ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-৩)

মোহাম্মদ তৌহিদ, চীন থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ১৮ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৫:০৪, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-৩)

স্বর্গমন্দির, বেইজিং (ছবি: ইন্টারনেট)

স্বর্গমন্দির বা টেম্পল অফ হেভেন: পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বেইজিংয়ে তৈরি করা হয় স্বর্গমন্দির। চীনা ভাষায় এই মন্দিরকে বলা হয় থিয়েন থান। ইংরেজিতে Temple of Heaven। 

চারদিকে বাগানবেস্টিত স্বর্গমন্দিরের বিভিন্ন ভবন তৈরির প্রধান উপাদান ছিল পাইন কাঠ। জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বর্গমন্দির সম্পর্কে বলেছেন, ‘এর সামগ্রিক নির্মাণকৌশল এবং বৈশিষ্ট্যময় আলাদা ভবনগুলো পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যে সম্পর্ক প্রকাশ করে। মানবজগত ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কের ধারণা প্রতিফলিত করে।’ ১৯৯৮ সালে স্বর্গমন্দির ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। 

রাজধানীর কেন্দ্রে তোংছেং জেলায় স্বর্গমন্দির অবস্থিত। মোট ২৭.৩ লাখ বর্গমিটার বা ২৭৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে বেইজিংয়ের স্বর্গমন্দির। সে হিসেবে এটি নিষিদ্ধ নগরী বা ফরবিডেন সিটির চেয়ে দুই গুণ বড়। প্রাচীনকালে স্বর্গপূজার যতগুলো স্থাপনা ছিল, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় থিয়েন থান বা স্বর্গমন্দির। 

স্বর্গমন্দিরের নির্মাণশৈলী থেকে তৎকালীন মানুষ ও সম্রাটদের চিন্তাধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন চীনের মানুষ স্বর্গ ও ভূমিকে অনেক শ্রদ্ধা করত। সে সময়ের চীনা সম্রাটরা নিজেদের ‘থিয়েন যি’ বা ‘স্বর্গের সন্তান’ বলে দাবি করতেন। সম্রাটরা মনে করতেন, তাদের অধিকার ও ক্ষমতা সবই স্বর্গ থেকে প্রাপ্ত। আর এখান থেকেই ‘স্বর্গপূজার’ ধারণাটি আসে। 

বেইজিংয়ের স্বর্গমন্দির চীনের মিং ও ছিং—এ দুই রাজবংশের স্বর্গপূজার স্থান। তৎকালীন বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর চেয়ে আকাশের মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। এ মন্দির নির্মাণে ‘আকাশের’ সুউচ্চ মর্যাদা তুলে ধরার জন্য বিশেষ গঠনশৈলীর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাগানের মধ্যে তৈরি এই মন্দিরের ভেতরে গোলাকার এবং চারদিকে বর্গাকার দেয়াল। তা ছাড়া, উত্তর মন্দির অংশটি গোলাকার এবং দক্ষিণের মন্দিরটি বর্গাকার; যা ‘পৃথিবী ও স্বর্গের’ প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী স্বর্গ গোলাকার এবং পৃথিবী বর্গাকৃতির। এমন চিন্তাধারার ভিত্তিতেই স্বর্গমন্দির তৈরি করা হয়েছে। স্বর্গমন্দিরের সুন্দর গঠন ও নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করে মানুষকে।

মিং সম্রাট ইয়োং ল্যে তার ১৮তম শাসনবর্ষে অর্থাৎ ১৪২০ সালে প্রথম এই মন্দিরের নির্মাণকাজে হাত দেন। মিং রাজা চিয়াচিং এবং ছিং রাজা ছিয়েন লোং পরবর্তীতে এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। 

বর্তমানে এটি কোনো উপাসনার স্থান নয়, বরং আকর্ষণীয় উদ্যান ও মন্দির। ১৯১৮ সালে স্বর্গমন্দির এলাকাকে একটি উদ্যানে রূপান্তর করা হয়। এরপর থেকেই মূলত দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক এই নিদর্শনটি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়।

স্বর্গমন্দিরে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রাচীন ভবনে মোট কক্ষ ছয় শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভবনগুলো হলো- প্রার্থনা কক্ষ, হুয়াং ইয়ুইয়ু, ছিউছিউ, জাই প্যালেস, প্রার্থনা দরজা, প্রাচীন দুয়ার, গোলাকার বেদি, স্বর্গীয় সংগীত ভবন ইত্যাদি। রয়েছে ‘প্রতিধ্বনি দেয়াল’ যা স্বর্গমন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ। বৃত্তাকার এই প্রতিধ্বনি দেয়ালটি ৬৫১ মিটার দীর্ঘ ও ৩.৭২ মিটার উঁচু।

বর্তমানে স্বর্গমন্দিরকে ঘিরে চারদিকে সবুজ অরণ্য তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয়রা স্বল্প খরচে এ উদ্যানে প্রতিদিন শরীরচর্চা ও ভ্রমণ করে থাকেন। কয়েক লাখ বড় গাছ ও বিভিন্ন ধরনের ফুলের বাগান রয়েছে উদ্যানে। শীতের পত্রঝরা দিন শেষে এ উদ্যানে ফুল ও সবুজের সমারোহ দেখা যায়। স্বর্গমন্দিরের পাশাপাশি এর ঘন উদ্যান এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। ৫০০ থেকে ৭০০ বছর বয়সী বেশকিছু প্রাচীন বৃক্ষ রয়েছে এখানে! বেইজিংয়ের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, সাবওয়ে বা ট্যাক্সিতে খুব সহজেই স্বর্গমন্দির বা টেম্পল অফ হেভেনে যাওয়া যায়।  

বেইজিংয়ের স্বর্গমন্দির দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস, গণিতবিদ্যা, বলবিদ্যা, সৌন্দর্যবিজ্ঞান ও বাস্তবিদ্যার সমন্বয়ে নির্মিত প্রাচীনকালের অন্যতম এক নিদর্শন। স্বর্গমন্দির একাধারে মহানগরী বেইজিংয়ের প্রতীক; আধুনিক ও প্রাচীন নিমার্ণশৈলী এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের চেতনার প্রতীক।

লেখক:  বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।

আরও পড়ুন

বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-২)

বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-১)


 

ঢাকা/সাইফ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়