ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কোহাতির জন্য গর্ব করে সাঁওতালি গ্রাম 

মঈনুদ্দীন তালুকদার হিমেল, ঠাকুরগাঁও || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ১৫ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ১৯:০৭, ১৫ জুলাই ২০২৫
কোহাতির জন্য গর্ব করে সাঁওতালি গ্রাম 

ট্রফি হাতে কোহাতি কিসকু

মিয়ানমারে বাছাই পর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে এশিয়া কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত পুরো দেশ। আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে ভারত সীমান্তবর্তী ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত এক সাঁওতালি গ্রামেও। 

কর্মব্যস্ত এই অজপাড়া গাঁয়ের সব মানুষ এখন ফুটবলপ্রেমী। নিয়মিত টিভির পর্দায় দেখেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলা। কারণ, সম্প্রতি অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া নারী ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য কোহাতি কিসকু এই গ্রামেরই সন্তান। 

আরো পড়ুন:

ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার এই সাঁওতালি গ্রামের নাম রাঙাটুঙ্গী। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের বিনোদনের অন্যতম খোরাক ফুটবল। কারণ, এই গ্রামের এক সন্তান এখন জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য, আরেকজন সাবেক সদস্য। তাদের খেলা দেখতে দেখতে গ্রামবাসীও হয়ে গেছেন ফুটবলের ভক্ত। কোহাতি কিসকুর বড় বোন সোহাগী কিসকুও জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। সোহাগী কিসকু ২০২২ সালে সাফ গেমসে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। 

মিয়ানমার সফর শেষে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। ছুটিতে নিজ গ্রামে ফিরেছেন কোহাতি কিসকু। তার আগমনে গ্রামজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। কোহাতি কিসকুকে নিয়ে গর্বিত এই সাঁওতালি গ্রাম।

এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেই কোহাতির গ্রামে যান রাইজিংবিডি ডটকমের এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে বিস্তারিত জানা গেছে কোহাতির জীবনের গল্প। দারিদ্র্যের ঝুপড়ি ঘর থেকেই মাটির পিদিমের মতো আলো ছড়িয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই নারী ফুটবলার। সেই আলো বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। সমাজের নানা লাঞ্ছনা ও তিরস্কার উপেক্ষা করে আজ বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের রক্ষণভাগের ভরসার নাম কোহাতি কিসকু। 

ফুটবল খেলে দেশের নারী ফুটবলের ভাগ্য পরিবর্তন করলেও পরিবর্তন করতে পারেননি নিজ পরিবারের ভাগ্য। এখনো দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করছে তার পরিবার। জরাজীর্ণ বাড়িতেই তাদের বসবাস। 

রাঙাটুঙ্গী থেকে কোহাতির জাতীয় দল পর্যন্ত আসার গল্পটা সংগ্রামমুখর। ছোটবেলায় এলাকাবাসীর বিভিন্ন কটূ কথা উপেক্ষা করে মনযোগী হন ফুটবলে। আজ তিনি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে রক্ষণভাগ নিয়মিত সামলাচ্ছেন। দেশকে এনে দিয়েছেন সাফ চাম্পিয়নশিপসহ এশিয়া কাপ বাছাই পর্বে বড় বড় জয়। 

কোহাতির বাবা গুলজার কিসকু কৃষক। কোহাতিরা তিন বোন, দুই ভাই। বড় বোন সোহাগী কিসকু জাতীয় দলে খেলে আসা ফুটবলার। তাকে রাঙাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমিতে খেলার সুযোগ করে দেন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম। ২০১৮ সালে প্রথমবার বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি।

রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কোহাতি কিসকু জানিয়েছেন তার স্বপ্নের কথা। তিনি তার দলকে নিয়ে যেতে চান বিশ্বকাপের মঞ্চে। করতে চান আরো ভালো কিছু।

কোহাতি কিসকু বলেছেন, “অনেক কষ্ট করেছি ছোটবেলায়। মানুষের কটূ কথা শুনতে হয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল। তবু, তাজুল স্যারের হাত ধরে ফুটবল খেলতে শুরু করি। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা ছিল জাতীয় দলে খেলার। আজ সে স্বপ্ন সফল হয়েছে। তবে, এখন মনে আরো বড় স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। এ স্বপ্ন আমার দলকে নিয়ে। এশিয়া কাপে ও বিশ্বকাপের মঞ্চে আমার দল ভালো কিছু করবে, এটাই চাওয়া।”

রাঙাটুঙ্গীর গ্রামের আলবার্ট তির্কি বলেন, “আমাদের জাতির (সাঁওতাল) মেয়েরা জাতীয় ফুটবল দলে খেলে। এতে আমরা খুবই খুশি। কোহাতি আমাদের গর্ব। ওর কথা আমরা সব জায়গায় বলি। আমরা চাই, ও আরো ভালো খেলুক। আমাদের আরো অনেক নারী ফুলবলে মনযোগী হোক।”

একই এলাকার সারসারি তার্না বলেন, “আমরা আগে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কথা বলেছি। মেয়েদের ফুটবল খেলাকে খুবই খারাপ চোখে দেখেছি। আমাদের মেয়েদের খেলতে যেতে দিইনি। এখন আফসোস হয়, আমার মেয়েকে কেন ফুটবল খেলতে দিলাম না।”

কোহাতির বাবা গুলজার কিসকু বলেছেন, আমার মেয়ে ফুটবলের বড় মঞ্চে বড় জয়ে অবদান রাখায় আমি আনন্দিত। পরিবার ও এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের খেলা দেখি। তবে, মেয়ে সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা পাচ্ছে না। আমার দুই মেয়ে এখন ফুটবলের সঙ্গে জড়িত। এক মেয়ে জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়, আরেক মেয়ে এখন খেলছে। তবু, আমাদের পরিবারে অভাব-অনটন লেগেই আছে।

কোহাতির মায়ের মুখেও শোনা গেলো একই আক্ষেপ। তিনি বলেন, প্রথমে যখন বড় মেয়ে ফুটবল খেলা শুরু করে, সে সময় মানুষ অনেক কটূ কথা বলত। তারাই এখন উৎসাহ দিচ্ছে। তবে, দুই মেয়ে জাতীয় দলে ফুটবল খেললেও অভাবের সংসারে তেমন পরিবর্তন আসেনি। মেয়ে সঠিক সময় বেতন-ভাতা পাচ্ছেনা।

রাঙাটুঙ্গী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতা ছটকা কিসকু বলেন, সাঁওতাল মেয়েরা আজ বড় জায়গায় খেলছে। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের। সাঁওতাল মেয়েরা যেন আরো এগিয়ে যেতে পারে, সে চেষ্টা করে যাব। অন্য মেয়েদের ফুটবল খেলতে উৎসাহ দিই। এলাকার সবাইকে নিয়ে ফুটবল খেলা দেখি। কোহাতি এই এলাকাকে ফুটবলপ্রেমী এলাকায় পরিণত করেছে।

কোহাতিসহ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে সাতজন ফুটবলার উপহার দিয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমি। এর পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাইজুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার নারী ফুটবলের উন্নয়নে আরো বেশি মনোযোগী হলে বাংলাদেশের নারীরা বাংলাদেশকে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিতে পারবে। আর্থিক উন্নয়নে কাজ করতে পারলে আরো বেশি বেশি মেয়েরা এ খেলায় আগ্রহী হবে।

কোহাতি ছাড়াও জাতীয় ফুটবল দলের দুই সদস্য স্বপ্না রানী ও মোসা. সাগরিকা ঠাকুরগাঁওয়ের সন্তান। বিভিন্ন সময়ে এ জেলা থেকে আরো কয়েকজন খেলেছেন জাতীয় দলে। মিয়ানমারে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ভালো ফল করায় উচ্ছ্বসিত গ্রামের বাসিন্দারা। খেলোয়াড়দের বাসায় অভিনন্দন জানাতে ভিড় করছেন তারা।

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়