ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৪তম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৬:৪৬, ১১ জানুয়ারি ২০২৩
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৪তম পর্ব

পাঁচ মাস ধরে একই নিয়ম: স্কুলের কাছে দেখা-সাক্ষাত, যাতে সবাই দেখতে পায়, শহরতলীতে হেঁটে যাওয়া, সেন্ট্রাল বারের জুকবক্স, ‘অনলি ইউ’ কিংবা ‘লে অঁগনন’ গান শোনা আর তারপর সেই ছোট্ট পথ ধরে হেঁটে চলা। আমরা সব কিছুই করেছিলাম, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা তখনও হওয়া বাকী, অন্তত আমি তাই ভাবছিলাম। সতের বছর বয়সে সামনে দেখার মতো কিছু রেখে যাওয়া উচিত, প্রায়শই আমার মনে পড়ে ‘ডেলি’ কিংবা ‘ব্রিজেট কামস এইজ’ বই দুটোর কথা, ‘যাকে সত্যিকারের ভালোবাসো তার জন্য কিছু সংরক্ষণ করো... আমি চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম, অন্য মেয়েরা কি আমার মতো, তারা বলে ওরা পার্টিতে পটানোর চেষ্টা করে, তারা কতোদূর আগায়?

ডেটি একজন ওয়েল্ডারের সাথে ডেটিং করছে, অতএব ওরটা আমার মতো না। দুপুরের পাঠের শেষে, আমি আমার হাতের আড়ালে মুখ লুকাই আর অনির্দিষ্ট অপেক্ষার সাম্প্রতিক স্মৃতি হাতড়াই, লাগার্ড কিংবা মিকার্ড থেকে বহুদূরে। শব্দরা ঝাপসা, ভারী ও অন্ধকারগ্রস্থ, বিড়বিড় করে, অর্ধেক পথেই মৃত পড়ে থাকে। আমি নিজেকে ঝাকিয়ে এর বাইরে নিতে চাই, কিন্তু কোন উপায় নাই। আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারি না। একে অপরকে ছুঁয়ে দিচ্ছি, মুখ একত্রে, চুল, আঠালো, দেহে শিহরণ, যা আমি ধারণ করি তার আকৃতি... ‘জুলসের তত্ত্ব! প্রিয় লেস্যু!’ কামুক স্বপ্নের নীরব সুখ ভেঙে জেগে উঠি একজন বুড়ো শুষ্ক শিক্ষকের ডাকে, যার মধ্যে এ সবের কোনো ধারণাই নেই। আমি লজ্জিত নই, আমি আমার মুখ নিয়ে গর্বিত, আমার নিতম্ব, আমার নিজস্ব আনন্দ। অন্য কাউকে জানা, তার নিচু দাঁত, মসৃণ কানের লতি, উষ্ণ লুকায়িত জীব যা বেরিয়ে আসে কুকুরের মুখের মতো তার জন্য আমি লজ্জিত নই। পাঁচ মাস, একটা উদঘাটন, জীবন হয়ে ওঠে মাংস আর ঝাঁঝালো গন্ধের এক দীর্ঘ স্বপ্নের মতো।

সেটা ছিল বসন্তের শুরু। চ্যাপটা ঘাস পথের ধারে, ধুলায় শনিবারের জ্বরাগ্রস্থতার মতো ঢেকে দিয়েছে গাড়ির তেলের গন্ধ, আমার আঙুলে রয়ে গেছে আঠালো চিহ্ন, আমি সবসময় চোখ বন্ধ করে ভাবি ওগুলো লাল রঙের। আমার গন্ধ প্রস্ফুটিত নাশপাতির মতো কিংবা জীবানুমুক্ত তরল দিয়ে ধোঁয়া টাইলসের মতো। আর আমি তার হাতে আমার গন্ধ পাই, একটা উষ্ণ ভারী ঘ্রাণ, যেন কুকুরের ভেজা লোম। এখনও সামান্য দ্বিধা, ধরো আমিই একমাত্র এমন একজন, ধরো কেউ একজন জানলো। দোকানে মূল্যহ্রাস চলছে, স্পিকারে জোরে জোরে এডিথ পিয়াফ আর চার্লস আজনাভঁ বাজছে, দুনিয়া চুইয়ে পড়ছে কামনা আর আনন্দে, আমি এরই অংশ তো, আমার বয়ফ্রেন্ডের হাত আমার বাহুতে ভেজা ভেজা, আমার পেটিকোট গুটানো আমার নিতম্বের দিকে, আমি উত্তেজিত হয়ে উঠছি।

আমার শহরের কেন্দ্রে ফিরে আসি, পুরো শহরটা দেখে মনে হচ্ছে পিচবোর্ডে তৈরি। বিজ্ঞাপনগুলো আরো জাঁকালো, ডেমি’সের দোকানে যথার্থ কফি, এখন এটা চলতি ফ্যাশন, চলছে... লেস্যুর স্টোরের কথা বলার বিপদ নেই, রু ক্লোপার্টের ছোট্ট দোকান যেখানে আছে এই শহরের সবচেয়ে পচা জিনিসগুলো... কিন্তু আমি পাত্তা দেই না, ওই দোকান তো শহরের আরেক প্রান্তে, পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, আমি ডেনিস লেস্যু নই, আমি আছি আমার ডেটের সঙ্গে, আমার জিগোলো-যুবরাজ। যখন আমরা হাঁটি তখন সে রুক্ষ দেয়ালে তার আঙুলগুলো টানতে থাকে, এটা একটা ঘষার শব্দ তৈরি করে, তাতেই যেন সব ঘৃণা, সব দ্বেষ চলে যায়, হাতের একটু শিথিল জড়িয়ে ধরা আর এক অবসন্ন ভালো-থাকায় ভরিয়ে দেয়।

আমি কেবল আমার নিজের কথাই ভেবেছিলাম, আমি আমার পায়ের নখ থেকে পনিটেইল করা চুলের গোড়া পর্যন্ত আর কিছু নয়, কেবল আনন্দের অনুরণন পেয়েছিলাম। আমার এক ঝলক আতঙ্কও হয়, কী হবে যদি আমার বাবা-মা জেনে যায়, কি হবে যদি আমি এইসব আর করতে না-পারি, আর আমাকে সবচেয়ে যেটা দুঃশ্চিন্তায় ফেলে তা হলো, কী হবে যদি আমি আসক্ত হয়ে যাই এইসব কিছুতে? 

সবশেষে আমার বোধোদয় হয় আর আমি আবিষ্কার করতে থাকি যে, আমার লালমাথা বয়ফ্রেন্ড তার মোটর রেস আর মোটা চশমা নিয়ে একঘেয়ে হয়ে ওঠে। আমাকে ধোঁকা দেয়া আর সহজ নয় আর আমি সিদ্ধান্তে আসি যে ভালো পরিবার থেকে আসা এইসব কাজকামগুলো সবই আসলে অর্থহীন; আমি অনুভব করতে থাকি যে ওর চেয়ে আমি অনেক উপরে আছি। আমরা যখন বাইরে যাওয়া বন্ধ করলাম, যখন আমি শুনলাম সে দুইবার ‘ব্যাক’ -এ ফেল করেছে, আমার তখন ভেবে রীতিমতো কাঁপুনি এলো যে আমি এই নমুনাটার পাল্লায় পড়েছি। আমার মনে পড়লো আমার মা ক্রেতাদের কী বলতো: যে সব মেয়েগুলা শস্তা মাগী তারা একবার শুরু করলে থামতে পারে না, তারা পারলে তাদের বাবা-মাকেও খুন করে... কিন্তু এসবই কেবল আকস্মিক এক ঝলক চিন্তা, অধিকাংশ সময়ই আমার সুখ ছিলো অন্ধের মতো খাঁটি, বৃদ্ধাশ্রমের বুড়োদের ফিসফিসে ফালতু কৌতুকগুলোর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই...   

গৌরব, অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা ভাবা। ‘আমরা স্রেফ ওদের মতোই’ আমার বাবা বলতো, ‘সবাই যা করে তাই করো’ মা বলতো। কি আজব কৌতুক, এই সবাইটা কারা? সেই বুড়া হাবড়া যে বারে আসে নিয়মিত, নাকি মনেটের মতো কোন বালিকা যে কারখানায় কাজ করে। নাকি স্কুলের মেয়েদের মতো এবং মাস্টারগুলো? স্কুলের মেয়েদের মতো, ঠিকাছে, কিন্তু আমি পারবো না, কারণ তুমি যা তুমি তো তাই, অতএব আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি তোমাদের একজন নই... তখ নপর্যন্ত আমি কেবল আঙুলেল গাঁটেই টোকা দিয়েছিলাম, কিন্তু ইতোমধ্যেই দূরের গজরানি শুনতে পাচ্ছিলাম, আর কয়েকটা বছর আর তারপরই সেটা ঠিক আমার তলপেটে আঘাত করবে, একটা আঠালো চামড়ার ছোট্ট বল। আমার শাস্তি ইতোমধ্যেই আমার জন্য অপেক্ষারত, কারণ আমি ভাবতাম আমিই ঠিক, আমার ক্ষেত্রে কিছুই ঘটবে না। ‘তুমি ভাবতে তুমি অন্যদের চেয়ে উত্তমতর!’ 

ফেব্রুয়ারির এক শুক্রবার। বিকাল সাড়ে পাঁচটার পর দরজায় ঘণ্টাধ্বণি, আমাকে একটা কোনো অজুহাতের কথা ভাবতে হবে। কোনো ভাগ্য নাই, দোকানটা ফাঁকা, মা নিশ্চয় তার মিষ্টি সাদা কফি খাচ্ছে। ‘তোমার এতো দেরি হলো কেন?’ আবার ঘণ্টা বাজলো, বেঁচে গেলাম। সে তার মুষ্ঠি ঝাঁকালো, ‘তুমি খালি অপেক্ষা করো! কিছু ব্যাপার ঠিক করতে হবে তোমার সাতে!’ আমার বাবা নিজেকে স্থির রেখে আলু ছেলাতে আর আমাকে সাবধান করলো, ‘তোমার জন্য বিপদ আছে!’ অনেকটা দূরে, বাইরে, আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই স্টোর থেকে, ‘আর কিছু লাগবে? হ্যাঁ, এই কমলাগুলো দারূণ আর মিষ্টিও। তোমার এখনও কিছু পাওনা আছে, মনে আছে?’ সমস্যাটা কি? আমার নাম্বার? সবকিছুর পরও সেগুলো তো ভালোই আছে, এটা শক্তিশালী অভ্যাসের মতো... কেউ কি আমাকে দেখে ফেলেছে? নিশ্চয় আমার সুন্দর গলি ধরে হাাঁটার কথা এই স্টোরে আলোচিত হবে না, আমার মায়ের সর পরা কফির উপর? আমি সেটা হতে দিবো না। আমি কিছুতেই আমার সুখের সময়, আলগা শরীর, আমার লাল মাথা ছেলেকে এসব কিছুর সঙ্গে গুলাতে দেব না। আমি তা অস্বীকার করবো, লুকিয়ে রাখবো... সে নিশ্চয়ই এখন রান্নাঘরে, ফ্যাকাশে আর জীর্ণশীর্ণ, তার পকেটে একটা চর্বির দাগ। ‘তুমি কোন জাহান্নামে ছিলে, তুমি একটা পিচ্চি হারামি, সিমেট্রির ওখানে কী, আকাইম্মা এক তরুণের সাথে, হুম, কী বলার আছে তোমার এ বিষয়ে, হ্যাঁ?’ আমি বাজেভাবে মিথ্যা বলি, আমি আমি ছিলাম না তো, আমি যাইনি তো। আকস্মিক সে তার দাঁত কিড়মিড় করে, তার চোখ যেন মাথা থেকে বেরিয়ে আসবে, আমার বাবার নাক তখন আলুর দিকে নিবিষ্ট, আমার মা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ‘ছোট্ট লক্ষ্মী সোনা! এত্তো ভালো মেয়ে তুমি, ওরা বলে, সব সময় বাসায়! এমন সুবোধ বালিকা! 

এই যে এখানে আমরা কাজ করতে করতে মাটিতে মিশে যাচ্ছি এই মেয়ের জন্য, পিচ্চি হারামি ছেমড়ি! যা চায় তার সবই তো দেয়া হয়েছে তাকে!’ সে ঘোৎ ঘোৎ করতে থাকে, সে আমাকে মারতে যাবে, কিন্তু বুড়ো ফোরেই চলে আসে আর দোকানের দরজার সামনে একটা বোতলের বস্তা রাখে: ‘ওঠো ওইখান থেকে আর দরজাটা খোলো, আইলসা বেকুব একটা!’ আমার বাবা লাফিয়ে ওদিকে যায়। আমার মা আমাকে একা ছাড়বে না, সে আমাকে জেরা করতে থাকে: ‘আকাইম্মাটা কে?’ সে যেন বিজয়ী হয়েছে, আমাকে নিয়ে টিটকারি মারতে থাকে, ‘তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে! ও ছোকড়া তোমাকে ব্যবহার করছে, ও তোমারে নিয়ে কিছুই ভাবে না!’ তুমি দুভাবেই কিছু পেতে পারো না, আমি এই ছেলেটার সমান নাকি সমান না, তাই ভাবছি। সে উত্তরের ধার ধারে না: ‘তুমি পরীক্ষা শেষ করো, অন্য বিষয়ে পরে ভাবতে পারবে!’ সে ভেঙে পড়ে, কান্না শুরু করে, ‘এখানকার অন্য মেয়েদের কার তোর মতো ১৫ বছর বয়সে বয়ফ্রেন্ড হয়েছে! আর তুমি কি একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ো আর তুমি এতো পড়ুয়া একটা মেয়ে!’ 

সে নিজেই নিজেকে বলতে থাকে, ‘ওই বুইড়া খরগোশশিকারী, বুড়া বস্তা লেসিন তোমাকে দেখেছে, সে এইটা ভাঙায়া একবেলার খাবার আদায় করবে, বেকুব বুড়া হাবড়া! আর তুমি ভাবো তুমি অন্য লোকের চেয়ে ভালো!’ সে আবার ওঠে: যখন আমি তোমার বয়সে ছিলাম, আমি জানতাম কেমন ব্যবহার করতে হয় নিজের প্রতি, কিন্তু কেবল ঈশ্বর জানেন, আমি কেবল কারখানার একজন কর্মীই ছিলাম!’ সে থুতু ফেলে, নিজের শব্দেই দম বন্ধ করার অবস্থা, কান্নামাখা অবস্থায় ঘোরে: ‘ভেবে দেখে আমরা সব কিছু করেছি এই ছোট্ট হারামি মেয়েটার জন্য, তোমারে আমরা চৌদ্দ বছর বয়সেই কাজে পাঠাতে পারতাম! আর এখন তুমি ছেলেদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো!’ এটা আধা ঘণ্টা ধরে চলল। আমি তাকে দেখে যেতে থাকলাম কিন্তু তার একটা কথারও সীমা-পরিসীমা মাপতে পারলাম না, সে অভারলের ভেতর কাপড় গুজে দিলো, রাগে কাঁপছিল। আসলে সে আমার সঙ্গে কথা বলছিল না, সে কথা বলছিল একজন ডেনিস লেস্যুর সঙ্গে যাকে সে আবিষ্কার করেছে, একটা ভালো ছাত্র ভালো রচনা লিখে ভালো নম্বর পায়, যে তার সার্টিফিকেট পেয়েছে এবং ব্যাক পরীক্ষাতেও পাস করবে। তার শব্দগুলো আমাকে ধুয়ে দিলো আর ঘৃণার সূচনা হলো, যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী ঘৃণা। আমি ঘৃণা দ্বারা গ্রাস হয়েছি তবে এখনকার ঘৃণার কারণ আলাদা, আমার একদম সত্তার ভেতর থেকে এখন ঘৃণা আসছে।

সে শঙ্কিত, এইটুকু, সে শঙ্কিত যে ক্রেতারা গুজব রটাবে, আমার কাজে। শঙ্কিত এই ভেবে যে আমাকে প্রাইভেট স্কুলে পাঠানো অপচয় হয়েছে, সব কিছুই বৃথা হয়েছে। কী এক দানব আমি যে এ সব কিছুর জন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম না। আর যতো সব নোংরা গল্প সে দোকানে শোনে, সে নিশ্চয়ই ভাবছে যে আমি অমন কিছুই করেছি। সে আমার উপরে ধর্মপ্রচারকের মতো বাণী দেয়া বন্ধ করে না, আমি কোনদিনই বিশ্বাস করতা না সে নীতিকথা নিয়ে এতো জ্ঞান নিয়েছে, শিক্ষকদের চেয়ে, পার্দ্রীর চেয়েও জঘন্য, ‘অগ্নি-পাথর ঘিরে সন্ধ্যার আলাপ’ কিন্ত এটা ভিন্নতর, কারণ তার জন্য এটা ছিলো যথার্থ ব্যবহারের বিষয়, লোকে কী ভাববে, কারণ সে বলতেই থাকে, তার নীতিকথা আদতে ভয়ের উপরে দাঁড়িয়ে। সে থাকে, তির্যকভাবে আমার জুতার দিকে তাকায় আমি সেখানকার কাদা মুছতে ভুলে গিয়েছি, ঘাসের পথ। সে বিবর্ণ হয়ে যায়, এমনভাবে তাকায় যেন আমাকে খুন করবে! ‘জঙ্গলে! জঙ্গলের মধ্যে! তুমি জঙ্গলে গিয়েছিলো!’ সে আমাকে পরপর দুইবার আঘাত করে, আমার পিঠে দুইটা ঘুষি মারে। বুড়ো ফোরেইন আধা খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দেয়। সে আমাকে টেনে সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসে, চিল্লায়, ‘পিচ্চি মাগী, পিচ্চি শয়তান, যদি কিছু হয় তোর, শুনছিস, যদি কিছু ঘটে, এইখানে তুই আর পা রাখার সুযোগও পাবি না।’ সে আমাকে দরজার ভেতরে আটকে দেয়, যেমন প্রতিবেশির কুকুর উত্তেজিত হলে আটকানো হয়।  

আমার পায়ের তলায় বাতাস ভারী হয়ে আছে বকবক আর চিৎকারে। আমি ক্যাশ রেজিস্টার ড্রয়ারের খ্যাঁচকোচ শুনতে পাই, ওটাতে তেল দেয়া দরকার। ক্রেতারা আমার ঘরের মেঝের দিকে তেলাপোকার মতো হামাগুড়ি দিয়ে আসতে চাচ্ছে, শপিংব্যাগে যা কিছু কিনেছে সেগুলোকে ঠেলতে ঠেলতে, আর আমার মা ক্যাচক্যাচ খ্যাচখ্যাচ করেই যাচ্ছে, আর কিছু লাগবে, আর কিছু, বোতলগুলো ঠুকঠাক শব্দ করছে আর দাড়িপাল্লায় ওজন মাপা হচ্ছে। এই তো এইখানে আমি, শুয়ে আছি কয়েক স্কয়ার মিটার চিনি, মটরশুটি, কুকিজ, খানাদানা, মদের উপর আর সব টুকরো আর ন্যাকড়ার উপর আর ঝাড়–, এপ্রোন এইসব। আর কিছু চাই, আর কিছু চাই, আমি এখানে এভাবে থাকতে পারবো না, কেস রেজিস্ট্রার থেকে টাকা ছিনতাই করবো। আমি একাকীত্ব আর ঘৃণায় বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছি। একটা খানকি যে এখানকার অন্য মেয়েদের মতোই ছেলেদের পিছনে ঘোরে সে কিভাবে তাকে যথার্থই ঘৃণা করতে পারে। আমার নতুন আমি পরিচ্ছন্ন এবং আনন্দে প্রসারিত, সে ইতোমদ্যেই নোংরা আর অসম্মান্বিত বোধ করতে থাকে। অশ্লীল, এইটা কোন ব্যবহার করার ভঙ্গি না, ঠোঁটের ভেতরের কোমলতা, ঘাড়ের গোলাপী আভা, ভেজা হাত। একটা রূপালী শামুক আমার হাতে ছাপ রেখে গেছে, আমার ঊরুতেও। আমি একটা টুকরাও পরিস্কার করতে পারিনি, সে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে, আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে নগ্ন করেছে, আমার চামড়া খুলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার নীতিবাগিশতা দিয়ে চিড়ে ফেলেছে। 

ওই দুপুরে তারা জিতে গেছে। এমনকি তারা আমার সাথে মিশেছে, আমাকে বইগুলোর কাছে পাঠিয়েছে তবে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। সে তার সব রাগ ঝেড়েছে ক্রেতাদের উপর সারাবিকাল স্টোরের সবাইকে রুক্ষèভাবে জিনিসপত্র দিয়েছে, আসলে সে সব ভুলতে চেয়েছে। যদি সে পারতো, সে আমার স্তন ছেঁচে দিতো, ‘নিচে ওইখানে’ যেমন সে বলতো ওটাকে। তারা ভীষণ আতঙ্কে ছিলো। তাদের সব আশা ভরসা... ডেনিসের তরফ থেকে একটা উঁকিও আশা করেনি, সে পড়ছে, সে সব সময়ই একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে ইতোমধ্যেই অভিধান পড়ছিলো যখন কি না মাত্র পাঁচ বছর বয়স! চিন্তা করার কিছু নাই। কিন্তু যখন ডেনিস ছেলেদের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে, যখন ডেনিস মুক্ত আর সুখী, তখন তারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তারা আমাকে তাদের বলয়ে ফিরিয়ে আনতে চায়, আমাকে ঢেকে দিতে চায় অশ্লীলতায়, যাতে করে তখন তাদের নীতি কথা ঢোকাতে পারে, তাদের ভয়, তাদের আতঙ্ক আমার কন্ঠ রোধ করে। আমাকে নিশ্চয়ই তাদের মতো ভয় পেলে চলবে না, নইলে আমি কোথাও যেতে পারবো না, আমি যা দিতে চাই...  

যা কিছু আমি করতে যাচ্ছি সেটা হলে বই, বাড়ির কাজ, রোববারের রোস্ট, লিসুক্সের বাসে বাৎসরিক তীর্থযাত্রা, বাসিলিকা আর সেন্ট থেরেসা’র জন্মস্থানে, নিঃসঙ্গ ছুটির দিনগুলোতে আঙিনায় কাঠের বাক্সগুলোর ফাঁকে সানবাথ করা... এই দিন তারা আমাকে দিয়েছে। আমি কাঁদি, কথা সত্য, আমি ভয় পেয়েছিলাম, আমি ভাবছিলাম পরের বছরই ব্যাক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আর আমি হয়তো একটা তেতো বিশ্রি হয়ে উঠবো, পুরুষদের পেছনে দৌঁড়ানো এমনকি যদি তারা আমাকে ফিরিয়েও দেয়, কেবল আনন্দের জন্য... নাহ, আমি আবার নোংরা এবং অশুদ্ধ বোধ করছি। 

ওরা কি আশা করছে ওদের আমি গালিগালাজ করবো আর আমাকে ঘরে তালা দিয়ে রাখবে আর আমি আমিন বলে মেনে নেবো? ওরা নিশ্চয় তেমন একটা কারণ তৈরি করতে চাইছে: ‘ডেনিস আজ আসেনি, ও কি তার চিঠিতে বলেনি যে তাকে থিয়েটার দেখতে যেতে হবে?’ আর তারা এটা বিশ্বাস করলো। একজন দারূণ মেয়ে, একজন ভালো মেয়ে, সে তার ব্যাকের দুটো পর্যায়ই প্রথম চেষ্টাতেই পাশ করেছে আর তারপর আছে মূল পরীক্ষা আর সেটা শেষ করলেই ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, আগামী জুনেই। ‘ও কি করতে চায়? ও জানে না, শিক্ষকতা হয়তোবা। যতোদূর সম্ভব তার যাওয়া উচিত?’ আমার মা আমার শিক্ষকরা সবসময় যা বলে তার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, উচ্চ বিদ্যালয়ে, তাদের আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা কাত করে শুনে গেছে ওদের কথা, একটা হাত পকেটে রেখে। ‘তুমি একটা কিছু হবে!’ সে দীপ্তিময় হতো, ওরা যা বলতো সে তাই গিলতো। সে মনে করেছে আমি থিয়েটারে, আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কিছু?’ যথেষ্ট সুখী। এক মুহূর্তের জন্য সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলো, তিন বছর আগে, তার মেয়ে প্রায় খারাপই হয়ে গিয়েছিলো। সে তাকে যথেষ্ট বলেছিলো, আর তারপর সব কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। ওদেরকে অনেক খেয়াল রাখতে হয়, সে বলেছিলো। যদি আমি এমন বোধ করতাম, আমি তোমাকে একটা ছোট্ট উপহার হলেও দিতাম, মা দিবসের জন্য দেরীতে হলেও একটা সারপ্রাইজ দিতাম। একটা লালচে পাথর। আমার পাকস্থলিতে যেন অনেক গিট্টুর অনুভূতি হয়, একটা গিট পাকানো দড়ি যা কেবলই কুন্ডলি পাকিয়ে আছে অবিরাম। সারপ্রাইজটা একদম ঠিক শেষ প্রান্তেই আছে, তখনও ঝুলছিলো, রবিবারে বাড়িতে আনা সেই সব বাক্সভর্তি স্ট্রবেরির মতো, সাদা কাগজে মোড়ানো, শেষ মাথায় একটা সুতো ঝুলানো। যদি সব কিছু ঠিক থাকতো, একটা সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, অভ্যর্থনাময় বাড়ি থাকতো, যদি আমি তাদের সঙ্গে বাড়িতে থাকার একান্ত অনুভূতি পেতাম, তাহলে, হ্যাঁ, সব কিছু হয়তো ঠিক হয়ে যেতো।

কোনো অনুশোচনার অনুভূতিই আমার কাছে তিন মাসের বেশি টেকেনি। মে মাসে আমার নাকে যুগপৎ এসে লাগে আঙিনায় ফুটে থাকা ওয়ালফ্লাওয়ারের ঘ্রাণ আর বাসী মুতের গন্ধ। ক্যাফের জানালাতে, মরচে-পড়া সাইনবোর্ডের নিচে লেখা ‘মদ বিক্রির লাইসেন্স প্রাপ্ত’, সেখানে আমি আমার প্রতিবিম্ব থেকতে পাই, চটপটে আর অভিযানের জন্য তৈরি। মূর্খের দল। তারা আমার অনুভূতির কথা কী জানতে পারবে আর আমার আবেগ, তারা তো বন্দী ওই কাউন্টারের মধ্যেই, তারা অঙ্ক, সাহিত্য কোন কিছু নিয়েই কিছু জানে না। বুড়ো হাবড়াগুলো শুয়োরের মতো চিৎকার করে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, ওরা বলে, এইবার আমরা পাবো, একদম নি¤œ অবস্থান, সবচেয়ে নিচে, আমরা একদম টয়লেটে গুয়ের সাথে মিলিয়ে যাবো। এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নাই, সব সময় কর্মীদের উপরই চাপটা আসে। আমাদের সরে যেতে হবে, আর সবকিছু হারিয়ে যাবে, অপেক্ষা করো আর বসে বসে দেখো। আমাদেরকে গেলার মতো কিছু দাও বস, হয়তো এইটাই শেষবার। মেঘেরা যেন মোমের মতো গলিত, একটা কমলা রঙা গাঁদাফুল আমার হাতে, ও আমায় ভালোবাসে, ও আমায় ভালোবাসে না, ও আমায় ভালোবাসে! শেষ ছোট্ট পাঁপড়িটার কথা কিছুতেই ভোলা যাবে না, তারপর ফুলের হৃদয় একটা তীব্র ঘ্রাণ দেয় যাকে আমি ছিন্নভিন্ন করেছি... ওরা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তবে ব্যাপারগুলো খুব খারাপ হচ্ছে, জেনারেল সাহেব আলজেরিয়াকে দখল করেছে। যদি সেখানে একটা বিপ্লব হয়... জনগণ লড়াই করবে, আড়ালে লুকাবো, প্রথমেই আমি যে কাজটা করবো বাড়ি থেকে পালাবো, গোলাঘরে গিয়ে লুকাবো, ছেলেদের সাথে... প্রতিরোধের সময় ম্যাক্যুদের  মতো। যদি সত্যিই ফ্রান্সে কিছু ঘটে, দুনিয়াতে কিছু ঘটে, তাহলে আমি অন্তত দূরে, অনেক দূরে সরে যেতে পারবো... রাতের খাবারের সময় কানটা রেডিওতে আটকে থাকতো। 

‘এর শেষ কোথায়? এইসব কিছুর শেষ হবে কোথায়,’ ওরা বলতে থাকতো। ‘এটা বাজে কাজ, জঘন্য, তুমে দেখে নিও, তাদেরকে কলম্বিয়া যেতে হবে এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই...’ না, ওরা যেন ওকে ফিরিয়ে না আসে, আমি অবশ্য তাকে আর মনে করতে পারি না, সে সবকিছুকে ফিকঠাক রাখতে চেয়েছিলো আর আমি তো সেটাই চাই না। সব কিছু ভেঙে পড়ুক, ফেটে পড়ুক আর লেস্যুর স্টোর ওড়ে যাক এর সাথে সাথে, একদম মাটিতে মিশিয়ে যাক, ধ্বংস হোক আর আমরা এখান থেকে বের হয়ে যাই। আমি এখন আশায় পরিপূর্ণ, ঘৃণায় নয়। তাক থেকে চিনি হাওয়া হয়ে গেছে, তেলও, কফিও আর কৌটায় ভরা খাবার জাতীয় পণ্যগুলোও শেষ, অভিজাত এলাকার ভদ্র মহিলা ফিরে ফিরে আসছে আরো আরো চাইতে, দশ কিলো চিনির ঢেলা একসাথে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে, তারা শঙ্কিত আর অন্যরাও তেমনি, আমার জন্য দুই লিটার তেল সরিয়ে রেখো, আমি মাস শেষে টাকা দিয়ে দিবো। যখন খাবারের জন্য হুড়াহুড়ি শুরু হয় তখন সেটাকে একটা ইশারাই ধরে নিতে হবে। এই তো আবার, স্কুল যাচ্ছে বন্ধ হয়ে, একটা বড় ইশারা, কিন্তু আমি চিন্তা করেও আনন্দ পাই, আমি প্রতিটা চিহ্নকে আকড়ে ধরি, মাতালদের গল্পগুজব, সার্ডিনের কৌটার  শেষ হয়ে যাওয়া। আয়োজকদের দল বাণিজ্যিক পাক্ষিক খেলাধূলা বন্ধ করে দেয়, আর ‘গুপ্তধন অনুসন্ধান’-এর খেলা কিংবা ‘প্রতিভা অনুসন্ধান’ নাই। রু ক্লোপার্টকে অন্য সময়ের চেয়ে আরো ম্লান এবং প্রাণহীন মনে হয়, নর্দমা থেকে গরমে দুর্গন্ধ বের হয়, কিন্তু সব কিছু পাল্টাতে যাচ্ছে, সবাই তাই বলছে, ভয়ার্ত শিক্ষক, আমার সহপাঠীরা, আমার বাবা-মা, আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের সঙ্গে থাকতেই হবে, এটা আমাদের, আমরা বহু আগে থেকেই আফ্রিকানদের জন্য সেনা তৈরি করেছি, যেমন প্রতিবেশীর ছেলেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য গান গাওয়া শুরু করেছে। বিষয়গুলো খারাপ, কিন্তু আমি আশায় বিস্ফোরিত... সে যেন তাড়াহুড়া করে ফ্রান্সকে উদ্ধার করতে না আসে, বুড়ো লোকটা, আমাকে একটু সময় বাঁচার সুযোগ দিক,পুরুষদের ত্বক স্পর্শের সুযোগ দিক, যেন সেগুলো ব্ল্যাককারেন্ট ফলের পাতার তলার মতো রুক্ষ... ছোট্ট লালমাথা ইতোমধ্যেই দূরের স্মৃতি হয়ে গেছে... 

সংবাদগুলো পরিষ্কার না, সে কি আসবে নাকি আসবে না...সে আসবে! সে আলজেরিয়াকে রক্ষা করবে, সবকিছুকে রক্ষা করবে... আবার সব কিছু শুরু হয়ে যাবে আগের মতো, বিরক্তিকর একঘেষে রবিবার, আমার বাবা-মা, ঘৃণার যোগ্য... ক্রেতারা চিনি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে, বিপদ কেটে গেছে, মেলা আবার শুরু হবে, সংকট কেটে গেছে। তেমনি ভাবে আমার নির্বোধ ধারণা, বাইরে থেকেই সব বদল হয়ে যাবে, কেটে গেছে। যুদ্ধ একটা পুরনো টুপি, বিপ্লব তারচেয়েও পুরনো। মে মাস ছিলো স্থবির, আর বাড়ির ভেতর আবার উষ্ণ মদ আর পুনরায় জ্বালানো কফির গন্ধ। কোনঠাসা। আমাকে পুরনো ময়দান ফিরে পেতে হবে, আরো আনন্দ করতে হবে এবং আগামী বছরের ব্যাক পরীক্ষাকেও এক হাত নিতে হবে...         

আমি যতো জায়গায় যাই তার সবখানে তো তারা অনুসরণ করতে পারে না, বিশেষত রবিবারের মেলায়, আশেপাশের সব গ্রামের ছেলেরা আসে আর তাদের বাইকগুলো আঙিনার দিকে রেখে একটা পানীয় নেয়, আর পুরনো যারা তারা এদিকসেদিক ঘুরতে থাকে। আমি অডেটির সঙ্গে বাইরে যাই, এটা এতো উষ্ণ দিন ছিলো যে ফুটপাথের ধারের নীল বেঞ্চে অসংখ্য লোক বসে আছে, এদিকে স্কুল বালিকাদের একটা দল শোভাযাত্রার মতো করে চলে গেলো। আমি একটা খুব ছোট্ট স্কার্ট পরেছি আর পায়ে চিকোরি পাতা ও অন্যান্য জিনিস মিলিয়ে একটা মিশ্রণ মাখিয়েছি যাতে সেগুলোকে তামাটে দেখায়। সে ছিলো কালো চুলের, চিবুক তার কাঁধের কাছে এসে গোলাকার হয়ে গেছে, পরনে জিন্স, শিল্পী শিল্পী ভাব। ওই লালচুলোর চেয়ে অনেক আকর্ষণীয়। বই, চলচ্চিত্র, কবিতা, বোদলেয়ার  আর ভেরলেন  মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারে। সে রাজনীতি সম্পর্কেও অনেক কিছু জানে। অডেটি সুকৌশলে সরে যায়। একগুচ্ছ নাম আমার মুখ দিয়ে বের হয়, যেগুলো রেডিওতে শুনেছি, সসতেল, গ্যালিয়ার্দ , মেন্ডেস ফ্রান্স । 

‘আমরা কি ভিড়ের সঙ্গে মিশে যাবো?’ সে জিজ্ঞেস করে। আমরা মনে হলো যেন আমরা একটা ষড়যন্ত্র করছি একসাথে, সে আমার হাত ধরে তার সঙ্গে নিয়ে গেলো, সে আমাকে ফালতু ভিড়ের সঙ্গে মিলাতে দিলো না, তারা ইতোমধ্যেই লটারি খেলছে, বাজী ধরছে, তারা একটা পিচবোর্ডের গরুর বাট ধরে টানাটানি করছে, শুকনা মেয়েগুলো একে অপরের ক্ষতের মতো ঘুরছে, তাদেরকে অনুসরণ করছে অন্য ছেলেরা রবিবারের বিশেষ পোশাক পরে। ‘চলো, একসাথে মজা করি,’ সে বললো। এমন ভাব করি যেন আমরা সত্যিই মেলায় এসেছি কারণ আমরা মেলা ভালোবাসি, কারণ আমরা এইসব শস্তা কেক দিয়ে পেট ভরাতে ভালোবাসি, কারণ আমি এইসব ফালতু জিনিস লটারিতে জিততে চাই। শস্তা জনগণের মতো আচরণ করো, সেইসব মেয়েছেলেগুলোর মতো যাদের কাঁধের ফিতা ইতোমধ্যেই অর্ধেক নেমে গেছে। এই আমি ডেনিস লেস্যু, এইতো গত বছরও বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে এসেছি আর তার আগের বছরও তাই। তারা দোকানে ডা-াগুলি খেলেছে, তাদের লটারির টিকেট খুলে দেখেছে, চিৎকার করেছে, ‘ফায়ারিং রেঞ্জের কাছে যেও না!’। তারা হয়তো একটা পানীয় পান করতো আর নিজেদের বিয়ারের সাথে সেটার তুলনা করতো। আমরা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতাম। লোকজন, মেয়েরা সুসজ্জ্বিত, দেখতাম ওইখানে ‘নামে-কী আসে যায়’ খেলা হতো। তারা সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে যেতো। আমি অডেটির সঙ্গেও এসেছি, একই ব্যাপার, আমরা আমাদের সময় নষ্ট করতাম সুন্দর চেহারার ছেলেদের পিছে ঘুরে, খুব সামান্য দুয়েকজনকে আকর্ষণীয় মনে হতো কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে কথা বলা হতো না। হ্যাঁ, এই তো এখানে আমি জনগণের খেলাতে, টেক্সটাইল কারখানার কর্মীদের এখানে, লম্বা হাড় সর্বস্ব কারখানার মেয়েদের সাথে যারা তাদের সাপ্তাহিক বেতন খরচ করে পটানোর চেষ্টা করছে ছেলেদের। কিন্তু আমি সত্যিই এ সবের অংশ নই, আমরা এর উপরে অবস্থান করি। এটা আমার মাথায় ছিলো। আমরা হাল্কা উষ্ণ পেপসি খাই, যা-তা, সে মনে করতো এটা একটা বড় ইয়ার্কি। সে চারুকলায় পড়তো। 

একটা বোলতা শস্তা জ্যামের বোতলের চকচকে আঠালো টুকরায় আটকে গেলো, লটারির ওখান থেকে লাউড স্পিকারে বারবারের চিৎকার আমাকে কাঁপিয়ে দিতে লাগলো আর ঘামের বিন্দু আমার তামাটে পায়ের ত্বক বেয়ে নামতে লাগলো। আমি আমার আঙুলের মাথা দিয়ে সেগুলোকে সাবধানে সরিয়ে দিলাম। আমি তার কথা শুনতে লাগলাম। ‘নিশ্চয়ই জেনারেল দ্য গল  সেই লোক যাকে আমাদের দরকার। এক শক্তিশালী সরকার। এইবার একটা হাসির কা- হবে, দেখো ওই মুটকিকে সে ডালিদা’র গান গাওয়ার চেষ্টা করছে।’ তার হাত আমাকে টেনে নেয়, মুঠিতে জোর আছে, আমাকে রুক্ষ ডেনিম জিন্সের দিকে টানে। আমি ধরা পড়ে গেছি, যেন একটা বরফের খন্ড বাইরে থেকে ভেতরের দিকে জমে উঠছি। প্রথম জনের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্হ, এক ঘণ্টার মতো সে আমার হাত ধরে থাকে, আমার কাঁধ ছোঁয়, একটু দূর থেকে আবার কাছে এসে। আমরা ‘ফুড ফর দ্য নর্মান্ডি’ দোকানের সামনে মেয়েদের দেখি এডিফ পিয়াফকে নকল করার চেষ্টা করছে। এটা নতুন নাটকের মতো, তবে এতে দোষ ধরার সুযোগ নাই, ‘আমার দিকে ঘষা খাও, এটা বেশ!’ নতুন ত্বক, এইবার এর গন্ধ দুধের মতো, একদম ফোটানোর আগের গন্ধ। আর এভাবে অন্য লোকদের নিয়ে মজা করা এটা আমাকে যেন আমার বাড়ির পেছনের কথা মনে করিয়ে দেয় আর এটা আমাকে আর তাকে একই পাশে এনে দাঁড় করায়। বাড়িতে আমরা কোন কৌতুক করি না কখনো, তারা সবকিছুকে খুব গম্ভীরভাবে নেয়, তুমি মজা করেও সেখানে ফালতু কথা বলতে পারবে না, তারা রঙ্গ-ব্যঙ্গ বোঝে না, আমার মা তো তর্জণ-গর্জন শুরু করে দেয়। তারা কেবল মামুলি পুরানা কৌতুক পছন্দ করে, যেমন পুলিশটা লোকটাকে জিজ্ঞাস করলো তোমার নাম কি, ‘সোনার মাথা’, এইসব প্যাঁচাল তোমার বমি এনে দেবে, তারা কৌতুক পড়ে ‘আলমানাক ভার্মত’ থেকে। 

চারুকলা, এ নামই আমি দিয়েছি তাকে আর এরমধ্যেই আমার সব মুগ্ধতার সারাংশ আছে, চারুকলা একটা শিশুর মতো ব্যবহার করতে থাকে, চেরি বীজ ছুঁড়ে মারছে চারিদিকে আর সবাইকে আজাইরা বলছে। সে আমাকে চমকে দেয়, সে আমাকে তার মতোই বেড়ার একপাশে টেনে নেয়, আমি একা নই, সে আমার চেয়েও বেশি করে লোকজনকে অবজ্ঞা করে। ওর পাশে, আমার নিজেকে আরো বেশি চালাক এবং স্বাধীন মনে হয়, আর মনে হয় ওই দোকানের সাথে সব সংযোগ ভেঙে গেছে আমার। আমি ঘৃণাভরেই ভাবি, গতকালও আমি কতো না নির্বোধ ছিলাম। 

ছুটির দিন শুরু হয়ে গেছে। একটা দারুণ গ্রীষ্মকাল। বিপ্লব ফিপ্লব হতে যাচ্ছে না, তাতে কি, আমি বাইরের বাড়িতে আর মুরগির খোয়ারের কাছে সানবাথ করি। ক্রেতারা প্রস্রাব করতে যাওয়ার পথে ইতস্তত করে, কি করবে বুঝতে পারে না: ‘তামাটে হচ্ছো, এ্যা?’ আমি একটা ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করি, এগুতে বলি, কিন্তু ওদের আমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার সুযোগ দেই না। আমি বাবা-মা কোন না কোনভাবে এদিকে হাল্কা খেয়াল রাখছেই, আমার হয়তো পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যাবে যদি আমি এইসব মাতালদের সঙ্গে কথা বলি আর তাদের পছন্দ করতে যাই। আমি সতেরো বছরের আর ওরা সব আমার দিকে চোখ দিয়ে রাখে। এই দোকানে কোন আশার সুযোগ নাই। কিংবা আমারও কোথাও যাওয়ার সুযোগ নাই। ছুটিতে ইংল্যান্ডে ক্যাম্পিং, তোমার মাথার ঠিক আছে? কখনো কি বুঝবে না তোমার কী হতে পারে! আতঙ্কে জেদ ধরে থাকে তারা। তারা কেবল চায় আমি আমার নাক মুখ বইয়ে গুজে রাখি আর আমার শরীরটা থাকবে তাদের নজরে। সহজ কাজ নয়, কিন্তু তাদের পক্ষে যতোটুকু করা সম্ভব তার সবটাই করেছে, আদর্শ পিতা-মাতা, অন্তত যখন তাদের পরিস্থিতি-পরিবেশের কথা ভাববে, শিক্ষকরা এমনকি হেডমাস্টারনিও ফিসফিস করে তা-ই বলে সর্বদা। (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৩ তম পর্ব  

 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়