যেখানে রোগী, সেখানেই দালাল
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দালাল ও বহিরাগতদের দাপটে সাধারণ রোগী অসহায়।বছরের পর বছর ধরে চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য। এদিকে পঙ্গু হাসপাতাল ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। ভুক্তভোগীরা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, এটা একটা বিরাট সিন্ডিকেট। তবে আগের চেয়ে কমেছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঢামেকের জরুরি বিভাগ, বিভিন্ন ওয়ার্ড, সিটিস্ক্যান, এমআরআই এবং এক্সরেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা কক্ষের সামনে হাসপাতালের কর্মচারী নন- এমন বিভিন্ন শ্রেণির দালাল ঘোরাঘুরি করছেন।এদের কেউ কেউ নিজেদের হাসপাতালের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেন। ‘মিলন’ নামে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের।পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মিলন, এখানকার স্টাফ।’ কোন বিভাগের জানতে চাইলে বলেন, ‘মর্গের স্টাফ। মর্গের হলে ইমার্জেন্সিতে কী করছেন- প্রতিবেদকের এই প্রশ্নে মিলন দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়েন। মিলনের মতো অনেকে স্টাফ পরিচয়ের পাশাপাশি কেউ কেউ নিজেদের বিভিন্ন চিকিৎসকদের সহকারী পরিচয় দেন।
জরুরি বিভাগের ঠিক সামনে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন এক যুবক। কৌতূহল নিয়ে ওদের কাছাকাছি যান এই প্রতিবেদক। ওরা নোয়াখালীর চাটখিলে যাবেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছে ৬ হাজার টাকায়। কথা ছিল এসি থাকবে। অ্যাম্বুলেন্সের লোক বলছেন, এসি নষ্ট। যুবককে ৭-৮ জন মিলে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার জন্য চাপ দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে যুবক তার বাবাকে স্ট্রেচার থেকে ‘নন এসি’ অ্যাম্বুলেসে উঠালেন।
আরেকটি স্ট্রেচার বেরিয়ে আসলো জরুরি বিভাগের গেট দিয়ে। পাশেই ২৫-২৬ বছরের এক যুবক। তার নাম সোহাগ। তিনি বাবাকে নিয়ে বাড়ি (নরসিংদী) চলে যাচ্ছেন। গত ২৭ দিন ধরে তার বাবাকে (আব্দুর রহিম, ৬২) হাসপাতালে ভর্তি রেখেছিলেন। প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচও করেছেন। কিন্তু অপারেশন করা সম্ভব হয়নি।
সোহাগ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের ৬ তারিখে অপারেশন করানোর কথা বলে কেবিনে ভর্তির জন্য আমার কাছ থেকে ‘লুৎফর’ নামের এক ওয়ার্ডবয় মোট সাড়ে ৩ হাজার টাকা নেন। অথচ রশিদ দিয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকার। বাকি দুই হাজার টাকার রশিদ দেয়নি। এরপর ডাক্তার অপারেশনের আগে বিভিন্ন টেস্ট করতে বলেন। সেসব টেস্ট এই হাসপাতালে নাকি করানোর ব্যবস্থা নাই। বাইরে থেকে করার কথা বলেন ডাক্তার। তারপর টেস্টের কাগজ আমার হাতে না দিয়ে ‘আলতাফ’ নামের একজনকে দেয়। সেই আলতাফ বাবার অপারেশনের জন্য বিভিন্ন ওষুধ কেনার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা নেন। এরপর আলতাফের সঙ্গে ‘রফিক’ নামের আরেকজন এসে বলেন, অপারেশনের জন্য যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ৪ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে।’ আমি টাকা দিতে রাজি হই। কিন্তু রসিদ দিতে বললে রফিক বলেন, ‘আপনার বাবার অপারেশন হলেই তো হবে, রসিদ দিয়ে কী করবেন?’ রসিদ ছাড়া আমি তাকে টাকা দেইনি। তখন রফিক বলেন, ‘তোমার বাবার অপারেশন কোন ডাক্তার করে আমি দেখবো...।’ এরপর আর বাবার অপারেশন হয়নি।
জানা গেছে, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট, হাসপাতালে ভর্তি, বেড বা কেবিন পাওয়া, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এসব বিষয়ে রোগী বা রোগীর স্বজনদের দালাল খুঁজতে হয় না। দালালরাই রোগীদের পাশে এসে দাঁড়ায়। পুরো হাসপাতালজুড়ে রয়েছ এদের অবাধ বিচরণ। হাসপাতালের তিনটি পার্কিং এলাকায় অসংখ্য বেসরকারি কোম্পানির অ্যাম্বুলেন্স রাখা। জরুরি বিভাগের সামনের ছাউনিতে দুটি মাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দেখা গেছে। ছাউনির পশ্চিম পাশে খোলা জায়গায় প্রায় ১০টি অ্যাম্বুলেন্স। ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবনের সামনে এবং পূর্ব পাশে সারি করে রাখা আছে ১২টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। এসব পার্কিংয়ে গাড়ি রাখতে হলে প্রথম ৩ ঘণ্টার জন্য ৪০ টাকা ও পরবর্তী প্রতি ঘণ্টার জন্য ১০টাকা হারে দিতে হয়। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে প্রথম ৩ ঘণ্টার জন্য ৭০টাকা নেওয়া হয়। পরের সময়ের জন্য ওরা কোনো টাকা দেয় না বলে জানান লিজ নেওয়া পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা নজরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, ‘হাসপাতালের নির্দিষ্ট পার্কিং এলাকাগুলোর বাইরের চত্বর খালি থাকার কথা। অথচ টাকা নিয়ে এসব এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং করতে দিচ্ছে লিজ নেওয়া কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বলে তেমন লাভও নেই। এরা সবাই মিলে একটা বিরাট সিন্ডিকেট হিসাবে কাজ করছে।’
নাজমুল হক বলেন, ‘বাইরের লোক আর ভেতরের লোক মিলে এই চক্রটি অত্যন্ত সক্রিয়। এই সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। এদের ধরার চেষ্টা চলছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দালালদের ঠেকানোর জন্য কয়েকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবারও তাদের এই বিষয়ে চিঠি দেওয়া হবে। আর পার্কিংয়ের বাইরে যে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকে, সেটা আমার জানা ছিল না। এখন জানলাম। এই ব্যাপারে আলাদা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হবে। ’
সরেজমিনে পঙ্গু হাসপাতাল
৬ জানুয়ারি পঙ্গু হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে রোগীর স্বজন, ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী, দালালসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো হাসপাতালজুড়ে রয়েছে দালালদের অবাধ বিচরণ।
দেখা গেছে, হাসপাতালে ঢোকার পথেই হাতের ডানের লনে দুজন ব্যক্তি এক রোগীর পায়ের পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছেন। ব্যান্ডেজ করা শেষ করে তারা চলে যাওয়ার পর, বাইরে ব্যান্ডেজ বাঁধা সম্পর্কে রোগীর কাছ থেকে জানা গেছে, জরুরি বিভাগ থেকে এই দুজনের কাছে তাকে পাঠানো হয়েছে। ব্যান্ডেজের সবকিছু রোগী কিনে দেওয়ার পরও এই দুজনকে (দালাল) দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। অথচ জরুরি বিভাগে বিনা খরচে এই ব্যান্ডেজ পাল্টানো যেত।
দালালদের দৌরাত্ম্য কমছেই না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘দালাল আছে সত্য। শুধু এই হাসপাতালে না, সব সরকারি হাসপাতালেই আছে। দালাল ঠেকানোর চেষ্টা করছি। আনসার রেখেছি। এটা একটা বিরাট সিন্ডিকেট। তবে আগের চেয়ে কমেছে। মাঝে-মধ্যে অভিযান চালানো হয়।
এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন বলেন, ‘মাঝে-মাঝেই এসব দালালদের ধরার জন্য পুলিশ অভিযান চালায়। তারপরও এদের ঠেকানো যাচ্ছে না। দালালদের ঠেকানোর জন্য কয়েকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবারও তাদের এই বিষয়ে চিঠি দেওয়া হবে।'
মেসবাহ/সাইফ
আরো পড়ুন