ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পরিবারহীন ১২ বন্ধুর এসএসসি জয়

আবু নাঈম, পঞ্চগড় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩২, ১০ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ২০:৩৯, ১০ জুলাই ২০২৫
পরিবারহীন ১২ বন্ধুর এসএসসি জয়

পঞ্চগড়ের আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে বড় হওয়া ১২ বন্ধু এসএসসি পাস করেছে

কেউ হারিয়ে যায় রেলস্টেশনের ভিড়ে, কেউ অবহেলায় ঘর ছেড়েছে শিশুকালে, কেউবা জানেই না তার শিকড় কোথায়। কখনো নিকটতম স্বজনের স্নেহের পরশ পাবার সৌভাগ্যও হয়নি তাদের। নেই প্রতিবেশি, নেই পরিচিত কেউ। পরিবারহীন এমন ১২ বন্ধু এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সবার স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।

অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে উঠে আসা এই ১২ জন কিশোর হলেন- কবির হোসেন হৃদয়, সাব্বির হোসেন, সফিকুল ইসলাম, পারভেজ রানা, আব্দুল মজিদ, সুজন আলী, রাকিবুল হাসান, বরজুল রহমান বায়েজিদ, তাপস চন্দ্র রায়, জিহাদ মিয়া, আল আমিন ও হৃদয় কুমার।

আরো পড়ুন:

ছোট থেকে তারা বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে’। এ বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারা। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের এই অর্জন প্রমাণ করেছে- ভালোবাসা, যত্ন আর সুযোগ পেলে যেকোনো শিশুই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এখন তাদের মতো স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরো ১৬০ জন মা-বাবাহীন শিশু।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমুল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।

জিপিএ- ৪ দশমিক ৯৬ অর্জন করেছেন কবির হোসেন হৃদয়। তার খুব ছোটবেলায় বাবা রিয়াজ ও মা রোকেয়ার বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে অবহেলার শিকার হয়ে পড়ে হৃদয়। এক পর্যায়ে মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে পালিয়ে এসে পথশিশুর পরিচয়ে জীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে কোনো এক রেলস্টেশন থেকে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই হয় তার। বাড়ি ‘নারায়ণগঞ্জ’- এটুকুই মনে আছে হৃদয়ের। প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার।

জিপিএ-৪ দশমিক ৮২ পাওয়া আব্দুল মজিদ জানান, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডারে তার বাড়ি। বাবা-মা, পরিবার সবই আছে তার। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে হারিয়ে গেলে ঠাঁই হয় এখানে। পরবর্তীতে পরিবারের সন্ধান মিললেও এখানেই থেকে যান। তিনি বলেন, ‘‘শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাস করবো- এটা ছিল স্বপ্নের মতো। পাস করেছি, এই অনুভুতি বুঝাতে পারব না। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।’’ 

জিপিএ-৩ দশমিক ৮২ পেয়েছেন বরজুল রহমান বায়েজিদ। তিনি বলেন, ‘‘আমার বাড়ি বরিশালে; বাবা হারুন, মা পারভীন- এতটুকুই জানি। ২০১৪ সালে বাড়ি থেকে অভিমান করে বের হয়ে আর ফিরতে পারিনি। এরপর ঠাঁই হয় এখানে। এখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই এবং এ বছর এসএসসি পাস করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরো ভালো করতে চাই।’’

সাব্বির হোসেনের রেজাল্ট জিপিএ-৪ দশমিক ৭৫। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হওয়া এই কিশোর জানে না তার বাড়ি কোথায়। তার শুধু মনে আছে- বাবার নাম মারুফ, মায়ের নাম ছবি আক্তার। তিনি বলেন, ‘‘কখনো কারো আদর স্নেহ পাইনি। আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন কি-না তাও জানি না। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক।’’

জিপিএ- ৪ দশমিক ৫০ পাওয়া সফিকুল ইসলামের মায়ের নাম সুখী আক্তার। কিন্তু মা-ছেলে দুজনই সুখহীন। সফিকুলও জানে না তার বাড়ির ঠিকানা। শুধু মনে আছে, বাবার নাম আব্দুস সালাম, মা সুখী আক্তার। মা-বাবাকে খুঁজে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সফিকুলের। মা সুখী আক্তারকে দেখতে চান প্রকৃত সুখী হিসেবেই। 
একই রকম গল্প জিপিএ- ৪ দশমিক ২১ পাওয়া পারভেজ রানারও। শুধু মনে আছে, তার বাবার নাম হারুন, মা পারুল। খুব ছোট বেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হলে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এখানে ঠাঁই হয় তার।

সুজন আলী পেয়েছে জিপিএ- ৪ দশমিক ১৪। তিনি জানান, বাবা আব্দুল হামিদ ও মা আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে কোনো এক রেলস্টেশনে গিয়েছিলেন। সেখানে ভিড়ের মধ্য থেকে হারিয়ে যান তিনি। শুধু মনে আছে ভৈরব কিশোরগঞ্জে তাদের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘‘বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে। জানি না কখনো তাদের কাছে ফিরে যেতে পারব কি-না!’’

জিপিএ-৩ দশমিক ৬৮ পাওয়া তাপস চন্দ্র রায় কখনো বাবাকে দেখেননি। তার জন্মের পরপরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা সুকুমার রায়। বেঁচে আছেন কি-না তাও জানেন না। তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, মায়ের নাম শিঞ্জিবালা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সি ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ১২ জনের মতো প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকে রয়েছে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া। জানে না নিজের পরিচয়। আবার কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। এমনও আছে কারো বাবা-মা কেউ নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছে তারা। সময়মত পড়ালেখা, বাকিসময় খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে পার করে তারা।

শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম জানান, শিশুদের এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। সদ্য এসএসসি পাস করা ১২ জনও এখান থেকে প্রাথমিক শেষ করেছিল। শিশুদের যাবতীয় খরচবহনসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।

শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান জানান, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাঁই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হওয়ার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে। এ পর্যন্ত এখানে থাকা ২৪ জন এসএসসি পাস করেছে। 

তিনি আরো জানান, আহছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য হলো- এই শিশুদের ১৮ বছর পূর্ণ হলে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সদ্য এসএসসি পাসদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।

আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দীপক কুমার রায় বলেন, ‘‘অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ১২ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সবার ভালো ফলাফল করেছে, এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে।’’ 

ঢাকা/বকুল 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়