ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোক্তা ‘খাদিরাণী’ মুক্তা
তানজিন রোবায়েত রোহান || রাইজিংবিডি.কম
মুক্তা আক্তার, পড়ছেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বল্প সময়ে, অল্প মূলধনে ও অল্প দিনের মধ্যেই যেভাবে একজন সফল ও সার্থক উদ্যোক্তা হলেন, জীবনের সেই গল্প বলেছেন রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা পাতার লেখক তানজিন রোবায়েত রোহানের কাছে।
মুক্তা যখন ৫ম শ্রেণিতে পড়তেন, সেই সময় তিনি বাবাকে হারান। তখনো তেমন করে বোঝা হয়ে ওঠেনি এই ধরণীকে। যতই বড় হচ্ছেন, ততই বুঝছেন বাবা হারানোর পর কী কষ্ট করতে হয়, জীবনে চলার পথে কত বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর চার ভাই, তিন বোনের বিশাল সংসার আগলে রেখেছেন মা রৌশনআরা খন্দকার।
মুক্তার জন্ম সীমান্তবর্তী কুমিল্লার বিবির বাজারের গাজীপুর গ্রামে। বাবারও স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা হবে। আর বাবার এই স্বপ্নকে বুকে আগলে নিজেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেন একজন উদ্যোক্তা হবেন। আটঘাট বেঁধেই নেমে পড়েন। উদ্যোক্তা হতে ক্লাস করেন উইতে। একমাস ট্রেনিংয়ের পর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেই নতুন কিছু করবেন বলে চিন্তা করলেন। কিন্তু এই সমাজে নারীদের বাঁধা-বিপত্তির শেষ নেই।
গ্রামের কত লোকই কত কথা বলতে শুরু করল যে, মেয়ে হয়ে ব্যবসা করবে! এসব তুছ্য-তাচ্ছিল্যকে তোয়াক্কা না করে ভাঙা মনে ভাঙা স্বপ্ন জোড়া দেওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের পথচলা শুরু করেন।
পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু কী ব্যবসা করবেন, তা ভাবতে পারছিলেন না। একদিন নিজেই চিন্তা করলেন খাদি কাপড়ের বিজনেস করলে কেমন হয়? কুমিল্লা জেলার মেয়ে মুক্তা। তাই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়কেই ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। পরে তিনি ফেসবুক ভিত্তিক একটি অনলাইন পেজ খুলে ফেলেন আর তার নাম দেন ‘খাদি রাণী’। আর খাদি কাপড় সূক্ষ্ম ছিদ্র যুক্ত মিহি সুতা ও তুলার বুননে তৈরি, ১০০ ভাগ পরিবেশবান্ধব, কোমল মোলায়েম, পরতে আরাম। ক্রেতার চাহিদার কথা চিন্তা করেই মুক্তা সব প্রকার খাদি কাপড়ের বিজনেস করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
২০২০ সালের ৫ মার্চ নিজের টিউশনের ২৩৭০ টাকা দিয়ে অনলাইনে খাদি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। অল্প দিনেই দারুণ সাড়া পেয়ে ৪-৫ লাখ টাকার প্রোডাক্ট সেল করেন। এখন পর্যন্ত মোট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ টাকার উপরে। তার এই অভাবনীয় সফলতা দেখে তার পরিবারের যেমন সমর্থন পাচ্ছেন, তেমনি লোকজনের প্রশংসায়ও ভাসছেন। তার অর্জিত অর্থ এখন কাজে লাগছে পরিবারের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তিনি মনে করেন এ থেকে শান্তির বিষয় আর হতে পারে না?
মুক্তা আক্তার বলেন, ‘‘টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ বহন করতাম। সেই টিউশনের টাকাকে পুঁজি হিসেবে কাজে লাগিয়েছি। শুরুতে আমার পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করতে হয়েছে অনলাইনে। এরপর যখন বিক্রি বাড়তে থাকলো; তখন পরিবার আমাকে সাপোর্ট দেওয়া শুরু করলো।
তবে এ ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে ফেসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স গ্রুপ। গ্রুপটি আমাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তুলেছে। সেই কারণেই আজ সবাই ‘খাদি রাণী’ বলেই চেনে। ’’
খাদি নিয়ে কেন কাজ শুরু করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তা বলেন, ‘খাদি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আমাদের কুমিল্লার ঐতিহ্য এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে পারেন না তাঁতিরা। অনেকে কাজও বন্ধ করে দিয়েছেন। যদি এমন হতে থাকে, তাহলে অচিরেই খাদি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই কুমিল্লার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমার এ উদ্যোগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদি নিয়ে কাজ করার জন্য প্রথমে কুমিল্লার তাঁতিদের সাথে কথা বলি। তাদের কারখানায় যাই। গিয়ে খুব হতাশ হই। খুব অল্প সংখ্যক তাঁতি কাজ করছেন। অনেকে বলেছেন, আপনারা কাজ দিলে করতে পারবো। কিন্তু তখনো আমি নতুন। বুঝতে পারছিলাম না যে, কী করবো। তবুও সাহস নিয়ে কাজ শুরু করলাম।’
তিনি মনে করেন, খাদি নিয়ে কাজ করলে অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতির স্বাধীনতা দিতে পারে। আর খাদি কাপড় শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এ কাপড় তুলার তৈরি ও সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত। তাই খাদি কাপড় স্বাস্থ্যকর, টেকসই।’
মুক্তা বলেন, ‘খাদি কাপড় গরমে ঠান্ডা ও শীতে উষ্ম অনুভূতি দেয়। সর্বোপরি এটি বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে। আমি খাদি নিয়ে কাজ করার পর কুমিল্লা থেকে মিনিমাম ৫০ জন উদ্যোক্তা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে খাদি নিয়ে কাজ করছেন। আমিও কিছু নবীন ঊদ্যোক্তাকে নানা ধরনের সহযোগিতা করছি, কীভাবে কাজ করতে হবে ও সফলতা অর্জনের নানা কৌশল রপ্ত করার টিপস্ দিচ্ছ। ফলে কুমিল্লার খাদি তাঁতিরা অনেকে এগিয়ে এসেছেন।’
খাদি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, খাদিতে বিভিন্ন ধরনের ফিউশন আনা। শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, কুর্তিসহ অনেক আইটেম নিয়ে কাজ করা। মেয়ে ছাড়াও ছেলেদের সার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা, ট্রাউজার ইত্যাদি নিয়ে আরও সফলভাবে কাজ করতে চাই যদিও আমি এখন থেকেই এসব নিয়ে কাজ করছি ও আমার ফ্যাশন হাউজে খাঁদির এসব মালামাল ছাড়াও আরও অনেক দেশীয় পণ্য পাওয়া যায় চাহিদার উপর। সফলতার একটাই সূত্র, লক্ষ্য ঠিক করে লেগে থাকা আর পরিশ্রম করা। আর আমার একটি স্বপ্ন শো-রুম করে কাজ করা।’
খাদি নিয়ে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নেওয়াটাই এ উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন কুমিল্লার ‘খাদি রাণী’ খ্যাত নারী মুক্তা আক্তার।
নবীন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে আপনা কী পরামর্শ থাকবে, এমন প্রশ্ন করায় মুক্তা আক্তার বলেন, ‘‘আমি নিজেও একজন নবীন উদ্যোক্তা। তবে আমার স্বল্প সময়ের এই সফলতায় আমি সন্তুষ্ট। তবে নতুনদের জন্য প্রথমে আমার শুভেচ্ছা থাকবে। আমি মনে করি, উদ্যোক্তা হয়ে সফলতা পেতে কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন যেটা আমাকেও করতে হয়েছে। আর নবীনরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের ঐতিহ্যগত প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে, তাহলে একদিকে যেমন ঐতিহ্য টিকে থাকবে, অন্যদিকে আয়ও হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
কুমিল্লা/মাহি
আরো পড়ুন