৪৮০ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাইয়ের বিক্রি
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম
বগুড়ার একটি কারখানায় ভাজা হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই
ঈদের আইকনিক খাবার লাচ্ছা সেমাই। এই খাবারটি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ বগুড়া। দেশের বিভিন্ন কোম্পানির লাচ্ছা সেমাই সারাবছর সবখানে পাওয়া গেলেও বগুড়ার লাচ্ছার স্বাদ একবার যিনি নিয়েছেন, তিনি বারবার খেতে চাইবেন। যে কারণে রমজানের শুরু থেকেই ব্যস্ত সময় পার করছেন এই খাবরটি উৎপাদনে জড়িত বগুড়ার ব্র্যান্ড এবং নন ব্র্যান্ডের ব্যবসায়ীরা। সমিতির নেতারা বলছেন, এখানকার লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফলে, এবার এই সেমাইয়ের বিক্রি ৪৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা গত বছরের তুলনায় অন্তত ৫০ কোটি টাকা বেশি।
বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট এন্ড কনফেকশনারী দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতির ‘উত্তরবঙ্গ পরিষদ’ এর তথ্যমতে, বগুড়ায় প্রকারভেদে তিন ধরণের লাচ্ছা সেমাই তৈরি হয়। সয়াবিন, ডালডা এবং ঘিয়ে ভাজা। জেলায় প্রতিবছর রমজান মাসে অন্তত ১৫০টি কারখানায় লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হয়। এরমধ্যে ব্র্যান্ডের কারখানা ৮ থেকে ১০টি। যারা মোড়কজাত করে এই সেমাই বাজারে বিক্রি করে। বাকিগুলো নন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। তারা খোলা বা বাঁশের খাচিতে করে লাচ্ছা সেমাই বাজারে বিক্রি করেন। এসব নন ব্র্যান্ড কারখানায় তৈরি লাচ্ছা সেমাইয়ের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মৌসুমী। সব মিলিয়ে ১৫০টি কারখানায় প্রায় ১৬ হাজার টন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন করা হয়। এসব সেমাই উত্তরাঞ্চলসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং সিলেটের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য যায়।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা ডালডায় ভাজা প্রতি কেজি ১২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডের সয়াবিনে ভাজা লাচ্ছা প্রতি কেজি ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। ব্র্যান্ডের ডালডায় ভাজা লাচ্ছা ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, ঘিয়ে ভাজা ৮০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। বগুড়ার ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে চিনিপাতা, শ্যামলী, এশিয়া, ফুড ভিলেজ, আকবরিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ডালডায় ভাজা, ঘিয়ে ভাজা এবং প্রিমিয়াম কোয়ালিটির লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করে থাকে।
জানা গেছে, লাচ্ছা সেমাইয়ের মূল উৎপত্তি পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীনের আগে বিহারীদের হাতে ধরে এদেশে লাচ্ছা সেমাইয়ের প্রচলন হয়। বগুড়ার অধিকাংশ কারিগররা তাদের কাছে থেকেই লাচ্ছা সেমাই তৈরি শিখেছেন। পঞ্চাশের দশকে সৈয়দপুরে লাচ্ছা সেমাই প্রচুর তৈরি হতো। সেখানকার কারিগরদের হাতে ধরে শিখে বগুড়ায় চালু করা হয়। এরপর কালক্রমে বগুড়াই হয়ে উঠে উত্তরবঙ্গের লাচ্ছা সেমাই তৈরি ও বিক্রির ঘাঁটি।
লাচ্ছা সেমাইয়ের কারিগরদের থেকে জানা গেছে, প্রত্যেক কারখানায় ৮ থেকে ১২ জনের একটি করে দল থাকে। এদের মধ্যে দুইজন খামির তৈরি করে। তিন থেকে চারজন সেমাইয়ের চাকা তৈরি করেন। আর দুই থেকে তিনজন সেই চাকা নিয়ে তেলে ভাজেন। বাকিরা সেমাই খাচিতে তোলার কাজ করেন।
খাজা বেকারির কারিগর শিবগঞ্জ উপজেলার টেংরা এলাকার মো. হাসান বলেন, প্রায় ৫০-৫৫ বছর আগে পাকিস্তানের এক নারী এই লাচ্ছা সেমাই তৈরি করেন। তার মাধ্যমে বাংলাদেশের বগুড়ায় লাচ্ছা সেমাই তৈরি শুরু হয়। আমিও সৈয়দপুরের একজন বিহারি নাম আব্দুল লতিফের কাছে এই সেমাই তৈরি শিখেছি। উনি এখন বেঁচে নেই।
একই উপজেলার মোকামতলা ইউনিয়নের কারিগর মোমিন সরকার জানান, তিনি শুধু ঈদ মৌসুমে সেমাইয়ের কাজ করেন। অন্য সময় তার নিজের বেকারির ব্যবসা দেখেন। তিনি আরও বলেন, এই মৌসুমে আমরা প্রতিদিন ১৬-১৭ বস্তা আটা থেকে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করি। প্রতিদিন ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩ টার দিকে কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।
বগুড়া শহরের কলোনী এলাকার খুচরা বাজারের ব্যবসায়ী মো. নয়ন ইসলাম বলেন, তিনি নন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করছেন গুণমানভেদে ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি। আকবরিয়ার ৩৪০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এশিয়ার সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকা কেজি। শ্যামলীর সেমাই ২৪০ টাকা কেজি। সাদা চিকন সেমাই ১০০ টাকা, ভাজা লাচ্ছা সেমাই ১২০ টাকা কেজি।
গত বছর থেকে ডালডা এবং ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা উৎপাদন করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করেছেন বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা উম্মে ফাতেমা লিসাসহ আরো ৫ জন। গত বছর কাঙ্ক্ষিত বিক্রির পর এবার রোজার আগে থেকেই তাদের কাছে লাচ্ছা সেমাইয়ের অর্ডার আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন লিসা।
লিসা বলেন, গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদন করেও কোন কূল পাচ্ছি না। যে কোনো একটি ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেনিং করে রোমেল, সুজন, মাহমুদাসহ আমরা ৬জন পার্টনার লাচ্ছা সেমাইয়ের ব্যবসার উদ্যোগ নেই। আমাদের মার্কেটিংয়ের মূল প্ল্যাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। গত বছর আমরা ১৩০০ কেজি লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করেছি। এর মধ্যে ৯০০ কেজি ডালডায় ভাজা আর ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা ছিলো ৪০০ কেজি।
তিনি আরও বলেন, এবার ইতোমধ্যে আমাদের ১৪০০ কেজি ডালডায় ভাজা লাচ্ছা সেমাই সেল হয়ে গেছে। ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই রয়েছে ৮০০ কেজি। এখনো অনেক চাহিদা আছে। অনেক অর্ডার আছে। আমাদের ডালডায় ভাজা লাচ্ছা সেমাই ২৭০ টাকা আর ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।
লিসা বলেন, আমরা এখনও আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম সিলেকশন করিনি। বর্তমানে আমার বুটিক হাউস ‘আচল বুটিকস’ এর ব্র্যান্ডেই সেল হচ্ছে। আগামী বছর আমরা পার্টনাররা আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটি নাম সিলেকশন করবো।
বগুড়ার শ্যামলী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের বেকারি শাখার ব্যবস্থাপক কীর্ত্তণ কুমার দাস বলেন, ডালডা লাচ্ছা সেমাই আছে ২৪০ টাকা আর প্রিমিয়াম লাচ্ছা ২৬০ টাকা। এটা আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তবে এবার ঈদ উপলক্ষে বাজার তেমন একটা জমে ওঠেনি। গতবার দৈনিক আমাদের যেখানে ৮০-৯০ হাজার টাকার লাচ্চা সেমাই বিক্রি হতো। এবার ৩০-৪০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
জেলার উত্তরবঙ্গ সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বায়েজিদ শেখ বলেন, বগুড়া লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে দেশসেরা। এখানে প্রচুর দক্ষ কারিগর রয়েছে। স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে অনেক কোম্পানি সেমাই তৈরি করে নিয়ে যায় এখান থেকে। লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা কমে না, বরং প্রতিবছরই বাড়ে। গতবার জেলা থেকে ৪০০ থেকে ৪৩০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। এবার সেই ব্যবসার পরিমাণ অন্তত ৪৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।
বেকারি ব্যবসায়ের এই নেতা আরও বলেন, বগুড়ায় গত দেড় মাস ধরে মৌসুমীসহ অন্তত ২৫০ ব্যবসায়ী লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। প্রতি কারখানায় গড়ে ১০ জন করে কারিগর ধরলে জেলায় আড়াই হাজার মানুষ এ কাজে নিয়োজিত।
জেলা বিসিক কার্যালয়ের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজ রহমান বলেন, বগুড়ায় লাচ্ছা সেমাইয়ের বৃহৎ বাজার রয়েছে। আমাদের বিসিকেও সেমাইয়ের কয়েকটি কারখানা আছে। এখানকার সেমাই উত্তরবঙ্গ ছাড়া ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় যায়। সেমাই শিল্পে উদ্যোক্তা যেভাবে তৈরি হচ্ছে আর এখানে দক্ষ কারিগর আছে তাতে একটা সময় এটা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি হবে।
মাসুদ