ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ফারুক হোসেনের কোন সত্তা বড়?

মোহিত কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ১ জানুয়ারি ২০২১  
ফারুক হোসেনের কোন সত্তা বড়?

ফারুক হোসেনের কোন পরিচয় আমার কাছে বড়?

আমাকে প্রশ্ন করলাম আমিই। থমকে গেলাম। বড় আর ছোটর পরিমাপ করা কঠিন। তবু ভাবার প্রয়োজন হলো না, মাপজোকেরও না। চোখের সামনে সাজানো সেলফে শোভা পাচ্ছে ঢাউস সাইজের ছড়াগ্রন্থ- ৮০০ ছড়া/ফারুক হোসেন। অনন্যা প্রকাশনীর এই অসাধারণ প্রোডাকশনটা হাতে নিলেই মুগ্ধ হতে হয়। খোলা চোখে দেখেও প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

এছাড়াও আমার শেলফে শোভা পাচ্ছে কাচ পাহাড়ের রাজকন্যা, ছোটো ছোটো ছড়া, দেশে দেশে ঘুড়ি, বিশ্ব দেখি ছড়ার ছন্দে। আরও আছে মহাকাশে বাংলাদেশ, আছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি, এবং শোভাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ফারুক হোসেনের গল্পগ্রন্থ কিশোর গল্পসমগ্র (২০১১)। নিশ্চয়ই ফারুক হোসেনের আরো অনেক বই আছে-অর্ধশতেরও বেশি।

আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে তাঁর লেখালেখির শুরু। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে, ছড়ার বই লুটোপুটি। অর্থাৎ তাঁর ছড়াসত্তাটাই বেশি উজ্জ্বল। শিশুসাহিত্যের বুনিয়াদের মধ্যেও গেড়ে বসে গেছে ছড়াসত্তার গভীর খুঁটি। বাংলা সাহিত্যে ছড়াকার হিসেবেই তাঁর খ্যাতি ঈর্ষণীয়। তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন ছড়া-পাহাড়ের শীর্ষদেশ। কিন্তু ছড়ার পাশাপাশি তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনি। সে-কথা ভুলে গেলে চলবে না। আর এসব গুণের প্রমাণ পাচ্ছি আমার পড়ার ঘরে বসে। অর্থাৎ বহুমাত্রিক লেখা উপহার দিয়ে তিনি শিশুদের মন জয় করেছেন, করেই চলেছেন।

এই অগ্রযাত্রায় আমি বিস্ময়করভাবে লক্ষ করি গল্পকথনে ফারুক হোসেনের পরম পারঙ্গমতা। একজন ‘গ্রেট স্টোরি টেলার’ বা বড়মাপের গল্পকথকের যেসব গুণ থাকার কথা তার সবটাই আছে ফারুক হোসেনের। তা প্রমাণ করে দিয়েছে তাঁর শক্তিমান কলম। কিশোর গল্পসমগ্র’র প্রায় প্রতিটি গল্প তার সাক্ষ্য বহন করছে। বিয়াল্লিশটি গল্পের সরব শব্দজোয়ারের মধ্যে শিশুরা দেখার সুযোগ পাবে তাদের মন জাগানিয়া নানা বিষয়-আশয়। এ বই পাঠে তারা কেবল আনন্দময় কৌতূহল, রহস্য, রোমাঞ্চকর অনুভূতি কিংবা দুঃখ-বেদনার মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটবে না, একই সঙ্গে তাদের মনস্তত্ত্বে জুড়ে বসবে নৈতিকতার শিক্ষা, সততার শিক্ষা, অন্যের ক্ষতি না-করার শিক্ষা, পরোপকারের শিক্ষা, পাখি বদ না-করে মায়াবি ডাকে জেগে ওঠার শিক্ষা।

২.
রূপকথার গল্প ‘রস গাছ’। গল্পসমগ্র’র প্রথম গল্প। দেশের রাজা ঘুরে ঘুরে রাজ্য দেখবেন। প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখবেন। খেত-খামারে কী ফসল হচ্ছে, কী চাষ হচ্ছে তা সরেজমিনে দেখতে চান তিনি। দেখতে চান ধানের গাছের দোলা, কোকিলের গান, নদীর বুকে পাল তুলে নৌকার বয়ে চলা, কৃষকের আনন্দ-বেদনার দিনযাপন, হাসিমুখ। সব নিজ চোখে দেখার ইচ্ছায় ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন।

নদী পার হয়ে রাজা হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর হয়ে গেল। রাজার মাথায় প্রখর সূর্যের তাপের ছাট লাগতে শুরু করল। এ জীবনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। রোদে পুড়ে, ঘেমে-নেয়ে ক্লান্ত আর তৃষ্ণার্ত হয়ে তিনি বসে পড়লেন মাঠের আইলের ওপর। পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অনুচররা পানি খুঁজতে লাগল। আর এই ফাঁকে রাজা দেখতে লাগলেন, লেখকের ভাষায় : ‘চারিদিকে গমগম নীরবতা দুপুরের। পাখ- পাখালি গাছ-গাছালির আগডালে বসে দুপুরের স্লোগান দিচ্ছে। মৃদু বাতাস বইছে ফসলের গা ছুঁয়ে। নড়ে উঠছে ধানের শীষ, কাউনের ছড়া, তিসির ছড়া, সর্ষে ফুল। তারই মনোরম পরিবেশ দেখতে দেখতে আইলের ওপর রাজা পা ছড়িয়ে বসেন। কার্পেটের মতন নরম নরম দুর্বাঘাস, দারুণ তুলতুলে। প্রথম অনুচর রাজাকে দেখিয়ে দিচ্ছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির সবকিছু। রাজা চমকে ওঠেন, হাসেন মাঝে মাঝে। অনুচর আঙুল উঁচু করে রস গাছের দিকে। এই গাছের সারা শরীর রসে ভর্তি জাঁহাপনা। খেলে হৃদয় জুড়িয়ে যাবে। গ্রাম ছেড়ে আর রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতে ইচ্ছা করবে না।’

এ পরিবেশ-প্রকৃতি বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই লেখকের শাণিত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তা তিনি অক্ষরস্রোতে ভাসিয়ে দিতে পেরেছেন অনন্য দক্ষতায়। এ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা একজন সাহিত্যিকের গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক-সৃজনশীল শক্তি। ফারুক হোসেনের সেই শক্তি ভাসমান শব্দরথের মধ্যে খোলা চোখে দেখা যায়। স্পষ্ট আসন গেড়ে তা বসে আছে উজ্জ্বল বাতিরূপে।

রস গাছের রস খেয়ে রাজা মুগ্ধ হন। আর মনে মনে ভাবেন প্রজাদের ওপর খাজনা বাড়িয়ে দেবেন। এ ভাবনার ফলে রস গাছের রস শুকিয়ে যায়। কাহিনির শেষপ্রান্তে এসে রাজার বোধোদয় হয়। ‘রাজা চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। স্রষ্টার কাছে মাফ চাইলেন দুই হাত তুলে। প্রজাদের খাজনা করে দিলেন মাফ। প্রজাদের কাছেও ক্ষমা চাইলেন।’ এবং বুড়ো চাষা যে তাঁকে গাছের রস খাইয়েছিল তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রস গাছের রস ফিরে এলো ঠিক, তবে আগের মতো কেটে দিলে গ্লাসভর্তি রস বের হয় না। রূপকথার এ কাহিনি ক্ষমতাধরদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক ও দরদী মন তৈরি করার গল্প, কিশোর পাঠকদের জাগিয়ে তুলবে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস রোপন করে দেবে মনে করি আমি।

৩.
কিশোর উপযোগী আরেকটা অসাধারণ গল্প ‘দীঘির পাড়ে’। কিশোর মনের রোমাঞ্চ সন্ধানী কৌতূহলের শেষ উল্লাসের পরিণতিতে ঘটেও যেতে পারে মানবিক বিপর্যয়, ধ্বংস, নিষ্ঠুরতা কিংবা হিংস্রতা। এসব বিষয়ে কিশোরদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে তারা উল্লাস করতে গিয়ে ভুল করে। এ গল্প এই ধরনের কিশোরদের মনোজগতে বিপুল এবং বিস্ময়কর নাড়া দিয়ে তাদের বোধ চমৎকারভাবে পালটে দেবে, আমার বিশ্বাস।

পৈক বা পাখি শিকার করতে গিয়ে মা-পাখির তার ছানা-পাখি আগলে রাখার জীবনপ্রবৃত্তির তাড়না দেখে রহস্যময় দ্বার খুলে যায় পাখি শিকারি ফলু এবং বিলুর চোখে। পাখি শিকারের আগ মুহূর্তে তারা শুনতে পায় পাশের বাড়ির এক শিশু সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। লাশ সামনে রেখে মা কাঁদছে। মায়ের কষ্ট, কান্না বিলু আর ফুলুর মনে কষ্ট জাগিয়ে তোলে। তারা মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। পৈক মারার হরডার সিক, ফলা মা পাখির দিকে না ছুড়ে ফেরত আসে।

কেবল কাহিনি পরিবেশনে মুন্সিয়ানা দেখাননি ফারুক হোসেন। তাঁর লেখার মধ্যে সাহিত্য-শস্যকনাও পরিবেশিত হয়েছে নান্দনিকভাবে: ‘ওই বিলু শোন, তোর মন ভইরা যাইব, কত্তো পৈক। কোয়াল, ডাউক, শালিক, বক। আঁধার চাইপা আইলে কালি বক লম্বা হইয়া শুইয়া থাকে ডালের চিপার মধ্যে। কি সুযোগ, হরডা ঠেলা দিলেই গাউত্তা যাইব। মজা কইরা গোশ্ত খাইতে পারবি।’

এতটুক লিখে নিজেকে প্রশ্ন করলাম ফারুক হোসেনের কোন সত্তা বড়? ছড়াকার, গল্পকার নাকি ব্যক্তি ফারুক? 
জটিল অঙ্কের সমাধান আমার কাছে নেই। সহজ সমাধান খুঁজে নিলাম: তিন সত্তাই আমার প্রিয়। একের মধ্যে তিন জনই বড়।

এই অনুজ শিশুসাহিত্যিকের জন্মদিনে জানাই শুভ কামনা, ভালোবাসা।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়