ফ্রি থাকার সুযোগটা নিতে পারলাম না। খাবার শেষ করে সোয়া একটার দিকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে চলে এলাম ছা ছা-২ গ্রামে। ছোট্ট একটি গ্রাম। মাত্র কয়েকটি ঘর। একটি লজও আছে। ছোট দুইটি শিশু আমাদের এই গ্রামে অভ্যর্থনা জানালো তাদের মিষ্টি হাসি দিয়ে। এখানে আমরা না থেমে এগিয়ে চললাম। পেছনে বেশ কয়েকটি ভূমিধসের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা ফেলে এসেছি। পথের এক মোড়ে এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে মেঘ ফুঁড়ে ঝরনার পানি পড়ছে। আবার সেই ঝরনার ভেতর দিয়ে পাথর কেটে রাস্তা করা হয়েছে।(চলবে)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়