রণদা প্রসাদের বাড়িকে ভারত বলছে সত্যজিতের, ভাঙা বন্ধ
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
ময়মনসিংহ নগরের হরিকিশোর রায়রোডের ২০০ বছরের পুরনো বাড়িটি ইতোমধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে
ময়মনসিংহ নগরের হরিকিশোর রায়রোডে ২০০ বছরের পুরনো একটি বাড়ি ভেঙে শিশু একাডেমি গড়ার উদ্যোগের সমালোচনার মধ্যে ভাঙা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) বিকেলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের হলরুমে সভা ডেকে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম জানিয়েছেন, বাড়িটি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের কারো নয়। তবে সেখানে শিশু একাডেমি নির্মাণ হবে কি-না, সেই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহার করা হতো নগরের হরিকিশোর রায় রোডের প্রাচীন বাড়িটি। ময়মনসিংহের গবেষক, সুশীল সমাজের নেতারা জানিয়েছেন, বাড়িটি টাঙ্গাইলের দানবীর রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহার অস্থায়ী বাসভবন। সম্প্রতি পুনর্নিমাণের জন্য বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করলে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর আজ বুধবার (১৬ জুলাই) স্থাপনাটি ভাঙা বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ।
বাড়ি ভাঙার খবর প্রকাশের পর মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপ্যাধায় বক্তব্য দেয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়। রাতেই জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাড়িটি পরিদর্শন করেন। বাড়িটির মালিকানা নিয়ে জটিলতার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভেঙে ফেলছে। বাংলাদেশ সরকারকে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।
ময়মনসিংহের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের গবেষক স্বপন ধর বলেন, ‘‘২০১৬ এবং ২০১৭ সালে, এই দুই বছর জার্মানের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্থাপনা নির্ধারণে ১০ সদস্যের টিম গবেষণা করি। সেই টিমের প্রধান ছিলেন ফ্রান্সের বিশিষ্ট পুরাকীর্তিবিদ রোমেন লারছা। তিনি জেলার এ ভবনটিসহ ৩২০টি স্থাপনা তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬টি ভবন এবং ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ৫৪টি ভবন সনাক্ত করা হয়। বাকিগুলো ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকেও এ বাড়ি ভাঙার সুযোগ নেই।’’
তবে তিনি বলেন, ‘‘এ বাড়িটিকে বলা হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের। বিষয়টি কোনোভাবেই সত্য নয়। এটি রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ি। সেটি পানির মতো পরিষ্কার। সেখানে বিন্দু পরিমাণ ভুল হওয়ার সুযোগ নেই।’’
ঐতিহ্যবাহী পুরনো বাড়ি
সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজনের ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সভাপতি আলী ইউসুফ বলেন, ‘‘একটি পক্ষ বাড়িটিকে সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ভুল তথ্যের কারণে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় হচ্ছে। আমরা চাই, সরকার দ্রুত এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবে। এখানে যে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি ভাঙা হয়নি, তা পরিষ্কার করবে।’’
সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘একটি বাড়ি ভাঙাকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্থাপনাটির সব কিছু ঠিকঠাক রেখে এখানে সুন্দরভাবে শিশু একাডেমি তাদের কার্যক্রম চালাতে পারত। ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য।’’
জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মেহেদী জামান জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সেখানে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ২০১২ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক লোকমান হোসেন মিয়া ২৪ শতাংশ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বাড়িটি শিশু একাডেমির নামে লিজ দিয়েছিলেন। সেখানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী (এলজিইডির) অর্থায়নে একতলা ভবন নির্মাণের জন্য বাড়িটি ভাঙা হচ্ছিল।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের শশীলজ জাদুঘরের মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন বাড়িটি ভাঙার ব্যাপারে তথ্য চেয়ে গত সোমবার জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছেন। বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িটি ভাঙা নিয়ে সমালোচনা তৈরি হলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম করা হবে।’’
বুধবার বিকেল ৪টার দিকে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম তার কার্যালয়ে সুশীল সমাজের নেতাদের সভা ডাকেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন কাগজপত্র ঘেঁটে এবং গবেষক, লেখক এবং সুশীল সমাজের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়িটি সত্যজিৎ রায় অথবা তার পূর্বপুরুষের নয়। তবে সেখানে কী হবে, না হবে; সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।’’
ঢাকা/মিলন/বকুল