ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ষোড়শ শতকের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে ‘গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি’ 

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:১৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
ষোড়শ শতকের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে ‘গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি’ 

গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি

ষোড়শ শতাব্দীর অন‌্যতম নিদর্শন জমিদার বাড়ি শ্রী ধর ভবন তথা গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি।

জমিদার বাড়ির প্রাসাদ সমতল অট্টালিকা, বৈঠকখানা, দরবারগৃহ, অতিথি কক্ষ, সংগীত চর্চা কক্ষ, পুকুরঘাট ও মন্দিরগুলো বিশেষ স্থাপত্যের নিদর্শন কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

প্রতিদিনই জমিদার বাড়িটি দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ভিড় বাড়ছে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না, কতটুকু নৈপুণ‌্য শিল্প গাঁথা এ বাড়িকে ঘিরে। বাড়ির প্রতিটি সুউচ্চ পিলার ও দেয়ালে শৈল্পিক কারুকার্য্য যে কাওকে মুগ্ধ করবে।

জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বারের সামনেই মাঠ ও সাগরদীঘি খ্যাত বিশাল এক পুকুর। তার পাশেই পারিবারিক একটি শিব মন্দির। তারপর শ্রী ধর ভবন নামের মূল ফটক থেকে ৩০০ গজ দূরে অবস্থিত জমিদার বাড়ির মূল অংশ। মূল ফটকের সামনে থেকে প্রায় ১২ ফুট চওড়া আর দু’পাশে নারকেল গাছের সারিবদ্ধ দৃষ্টিনন্দন রাস্তাটি পেরিয়ে যেতে হয় জমিদার বাড়িতে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ গোত্রের একজন শাস্ত্রীয় পণ্ডিত ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে এসে গাঙ্গাটিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সে সময়ে গৌড়ীয় রীতি অনুযায়ী বাড়ির পতিত ভিটায় পূজা অর্চনার জন্য একটি শিব মন্দির স্থাপন করা হয়। ব্রাহ্মণ্য ধ্যান-ধারণা, পূজা-পার্বন, আচার অনুষ্ঠানের কারণে জমিদার পরিবারটি এ অঞ্চলে একটি সময় বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেন।

দীননাথ চক্রবর্তী এ অঞ্চলে প্রথমে জমিদারি প্রথার সূচনা করেন। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে হোসেনশাহী পরগনার এক তৃতীয়াংশ ক্রয় করে জমিদারি তথা তালুকদারি শুরু করেন। পরবর্তীতে দীননাথ চক্রবর্তীর ছেলে অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী ‘পত্তনি’ সূত্রে আঠারো বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরাণীর কাছ থেকে আরও দুই আনা-অংশ গাঙ্গাটিয়া জমিদারির সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করেন। অতুল চক্রবর্তী তার ছেলের নামে বাড়ির মূল ফটকের নামকরণ করেন ‘শ্রী ধর ভবন’। শ্রী ধর চক্রবর্তী ছিলেন জমিদারি বংশের ৩য় বংশধর। জমিদার অতুল বাবুর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইংরেজ আমলে এখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করে।

পরবর্তীতে তার ছেলে ৪র্থ বংশধর ভূপতি চক্রবর্তী দীর্ঘদিন জমিদারি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তারপর জমিদার হিসেবে আসেন, হাইকোর্টের জজ ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক গবেষক দারনাথ চক্রবর্তী। জমিদার পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিরলস চেষ্টা করে গেছেন। তাই এখনও গাঙ্গাটিয়া গ্রামের মানুষের মুখে মুখে জমিদারি বাড়ির নাম ডাক শোনা যায়। 

বর্তমানে গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িতে ভূপতি চক্রবর্তীর বড় ছেলে মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী চৌধুরী বসবাস করছেন। তার ছোট ভাই তপন কুমার চক্রবর্তী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একজন গুণী শিল্পী ছিলেন। প্রায় সাত বছর আগে তিনি পরলোকগমন করেছেন। তাদের দুই ভাই বংশ পরম্পরায় ৫ম বংশধর। এছাড়া, তাদের পরিবারের অনেক আত্মীয়-স্বজন বর্তমানে ভারতের কলকাতায় বসবাস করছেন।

মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী চৌধুরীকে গ্রামের সকলেই ‘বাবু’ নামে ডাকেন। গ্রামের সকল মানুষের কাছেই তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। জমিদারি প্রথা চলে গেলেও এ অঞ্চলের গরিব মানুষদের জন্য তিনি অনেক কিছুই করেছেন, এখনো করছেন।’

জমিদার বাড়িটি দেখে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্নেহা উচ্ছ্বসিত। সে রাইজিংবিডিকে জানায়, ছোট থেকেই এই জমিদার বাড়ির গল্প শুনে আসছি। আজকে এসে আমি এমন একটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ‌্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। এখানে আসতে পেরে আমার খুবই ভাল লাগছে।

ঢাকা থেকে ঘুরতে এসেছেন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী অদিতি বসাক। তিনি রাইজিং বিডিকে জানান, ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধে ঘেরা বাড়িটি খুবই সুন্দর এবং পরিপাটি। শুনেছি ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এ জমিদার বাড়িটি গড়ে উঠে। বাড়ির ভেতর বাহির সবখানেই সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশটা এ বাড়িকে আরও বেশি মনোমুগ্ধকর করেছে।

কাপড়ে হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম কারুকার্য করে থাকেন করবী বসাক পূজা। কিন্তু জমিদার বাড়ির প্রতিটি দেয়াল ও পিলার গুলোতে শৈল্পিক কারুকার্যের ছাপ দেখে তিনি রীতিমত বিস্মিত হয়েছেন। তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এমন সুন্দর একটি জমিদার বাড়ি। অথচ আগে কখনই আসা হয়নি। বাড়িটির চারপাশে সবুজের সমারোহ। মাঝে জমিদার বাড়ির বিভিন্ন রকমের স্থাপনা। খুবই সুন্দর একটি জায়গা।

গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন গুরুচরণ দাস। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বর্তমান বংশধর মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী চৌধুরী এখনো এ বাড়িতেই থাকেন। জমিদারি প্রথা চলে গেলেও এ অঞ্চলের গরিব মানুষদের জন্য তিনি অনেক কিছুই করেছেন, এখনো করছেন। তবে তিনি আগের মতন ততটা স্বাভাবিক নন। বয়সের ভারে অনেক কিছুই তার মনে থাকেনা।’

কিভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনযোগে কিশোরগঞ্জ সদরে পৌঁছাতে হবে। তারপর জেলা শহরের বটতলা মোড় অথবা গাইটাল সরকারি গুরুস্থানের সামনে থেকে মিশুক বা অটোরিকশার মাধ্যমে পৌঁছাতে হবে গাঙ্গাটিয়া বাজার। বাজার থেকে সাগর দিঘীর পাশ দিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে পৌঁছে যাবেন জমিদার বাড়ির মূল ফটকের সামনে। তারপর সেখানে দায়িত্বরত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি নিয়ে ঘুরে দেখতে পারবেন, ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জমিদারবাড়িটি।

কিশোরগঞ্জ/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়