ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৫তম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৩:৩২, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৫তম পর্ব

সেবার গ্রীষ্মকালে আর কিছু করার ছিলো না, কেবল নিজেকে বোকার মতো পাঠ করা, একটা শক্ত ঘাড় আর সানট্যান লোশন দেয়া মেয়ে। আর ছেলেদের পেছনে দৌঁড়ানো। আমি আবিষ্কার করেছিলাম ‘সত্যিকার’ সাহিত্য, শিক্ষকরা পড়তো আর আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা এগিয়ে তারা পড়তো, আমার কাছে এ সব এসেছিলো ‘চারুকলা’র মাধ্যমে। সাগান, ক্যামু, মার্লো, সার্ত্র ... সুনির্দিষ্ট সবভাবনা, নির্দিষ্ট বাক্যগুলো আমাকে অগ্নিশিখার মতো উত্তেজিত করে। মাথা উপরে, আমি ভাসছি, আমি শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমতী। আমি আমার বাবা-মার বাড়িতে একজন দর্শনার্থী, পাশ দিয়ে চলে যাবো। রু ক্লোপার্টের কেউ আর এমন করে বই পড়ে না। জীবন মধুর, বিষণ্ন এবং সংক্ষিপ্ত, যেমন তারা বলে থাকে। আমি কাল চারুকলাকে দেখবো, যেমন এ্যনি বলেছে নসিয়া’তে,  আমি নিঁখুত মুহূর্তের অপেক্ষায় বাঁচি। বিলীন, আমি একটা গাছ নিরব পাখি দ্বারা পূর্ণ। যখন আমি জাগি, দেখি, ক্যাফের কালো দেয়াল লাল লাল রেখায় ভরে গেছে, আমি পুরনো কিছু মাতালকে পার হয়ে যাই তাদের ভেতরের গেঞ্জি, উপরের অভারঅল পিচ্ছিল হয়ে আছে ঘামে আর মদে। ভিন্ন। অসীম রকমের ভালো। যেসব বই আমি পড়ছি তাই তার একান্ত প্রমাণ। সার্ত্র, কাফকা, মিসেল দ্য সেইন্ট-পিয়েরে, সিমন দ্য বুঁভা। আমি, ডেনিস লেস্যু, তাদের একজন। আমি আমার ভেতরে তাদের ভাবনার ভারে নত হই। আমি তাদের লেখার নির্যাস একটা লুকানো নোটবইতে টুকে রাখি। আমি এটা আবিষ্কার করেছি যে, আমি এইসব লেখকদের মতো চিন্তা করি, তাদের মতো অনুভব করি আর একই সঙ্গে জীবনের প্রতি আমার বাবা-মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি নির্বুদ্ধিতায় ভরপুর,  জীর্ণ-শীর্ণ, তুচ্ছ, দরিদ্র চিন্তা যা কেবল কোন রকমে গড়ে ওঠা ছোট্ট দোকানদারদেরই মানায়।

এখন এইসব কিছুর আর তেমন কোন অর্থ নেই, আগ্রহের শেষ বিন্দু নিংড়ানো পর্যন্ত বই-ই কাজ করে আমার ক্ষেত্রে, অপরিসীম আলোচনা চলে, পিগি’ কে নিয়ে, সে যে মানুষের ভালোবাসা... কিন্তু সেই গ্রীষ্মকাল, আমার শেষ বর্ষের আগে, আমার অন্যসব ভয়ঙ্কর গ্রীষ্মকালের চেয়ে অনেক ভিন্নতর ছিলো। আমি হয়তো নিজেকে অন্য কোথাও ভাবতে পারতাম, অন্য মেয়েদের মতো, যেমন সৈকতে কিংবা ক্যাসিনোতে নৃত্যরত অবস্থায়, মাঝেসাঝে আমি তা করেছিও, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আমার মগজে আমি আনন্দ আর স্বাধীনতা উপভোগ করেছি, এটা কোন ছোটখাটো ব্যাপার নয় যে দু’গজ দূরে মুরগি হাগু করছে এবং আরো খানিকটা দূরে বার থেকে জেনারেল দ্য গলের উচ্চতা নিয়ে লোকেরা চেঁচামেচি করছে আর আমি এর মধ্যে ক্যামু’কে আবিষ্কার করছি। এটাও আবিষ্কার করছি যে আমার চারপাশে যা ঘটছে সেটা সত্যিকারের পৃথিবী নয়, এটা নেহাত একটা ঘটনাচক্রের ফল আর এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার চারপাশের এরা করুণ, এটা উচ্চস্বরের আর এদের সঙ্গে আমার কিচ্ছু করার নেই। সত্য সেখানে ছিলো একদম সাদা কালোতে, কাগজে, এবং তা যথার্থ। আমি তাদের দিকে করুণার চোখে তাকাতাম যার একটা পৃষ্ঠাও পড়তে পারতো না এবং এই কাগজের পৃষ্ঠা থেকে কিছু অর্জন করতে পারতো না।

অনিবার্যভাবেই আমি অনুপ্রাণিত ছিলাম এসব বই দ্বারা। আমি দেখতে পেরেছিলাম, যে কাফকা’র ‘ক্যাসল’ এবং ‘হ্যাপি ইভিনিং টেলস’  পাঠ করা আর আঠালো চ্যাটচ্যাটে কফি কাপের দাগের মধ্যে ফারাকটা বিশাল... তাকভর্তি বাগানের মটরশুটির কৌটা, বিকট মটরশুটিগুলোর উপর সূর্যের আলো পড়ছে, আমার মা চেয়ারের উপরে একটা ডাস্টার দিয়ে ঝাড়ছে, বুড়ো মার্টিনের হাত এতো কাঁপছে যে সে এক গ্লাস পারনদ ফেলেই দিলো। এরা সবাই একই রয়ে যায়। দুনিয়াটা আলাদা। এই গ্রীষ্মকালের সময়ই আমি সমাধান খুঁজে পেলাম, সামাল দেয়ার সবচেয়ে ধূর্ত পন্থা, সেটা হলো সেই সব জিনিস জেনে ফেলা যা অন্যরা জানে না, অন্য কিছু পাত্তা না-দিয়ে পড়ে যাওয়া, সাহিত্য পাঠ করে যাওয়া, বিশেষত সাহিত্যই, এইটা এবং সর্বোতভাবে ওদের উপরে থাকা যা ওদেরকে বিরক্ত করার সর্বোত্তম পন্থা। আসল টেক্কা। আমি এটা উপভোগ করতামও। আমি সপ্তাহে দুইবার চারুকলার সাথে দেখা করতাম, যে কোন স্থানেই, আমার মন খুব বেশি করে পড়াতেই ছিলো, আর আমার ঊরু লাল হয়ে গিয়েছিলো সানবার্নে। অতএব আমার মা কোন সন্দেহ করতো না, কারণ আমি এমন ভাব করতাম যে অডিটির সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছি বা চার্চে গিয়েছি। বেশি হলে এক ঘণ্টার ব্যাপার আর প্রায় তিন-চতুর্র্থাংশ সময়ই আমরা গল্প করতাম, তবে ও আমাকে খুব হাসাতো। অন্য লোকেরা আস্ত গর্দভ, আমরা দুজন ছাড়া বাকী সবাই। ক্যামু আর সিমন দ্য বুভে’র নানা টুকরায় উদ্ভাসিত ছিলাম আমি, আমি যে খুব দ্রুতই প্রভাবিত হয়ে যেতাম। আমি ওকে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’, ‘দ্য ওয়াল’ আর ‘আন্তিগোনে’   থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে একদম ভরিয়ে দিতাম, আর সেও তেমনি তাল মিলিয়ে চলতো, ও এতো বেশি জানতো চিত্রকলা সম্পর্কে আর ওর বাবা ছিলো একজন ডেন্টিস্ট বিশ কিলোমিটার দূরে থাকতো। আমি সফল হয়েছিলাম, ও আমাকে বলেছিলো ‘তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই ভাবতো তারা একটা আগলি ডাকলিং  পাবে।’ এটা ওকেও ভাবাতো, ব্যাপারটা তো অদ্ভূতই, একটা মুদির দোকানদারের মেয়ে, আমি ওকে এইটার জন্য ঘৃণা করতাম। হারামজাদা, কেন আমি হলে কী অসুবিধা? কিন্তু আমি তারপরও খুশি। আমি আনন্দের প্রকৃতি নিয়ে দার্শনিক চিন্তা করি, যখন তার হাত বেদনার্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, ডুবে যায় আমার সানবার্ন হওয়া অংশে, পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় আবার... 

এসব ছিলো আমার আশ্চর্য বৎসর, যার জন্য আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছি। দোকানটার ক্রম অবনতি হচ্ছিলো, রু ক্লোপার্টের তলানিতে এক বেচারা বস্তু যেন, যেটা চেষ্টা করে যাচ্ছে আরো দুয়েকটা বছর টিকে থাকার। তার ক্যাফেটারে কমলা আর সবুজ করেছে আর বারটাকে লাল রঙের ফর্মিকা বোর্ড দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেছে। এটা আমার কাছে হাস্যকর লাগে। ওরা বুড়ো হচ্ছে, মাতালদের সংখ্যা কমছে, কেউ কেউ মরে যাচ্ছে। শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ, বিদায়। আমি ক্রমশ ওদের থেকে আলগা হতে থাকি, কোন সংযোগই নাই, মাঝেসাঝে করুণার একটা অনুভূতি আছে কেবল, ওরা মনে করে আমাকে ওরা দারূণভাবে তৈরি করেছে, একটা ভালো মেয়ে, শান্ত আর গম্ভীর, আর এদিকে আমি তাদের অন্তর থেকে ঘৃণা করি... আমি ওদের ভাবনা থেকে বহু দূরে এবং স্বাধীন। আমি যেন ওয়ার্ড্রবের উপরের আয়না, আমি নিজেকে, আমি নিজেকে নিরুদ্বেগ আর দারুণ ভাবি, আমার স্বপ্ন, প্রবাহমান পনিটেইল, ঢেউ খেলানো স্কার্ট, নিঁখুত ব্যালেরিনা সু। সব কিছু দারুণ চলছে। আর আমি ঢ্যাঙ্গা ও রোগা নই, অন্যদের হিংসা করারও আর কিছু নাই আমার। আমি এখন কোন দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই মুখ খুলতে পারি, কথা বলতে পারি, ওই সব লম্বা কথা বা গুজবের মূল্য নাই আমার কাছে। ‘ডি’জে তোমার স্যুয়েটারখানা পরে ফেলো বাপু?’ হাস্যকর, গ্রাম্য কথাবার্তা আমার বাবা-মা বলেই যেতে থাকে, অভিজাতদের পরিবারে কেবল কাজের বেটিরাই এই ভঙ্গিতে কথা বলে, গ্রাম্য ইতর ভাষায় তিরস্কার করে। এরচেয়ে ভালো, আমি এখন কলেজের সব গালিগালাজ জানি, ভবিষ্যতের ছাত্রদের নিয়ে পাসওয়ার্ড দেয়া কথাগুলো শিখেছি। আর এখন আমি অনুভব করি যে যদি ফেরার কোন পথও না-থাকে, আমি এগুচ্ছি, সাহিত্য দ্বারা উজ্জ্বল। ইংরেজি এবং ল্যাটিন।  অন্য দিকে তারা তাদের ছোট্ট নোংরা ক্যাফে ঘিরেই জীবন যাপন করে, তারা যথেষ্ট সুখী, কোন অনুতাপ নেই, আমার জন্য যা পারে তারা তা করেছে মনে করে।

এমনকি সংস্কৃতি কি সেটাও তারা জানে না। সেই পরীক্ষার খাতার উত্তর, ‘সংস্কৃতি হলো সেই বস্তু যা সব কিছু ভুলে যাওয়ার পরও রয়ে যায়।’ এই কথা তাদের জন্যও প্রযোজ্য না, কারণ, তারা তো ভুলে যাওয়ার মতো কিছুও শেখেনি... আমি তাদের থেকে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকি। আমি রোমান্টিসিজম আর এনলাইটমেন্ট নিয়ে লিখতে থাকি, আত্মার অমরত্ব নিয়ে লিখি, যখন কিনা আমার বাবা খবরের কাগজে ক্রাইম রিপোর্টে মনোযোগ দিয়ে রাখে, এমনকি সে দুর্ঘটনার খবর পড়তেও পছন্দ করে আর আমার মা রয়েছে তার চটুল উপন্যাস নিয়ে। আমি ব্যাক পরীক্ষার দিকে এগুচ্ছি, আমি পাশ করেছি, আমার প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় পর্বে পাশ করেছি, এটাকে বলা হয় propedeutique তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলে, এই শব্দের মানে বোঝে না, তারা তো এতোটা জ্ঞানী না, তারা তোতলায়, আমার মা হিসাবের খাতা থেকে একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে এটা লিখে রাখে, যাতে করে সে এটা বলতে পারে, নিয়মিত ক্রেতাদের নয়, তাদের সে কেবল কা-কা করে বলে, ‘কালেজ’ পাশ করেছে, কিন্তু ডাক্তার, দলিল লেখক, সহকারী মেয়রের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ যখন জানতে চায় তখন বলতে পারবে কিংবা পাদ্রী মহোদয় যখন কারো শেষ কৃত্য করে ফিরতে থাকে তখন বলতে পারবে। তারা তখন আমার দিকে তাকায়, আমাকে অভিনন্দন জানায়, মানতে পারে না যেন, বিস্ময়কর কিছু একটা আমি করেছি, তাই নয় কি? তারা আমার মায়েল সঙ্গে যেভাবে কথা বলে সেভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে না, তারা আমার সঙ্গে রাসিনের  কথা বলে, সামান্য ল্যাটিন কৌতুক করে, আমার মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ওরা আমার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলছে। আমি যেন দলিল লেখক, ডাক্তারদের সমান পর্যায়ের, আমি ওদের মতোই পড়ালেখা করেছি। আমার এমন মনে হয় যেন আমি জিতে গেছি। তারা যদি এখন আমাকে একটা পার্টিতে যাওয়া আটকাতে চায়, আমাকে আটকাতে চায় সেটা হবে নেহাতই যতো গর্জে ততো বর্ষে না ধরণের, আমি তাদেরকে কিছুতেই ভুলতে দিবো না যে, আমি একজন বিশেষ কেউ... চিন্তার কিচ্ছু নাই, একবার তারা যখন দেখেছে যে গুরুত্বপূর্ণ লোকগুলো আমাকে পাত্তা দেয়, তখন তারা আমাকে যা খুশি তাই করতে দেয়। ‘তোমার কাছে টাকা পয়সা আছে? একটা নতুন রেকর্ড কি কিনতে চাও?’ এর অবশ্য একটা বিষণ্ন দিকও আছে... এতোটা দেখভাল আমার প্রাপ্যও না, কেবল কোন একটা লোক কাফলিঙ্ক যুক্ত শার্ট পরে ক্যাফেতে এসে একটু কেতা করে কথা বলেছে আর রাসিনের নাম উচ্চারণ করেছে বলেই আমাকে এতোটা খাতির করার কিছু নেই। 

ব্যাক পরীক্ষা তাদের একেবারে প্রশমিত করে দেয়, তারা আবার আরামে শ্বাস নিতে পারে, শেষ পর্যন্ত আমি তাদের কাছে আর বড় কোন সমস্যা বলে মনে হই না। তারা হয়তো আমার উপর নজর রাখতো আর অবশেষে সে এটা শিখতে পেরেছে যে, ডেনিস প্রায় কোন রকম লেগে থাকতে পারে। মূর্খের দল। তবে পরীক্ষার ফল আসার আগের সন্ধ্যায়, আমি আমার ঘরে বসে শুনছি মোৎজার্টের ‘আইনে ক্লেইনে নাখটমুজিক’ , আর আমি জানি নিজের বুড়ি মহিলাটি বা কোন একজন উপরে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তারা আমার সম্পর্কে একটু কম ভালো চিন্তা ভাবনাই রাখে, অথচ সিজের শোবার ঘরের বিছানায় আমি আমার দারুণ ভবিষ্যতের কথাই কল্পনা করতে পারি... আইনজীবি, কলেক শিক্ষক কিংবা যা কিছুই হোক, আমার কিছু যায় আসে না, যতোক্ষণ না আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক হয়ে উঠি, আমি এগুতেই থাকবো... আমি দুর্দান্ত রকমের সুখি, আমার ভবিষ্যত এই সুরের সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু, কিন্তু কী হবে, যদি আকস্মিক একটা পতন হয়, যদি সব কিছুর পরও আমি গরিব রয়ে যাই, এইসব নুডলসের প্যাকেটের মধ্যেই রয়ে যাই... যদি আমি আগামী বছর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারি... ওই তো নিচে ওরা রয়েছে, দুর্ভাগ্যের জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ, নিয়তি নির্ধারিত খালি বোতলের মতো চিন্তিত, সামান্য টাকা নিয়ে লড়াই করছে, নোংরা সব নোট যেগুলোতে তাদের বাচ্চারা কালির দাগ দিয়ে ফেলেছে। আমাদের প্রতিবেশীর মধ্যেই এমনকি আমার বয়সের একটা মেয়ে আছে যার নামও আমার নামের মতোই, লেস্যু, সে খোঁড়া, সে কখনো পড়তে শেখেনি, আর এখন সে তার বাবা-মায়েল মতোই মদ খায়, একদিন হয়তো আমাকেও এমন হতে হবে... একই তো নাম। আগামী কাল, তারপর দিন, এমন একটা, দুটা দিন তারপর জানি আমাকে ব্যাক পরীক্ষা দিতে হবে, তারপর এক মাস, আর অতি শীঘ্রই সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। এখনও অনেক কিছু করা বাকী আছে। কীভাবে আর কতো পরীক্ষা দিলে আমি পারিবারিক আলমারির কাঠামোকে ঢাকতে পারবো, মাতালদের উন্মাদ হাসি, অশ্লীল আচরণ আর মূর্খদের ভাষাকে আমি ঢাকতে পারবো? দুনিয়ার সব পরীক্ষাও লেস্যু বালিকার পাঁচ বছরকে ঢাকতে পারবে না, ছয় মাস আগেও এমন মনে হতো আমার। আমি সব সময়ই তাকে ঘৃণা করবো! সুউচ্চ লক্ষ্য, আমি আমার মা ও শিক্ষকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত। কিন্তু এখনও আমাকে বহু ফারাক গুচাতে হবে, দোকানের চিন্তাটা বাদ দিতে হবে, একটা যেন তেন শৈশব, চুলে ঢেউ খেলানো বন্ধুরা, এইসব কিছু বাদ দিতে হবে... কলেজে যেতে হবে, একজন ছাত্র দূরবর্তীর মতো, ব্যস্ত মেয়েরা যারা শনিবারে ট্রেন থেকে নামে, তারা চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইনবিদ্যায় পড়ছে কিংবা রঙের কারখানায় পরিচালক... গানের রেকর্ডটা শেষ হয়ে গেছে, তারা আমার জন্য নিচতলায় রাতের খাবারের অপেক্ষায় আছে, শীঘ্রই, আমি বাড়ি ছাড়তে পারবো। 

সেগুলো ছিলো দারুণ বছর, যাই হোক, ব্যাক পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্বের দিকে এগুচ্ছি, সাফল্য আর উদযাপন, আমি যথার্থ, জীবন্ত বালকদের নিতে পারতাম সঙ্গে... উত্তেজনায় শিহরিত, আবেগ চর্তুদিক থেকে ছুটে আসছে যেন, লালা আর ত্বক, আমার উদযাপন হলো একটা পুরুষের দেহ। যে কোনো একজন নয়, অবশ্যই হতে হবে কলেজের ছাত্র, কিংবা কলেজ যাওয়ার আগে, স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র, এরচেয়ে কম কেউ তোমার হাঁটুর নিচে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য, বুঝলে বালিকা আমার।

যদিও আমি চেষ্টা করেছি তাদের শুকে যেতে কেবল, তারপরও কিছু ব্যর্থতা তো আছেই, একটা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, একটা ব্যাঙ্কের কেরানি, এরা বিয়ে করতে চেয়েছিলো। আমি এটাকে ফ্লার্টিং বলি, আমার স্কুলের বন্ধুদের মতোই। এক ডজন কিংবা তার কাছাকাছি প্রেম করেছি দুই বছরে। চারুকলা গ্রীষ্মকাল পুরোটা টেকে নাই। ‘আমার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছো না কেন তুমি? এটা কিন্তু স্বাভাবিক-স্বাস্থ্যকর!’ আমি তখনও জানতাম না, লোকে কতোদূর যেতে পারে, মানে অন্য মেয়েরা কতোটুকু গিয়েছিলো... সবচেয়ে বড় কথা সে কেবল ভেরলেন আর খ্রাঁম্বো’র কয়েকটা কবিতাই জানতো। অন্যেরা তারচেয়েও কম সময় টিকেছে।

ব্যাক পরীক্ষার পর থেকেই আমার মা আমাকে নাচে যোগ দেয়ার সুযোগ দিতো, তরুণ কৃষকদের নাচে, শ্রমিকদের নামে। সেন্ট্রাল বারে সপ্তাহখানে আমরা একসাথে পায়ে হেঁটে গেছি, ডেট করেছি, কিংবা মাস দুয়েক ধরে, পুরো শীতকাল জুড়েই কাপড়ের তলা পর্যন্ত যেতে আমরা দীর্ঘ সময় নিয়েছি। বাড়িতে, আমার নিজের শহরে, আমি কখনোই পুরো পথটা হেঁটে দেখিনি। আমি একটা নোটবইতে টুকে রেখেছি ওদের নাম, ওদের বাবা-মা কী করে, আমরা একসাথে কি কি করেছি, তবে সবই লিখেছি ইংরেজিতে, যাতে করে আমার মা’র মাতব্বরি এড়ানো যায়, সে পারলে গুয়ের প্যানেও তাকিয়ে দেখতো আমি কী করি। আমি এখনও ভয়ের একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ অনুভব করি, আমার বাবা-মা বাজে মেয়েদের যে সব গল্প, গান শুনিয়েছেন যারা সোজা তলানিতে নেমে গেছে সে গল্পের জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ, ‘ট্রু কনফেশন’ পত্রিকার সেই সত্যিকার জীবনের গল্প ‘মফস্বলের পাখি’। রু ক্লোপার্টে প্রেম করা, নোংরা মাংসের লকার কিংবা প্রাচীন মদের ব্যারেলগুলোর পাশের কক্ষে প্রেম করা দুঃস্বপ্নের চেয়েও বেশি। ওটা করতে হবে অনেক দূরে, সমুদ্রের পারে, জলে কিংবা বালুতে... ডোমিনিক, জ্যঁ পল কিংবা ছোট্ট কালো ছেলেটি, যাকে দেখতে জেমস ডিনের মতো লাগতো, আমি এমনকি তার নামটাও জানি না। আমি ওদেরকে বিচার করতাম ওদের রসবোধ দিয়ে, ওদের বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যই যেন প্রমাণ করতো যে ওরা আদতে গ্রামের ছেলে নয়। যারা নির্বোধ আর ফালতু কৌতুক করে, ‘একটা লোক পকেটে হাত রেখে নিজেকে অহঙ্কারী ভাবে’, তারা আমার বমন ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। আমি উপযুক্ত দলের সঙ্গে থাকতে চাই : ‘তুমি একজন শিল্পী মানুষ, তুমি কি ইপোখানে দিবে? ও একজন আত্মার দোসর, আমি শুয়ে শুয়ে থাকতে পারি আর সব কিছু হতে দিতে পারি, মুখ আর স্তনে উচ্ছাস প্রকাশ করতে পারি, যৌনতা অনুন্মোচিত, ‘পিতেতে ফ্লু’  সুরে দুলতে পারি। ‘খোঁচা!’ এখন তারা মোজড় দিয়ে উঠছে, অস্বস্তিবোধ করছে, আমার স্কার্ট দেখে, সেইসব লোকেরা যারা তিন বছর আগেও আমাকে চিনতো না। আমার প্রতিশোধ। আনন্দ আর বিশুদ্ধতা মিলিছে একাকার, আমি কারো জন্য নির্দিষ্ট নই। 

কিন্তু আমি ওদের পথকে অনুসরণ করি, কীভাবে ওরা কথা বলে আর কী তাদের পছন্দ। ডোমিনিক, ইয়গা আর ডিউক এলিংটন, জঁ পল, এনিমেটেড কার্টুন ; কখনো কিছুই না তারা, সবগুলোই এতো দ্রুত আসে যায়। ছোট্ট লাল মাথা সেই বালক থেকে শেষ জন পর্যন্ত, আমি কেবল আমার নিজের আনন্দটাই খুঁজেছি, আমি বেঁচে ছিলাম মূলত অন্যদের অনুপ্রেরণায়, তাদের শিক্ষা আর বেড়ে ওঠায়। তবুও, সেক্ষেত্রে, আমার শৈশবের ক্লেদ শুষে নেয়ার মতো পর্যাপ্ত প্রেমিক কখনোই ছিলো না, বুড়ো হাবড়া যাদের হাত, মুখ, তুড়ি বাজানো সবই ছিলো দেনার দায়ে ঢাকা তাদের নৈকট্য, ছোট্ট চিত্রকর তার নোংরা হাত, নিনিস, আসো আর এখানে দেখো। যে আনন্দ আমি পেয়েছি, আমি তা নিজের জন্য উপার্জন করেছি, এর সঙ্গে আমার বাবা-মায়ের কোন কিছু সংযুক্ত নেই। একটা সমৃদ্ধির সময়, প্রাচুর্যের, ব্যাক পরীক্ষা, ফ্লাটিংয়ের সুযোগ, আমি তখন আঠারো। এটা ছিলো একটা সফল গল্প। আধা-বুদ্ধির সবগুলো প্রাইভেট স্কুলের পাশে ঝরে পড়ছিলো, পরীক্ষায় ফেল করছিলো, আরেক বছর পড়তে হচ্ছিলো, এমনকি ক্রিস্টিয়ানেকেও চলে যেতে হয়ে, আর সবার উপরে, আমি নাচতে যাই আর ডেটিংয়ে যাই, সেই সব ছেলেদের সঙ্গে যাদের অংশ হওয়ার জন্য আমি আকাঙ্ক্ষা করেছি...

এসব বিষয় আমার পাশে বসে কান্ট আর হেগেল  নিয়ে লেকচার শোনা মেয়েরা বুঝতে পারবে না, সেন্ট মিশেলে আমার শেষ বছরটা ছিলো ইঞ্জিনিয়ার আর ডাক্তারদের কন্যাদের সঙ্গে দিন যাপন। আমি সেইখানে চুল পরিমাণ দূরত্বে ছিলাম, একটা মাত্র সিদ্ধান্ত সব কিছু বদলে দিতে পারতো, ‘যাও, ভাগো, পাখির খাঁচার কারখানায় কাজ করো গে!’ আর সেটাই হতো আমার কলেজ অধ্যায়ের সমাপ্তি! আমি একজন লড়াকু, টিকে আছি তবে পুরানোর মতো নই। ঠিক এই মুহূর্তে তারা কাঠের বাক্সগুলো টানাটানি করছে আর একে অপরের প্রতি চিৎকার করছে, কতো কি যে আছে যা তারা কোনদিনই জানবে না। আমি ওদের  চিন্তারও ঊর্দ্ধে, সকল ক্ষেত্রেই, এমনকি আমি ততোক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ কামোত্তেজনা উপভোগ করতে আপত্তি করি না যতোক্ষণ পর্যন্ত আমি ভার্জিন আছি... আমি নিজেই উত্তেজিত হতে পারি, আমি নিজের সম্পর্কে কথা বলতে পারি, দর্শন ক্লাসে আমিই সবচেয়ে সেরা চিন্তাবিদ... আমার পুরানা ঘৃণারা আমাকে ছেড়ে গেছে, কেবল মাসে এক ঘণ্টার জন্য ফিরে আসে যখন আমি শুনি আমার বাবা গোঙাচ্ছেন আর বলছেন যে তার পক্ষে আর সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, কারণ অধিকাংশ লোকেরা এখন শহরের কেন্দ্রে কেনাকাটা করতে যায়, আর আমি দেখি কী ক্লান্ত দেখায় তাদের। ঘৃণাটা তো আমিই করি। অথচ আমি তাদের ঘাড় বেয়ে উপরে উঠছি, তারা ওই কাউন্টারের পেছনে কাজ করে আর আমিই তাদের ঘৃণা করি... কী আসে যায়, আমার কোন সত্যিকারের বন্ধু নাই, একজনও নাই যে আমার খুব কাছের মানুষ... পুরনো চীজের বাতিল ঢাকনা যেটা দশ বছর ধরেই ওখানে আছে সেটাকে ঘিরে মাছি ভ্যানভ্যান করছে। হয়তো আমার কারণেই তারা একটা ভালো দোকান কিনতে পারেনি। এই রু ক্লোপার্টের পচতেই রয়ে গেছে। তাদের জন্য করতে পারি এমন কিছুই আর নেই। কেবলমাত্র আমি কলেজে গিয়ে কলা অনুষদে ভর্তি হলে তারা খুশি হবে।  

এটা একদম অবাস্তবের মতো দেখায়। ম্লান সোনালী আলোর রেখা দেয়ালে, একটা চমৎকার শরৎকাল। পাশের হাঁটা পথে আমি পা ফেলি যেখানে দোকান থেকে আসা সাবান জল জমে আছে। কলেজের আঙিনা ভরে আছে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে-মেয়েদের ভিড়ে। যা কিছু নোংরা আর কুৎসিত ছিলো চলে গেছে তা, আমি ওখানে থাকতেই সুখি ছিলাম, কেবল সামান্য দুশ্চিন্তা, এটা হয়তো আমার কঠিন মনে হবে, কিন্তু তেমন কিছু নয়। একজন ছাত্র। আমি আমাদের মধ্যেকার সংযোগ ছিন্ন করে ফেলেছিলাম, কিন্তু ওরা বুঝতে পারেনি, আমি ওদেরকে মাসে একবার দেখতে যাবো আর শুরুটা করার জন্য আমি একটা অনুদান পেয়েছি আর পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস। বই, সোয়্যেটার কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা পেয়েছি, আগের মতো খুচরা টাকা নয়, যার অধিকাংশই খরচ হয়ে যেতো খাবার, বিস্কুট আর ন্যাসক্যাফে কিনে। পশমী জ্যাকেট পরা ছেলেরা, ওদের দেখতে বয় স্কাউটদের মতো কিংবা বইপোকাদের মতো লাগে, পশমের হুডঅলা লেদার জ্যাকেট পরেছে কেউ কেউ, কিন্তু আমি খুঁতখুঁতে নই, ওরা নির্বাচিতদের একজন, আমার মতো ছাত্র, সেরাদের সেরা, কারখানায় আনা সব ছাতু... আমি কেবল সিনেমায় বড় লেকচার হল দেখিছিলাম আগে, আমি মাঝখানের দিকে এক কোণায় বসি, আমি অধ্যাপকের মুখ পাশ থেকে দেখতে পাই, চুলের গোছা, ঘাড়, সব ছেলেদের ঘাড়, সোজা, তাদের কাঁধে ডুবে আছে, হেলানো, কোনটাকে পছন্দ করবো, গোপনে খেয়াল করে যাচ্ছি দূর থেকে যতোক্ষণ না সে পেছনে ঘুরে তাকায়... 

ধূসর দেয়াল থেকে বাইরে তাকানো যায় বিরাট জানালা দিয়ে, আকাশের একটা ছোট্ট অংশ। আমার পুরনো স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সত্যি হতে যাচ্ছে : একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ স্কুল, কিচ্ছু না একটা স্কুল, এটাই সব, এখানেই খাওয়া বা ঘুমানো, আমার বাবা মা’র ওখানে নয়, কলমের নাগালের মধ্যে কোমল আর প্রগাঢ়। আমি একটাকে আমার জন্য শিকার করবো। আমি ইতোমধ্যেই এমন বিশাল একটা ক্লাসরুমের কথা ভেবেছিলাম আর নিজেকে ঘিরে দিয়েছিলাম শিক্ষায়, নোংরা জঞ্জালময় বার আর কোণার ময়লাগুলো থেকে অনেক দূরে। আমি ওটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, ডেনিস লেস্যু, ডেনিস লে স্যুয়ে, সেই পুরনো লেবেল নিজ থেকেই খসে পড়েছে কখন। এখানে কেউ আর আমাকে চেনে না, কেউ আর আমাকে আমার বাবা-মায়ের পরিচয়ে চিহ্নিত করে না। ডেনিস লেস্যু, ছাত্র। এই শব্দটি আমার অংশ হয়ে গেছে যদিও আমি সবসময়ই ছিলাম। কী করো তুমি? উত্তর হলো গণিত, প্রথম বর্ষ, ডেন্টিস্ট। হাজার হাজার মুখে একটাই চিহ্ন ‘ছাত্র’, সিল মোহর করে দেয়া যেন, চারিপাশে ঘুরছে আমার বৃত্তেরই লোক, লেকচার হলে, ক্যাফেটেরিয়ায়, বারে। 

সেই বৃত্তের ভেতরে, আরেকটা আভ্যন্তরীন ছোট বৃত্ত, চুপচাপ, নিরব, বইয়ের গীর্জা যেন, লাইব্রেরিটি, যেখানে আমি সবচেয়ে সুখি। ধূমপান নিষেধ, পুরনো জ্ঞানের ঘ্রাণ, সীমানাহীন সুযোগ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য। গেঁয়ো লোক, নির্বোধ, অকাটদের জন্য নয়। সকাল থেকে রাত অবধি খোলা, কেবল রবিবার বাদে। আমি পাথরের ধাপ পেরিয়ে যাই, বিবর্ণ কার্পেট পেরিয়ে যায় এটা যেন সেই ‘স্লিপিং বিউটি’র দুর্গ যেখানে সবাই তাকিয়ে আছে তবু যেন ঘুমুচ্ছে পড়ার আলোর আড়ালে। যখন তুমি হাঁটো জোড়ায়-জোড়ায় চোখ তাকিয়ে থাকে, একের পর এক, সারি বেধে আর সারি বাঁধা চোখ, যেন খেলনার দোকানের পুতুল কেবল চোখ নাড়াতে পারে। আমি একটা জায়গা খুঁজে নেই আর বসি, আমি নবাগতের সারি দেখি সূর্যের দিক থেকে আসছে, ভিড়ের রাস্তা থেকে আর সোজা বসে থাকি আর গম্ভীর হয়ে বসে থাকি সমান্তরাল বইয়ের সারি, পড়ার ল্যাম্প আর টেবিলের মাঝে। মননশীল, গুটানো, গম্ভীর। আমার কল্পনা কিন্তু বুনো, স্থানীয় ভার, তোর বোতলটি নাড়াচ্ছে, যখন সে দড়ির উপর থেকে ঠিক মাঝের দর্শকদের হাত নাড়াচ্ছে, আমার বাবা-মা দৌঁড়ে আসে আমাকে ধরতে। এখন তুমি কোথাও আছো পিচ্চি পাজী... এখানে বুড়ো লোকেরাও মাঝে মাঝে আসে, তবে তারা সুরক্ষিত বৃদ্ধ, ঝকঝকে, সংস্কৃতিমনা, পরিস্কার চুল, চশমা, ছোট্ট চামড়ার ব্যাগ, সবকিছু মনে হয় গাথা আছে এক শুদ্ধ বন্ধনে, বিস্ময়কর। আর অবশ্যই, দারূণ সুসজ্জ্বিত ছেলেরা বই আর লেকচার নোট সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে... প্রতিবার তিন কিংবা চার পৃষ্ঠা পড়ার পরই খানিক তাকিয়ে থাকা। আমি পৃষ্ঠা ৩৮-এর দিকে তাকিয়ে থাকবো। আমার সাক্ষী হলো ভলতেয়ার আর লামার্টিনের  উপরে নেয়া বিবিধ নোট। এটা নাকি অন্যটা। কাগজের খচমচ, মেঝেতে চেয়ারের ঘষা, একটা লাইটের সুইট টেপা, একটা বিশাল প্রেম কামনার আকাঙ্খা অবদমিত হয় ক্রমশ একগাদা ছোট্ট ছোট্ট কোলাহলে। সবচেয়ে সুন্দর হলো নিজের মনের ভেতরে চলতে থাকা ভাবনাদের ফিসফিসানি, অস্তিত্ব এবং অর্থহীনতা, কিয়েকেগাদর্ । আর এই শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে অনির্দিষ্ট কামনা-বাসনায় এই সব ছেলেদের কাছে যাওয়ার, দূর থেকে, মগজে মননে, দর্শন কিংবা আইন পড়তে থাকা, তাদের পাঠে একদম মগ্ন তারা... 

এটা একমাত্র লাইব্রেরিতেই ঘটতে পারে। ইউনিভার্সিটির রেস্তোরাঁয়, থালা-বাসনের ঝনঝনানির ভেতর, চামচ উপচে পড়া সবজিতে, বাবা ক্যাফের মতো টেবিলের উপরে ট্রেগুলো দাঁত কেলাচ্ছে, আমার মনে হয়, ছেলেগুলোকে তখন লালায়িত আর এলোমেলো মনে হয়। ওখানে ওরা এতো বেশি যে আমার পক্ষে একজনকে মাত্র বেছে নেয়া কঠিন, অসংখ্য লোকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মতো, যেখানে তারা চিৎকার চেচামেচি করছে, অশ্লীল কৌতুক বলছে। ক্যাফেটেরিয়ার অবস্থা অবশ্য এরচেয়ে উন্নততর নয়, সেখানে অনেক আফ্রিকানও ছিলো, আমি হয়তো আগ্রহী হতে পারতাম, কিন্তু সেটা হলে নিজেকে খুব আলাদা করে নজরে আনা হতো, চিরতরে ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা চিহ্নিত করা যেতো... আমি কারা বিজ্ঞান পড়ছে আর কারা কলা পড়ছে তা আলাদা করে চিনতে শিখে ফেলেছিলাম। রসায়নের ওরা খুব পরিশ্রমী, পোশাক-আশাকে মনোযোগ নেই, আলাদা করে কিছু দেখার নেই, যেন একেকটা মাটির ঢেলা। হয়তো ওরা আমার মতোই। লাইব্রেরিতে আইন আর কলা বিভাগের ছাত্ররা পাশাপাশিই থাকে। আর সেখানে ওদেরকে আমি অবসরে মনোযোগ দিয়ে মাপতাম, দেখতাম ওরা নোট চালাচালি করছে, মাঝে মাঝে কোন রেফারেন্স বইয়ের অজুহাতে যেতাম ওদের কাছাকাছি, মনে মনে ভাবতাম ওরা হয়তো আমাকে খেয়াল করছে, হয়তো আমার পাশের খালি জায়গাটাতেই ওদের কেউ বসবে ইচ্ছা করেই। (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১৪তম পর্ব

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়