ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গল্প: স্বপ্নের শূন্যস্থান

মুহা. ইকবাল আজাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০  
গল্প: স্বপ্নের শূন্যস্থান

উঁচু ভবনের দীর্ঘ হাসপাতাল। এর চারদিকজুড়ে মানুষের শোরগোল। একটা অশান্ত পরিবেশে বসে আছি। বই পড়ছি। বাস্তবে আমার খুব কমই বই পড়া হয়। যখন কোনো সমস্যায় থাকি, তখনই বই পড়ি। নিরানন্দ সময়টাকে একটু হলেও উপভোগ করি। শেষবার যখন বই পড়েছিলাম, তখন আমার প্রচণ্ড জ্বর। উঠে বসার শক্তি ছিল না। মাথা কাত করে বইয়ে চোখ বুলিয়েছি। হাসপাতালের একটা কাঠের টুলই আপাতত আমার ক্ষণস্থায়ী বাসস্থান। এখানে এক স্থানে বেশিক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকার জো নেই। ছারপোকা অত্যাচার করে।

বইয়ের পাশাপাশি আমাকে ছারপোকা নিধনেও মনযোগ দিতে হয়। সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ কিছুটা নিম্নমানের হবে, এটা অনুমিত ছিল। আমার চাচা সপ্তাহখানেক ধরে এখানে ভর্তি। ষষ্ঠ তলার আইসিইউ বিভাগের সাত নম্বর বেডে। বেশ কিছু দিন ধরে আমার সকাল-সন্ধ্যা এখানেই কাটে। চাচার দেখাশোনা করতে হয়। আমি, চাচি এবং ভাইয়ারা মিলেই হাসপাতালে ভাগাভাগি করে থাকি। চিকিৎসালয়কে আমার ভিন জগতের কারাগার মনে হয়।

বদ্ধ পরিবেশ। অনেকগুলো মানুষের বসবাস। চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না, আহাজারি। ঔষধের কড়া বিশ্রী গন্ধ। এত কিছুর মাঝেও মানুষগুলো যেন নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। শুধু মরে যাওয়ার নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। চাচার অসুস্থতা আমার মন বিষিয়ে দেয়। মস্তিষ্কে নানা চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটে। দুর্ভাবনার রেশ কাটাতে পুস্তকই আমার সেরা বন্ধু। গল্প পড়তে গিয়ে আমি চরিত্রের মাঝে হারিয়ে যাই।

মুহূর্তের জন্য সব জাগতিক বিষয় ভুলে থাকি। হয়ে উঠি যেন খোলা আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ। আমরা মোটা বেঞ্চের মাঝামাঝি অংশ দখল করে বসি। বেঞ্চের বাকি দুই কোণায় আরও দুটি পরিবার। আর তিনজনের দূরত্ব বজায় রেখেছে কয়েকটা পাতলা কাপড়ের অ্যাপ্রোন আর মাস্ক। এসব পরে নির্দিষ্ট বিরতিতে সবাই তার রোগীকে গিয়ে দেখে আসে।

এতটুকুই আমাদের সাধ্যের কর্ম-কর্তব্য। বেঞ্চের ডানপাশে একজন বোরকা পরিহিতা আন্টি বসেন। উনার স্বামী অসুস্থ। এ জগতে স্বামী আর একমাত্র ভাই ছাড়া আপনজন কেউ নেই। আমার চাচি উনার করুণ গল্প শুনে দিন কাটান। আবার দুজনে একসঙ্গে কান্না করেন।

পাটি বিছিয়ে একত্রে নামাজ পড়েন। আমাদের ঠিক বিপরীতে তথা বেঞ্চের আরেক কোণায় মোটাসোটা একটা ছেলে বসে থাকে। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে সবাই মিলে অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। হাসপাতালে আড্ডা দেওয়া আমার কাছে বেমানান লাগে। অবশ্য তাদের নিয়ে আমার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু উচ্চহাসি আমার মনযোগে বিঘ্ন ঘটায়। কখনো বিরক্ত ভরা চোখে তাকিয়ে থাকি। কখনো বা বই গুটিয়ে বসে থাকি।

সকাল থেকে চাচি অঝোরে কান্না করছেন। কান্না থামাতে আমি বৃথাই চেষ্টা করছি। গতকাল বিকেলে বোরকাওয়ালী আন্টির স্বামী মারা গেছেন। চাচী তাতেই ভেঙে পড়েছেন। আন্টি আমার পাশে বসে গতকাল সশব্দে খুব করে কেঁদেছেন। আমি নির্বিকার। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাইনি। মাথা নিচু করে চিৎকারগুলো শুনে গেছি। কান্না করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলছিলেন উনি। পানি চেয়েছিলেন। আমি অ্যাম্বুলেন্সে দুটো পানির বোতল দিয়ে এসেছি। নিঃসন্তান ভদ্র মহিলাটি আমার মাথা ছুঁয়ে দোয়া করে গেছেন। চাচির বিলাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

ভাই চাচিকে বাসায় রেখে আসতে গেছে। পুরো হাসপাতালে আমি একা। একটু পরে ডাক আসলো ‘সাত নাম্বার।’ বুকটা
ধক করে উঠলো। আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে। দ্রুত আইসিউতে প্রবেশ করতেই দেখি চাচার ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক বেড়েছে। সঙ্গে শ্বাসও দীর্ঘতর হচ্ছে। ‘রোগীর অবস্থা ভালো না। লাইফ সাপোর্টে নিতে হতে পারে।’ অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তার খুব দ্রুত সাইন করার পরামর্শ দিলেন। আমি চোখে ঝাপসা দেখছি। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছি। কাউকে হারিয়ে ফেলার বড্ড ভয় হচ্ছে। চাচার জীবন যুদ্ধের পরাজয় এতো দ্রুত দেখতে চাই না। একটু পরে ভাই এসে কাঁপা হাতে স্বাক্ষর করেছেন।

চিন্তায় আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। একটু পর পর মানুষ মারা যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো ব্যস্ততা নিয়ে ছুটছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে শূন্যতা। আগামীকাল ঈদুল আজহা। অনেকের স্বজনরা বাড়ির পথ ধরেছেন। আজকে কথা বলার পাশের আন্টিও নেই। আমি জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ এ চোখ ডুবিয়েছি। দেশই যে মানুষের জীবনের সত্যিকারের প্রেমিকা, মুনিম তা গল্পে প্রমাণ করেছে। সালমা তার স্বামীকে ছাড়া কী শক্ত ভাবেই না বেঁচে আছে! মার্তৃভাষার জন্য কতটা আত্মত্যাগী ছিলেন বাংলার শিক্ষার্থীরা। ডলি কি আর মুনিমের কাছে ফিরবে? সালমা কি তার সাহসী পতিকে ফিরে পাবে? আমি চিন্তার রাজ্যে তলিয়ে গেছি। সম্বিত ফিরে মোটা ছেলেটার ডাকে।
‘ভাই, আমি অভ্র।’
‘আমি আজাদ।’
‘আপনাকে দেখি সারাদিন গল্পের বই পড়েন। আপনি কোথায় পড়াশোনা করেন?’
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’

অভ্র অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় আমি রূপকথার রাক্ষসকে পরাজিত করা সেই পালোয়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার আগে আমিও ঢাকা ভার্সিটি শুনলে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতাম। অভ্র নিজের সম্পর্কে একের পর এক বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। সে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বড় বোন বিবাহিত। ছোট বেলায় অভ্রের বাবা ইহধাম ত্যাগ করেন। বাবার ব্যবসাটা তার মা আঁকড়ে ধরে আছেন। তাতেই চলে সংসার।

গত ১০ দিন ধরে পরিবার নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। অভ্র ঘরের ছোট সন্তান। এবার নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। তার মায়ের খুব ইচ্ছে, ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। হয়তো প্রত্যেক মায়ের এমন আকাঙ্ক্ষাই থাকে। আমার মাও যে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য কতো উপাসনা করেছেন! শীতল পাটি বুনে তা বিক্রি করে আমার কোচিংয়ের টাকা জমিয়েছেন। মায়ের প্রার্থনা বিফলে যায়নি। আমি ঢাবিতে চান্স পেয়েছি। মাকে ধরে সেদিন অঝোরে কেঁদেছি। এটা কষ্টের কান্না নয়। এটা সুখাশ্রু। তৃপ্তির জল।

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য কাউকে ছুটি দেয়নি মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের স্টাফ ছাড়া জনসমাগম নেই বললেই চলে। আমরা দু’ভাই ঈদের প্রথম জামাতে নামাজ পড়ে হাসপাতালে হাজির। অভ্র ঢাকার বাসিন্দা। সেও হয়তো নামাজ পড়ে আসবে। আমার চাচার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতিবেগ বেশ বেড়েছে। রক্তচাপ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় আত্মবিশ্বাসের খেই হারিয়ে ফেলছি। কয়েকবার বই হাতে নিলেও পড়ার আগ্রহ পাচ্ছি না। অভ্র দুপুরে হাসপাতালে এসেছে। দুই টিফিন ক্যারিয়ারে পোলাও আর গরুর মাংস ভর্তি করে নিয়ে এনেছে। একটার খাবার আমাদের জন্য। আরেকটা সে একা খাবে। গরুর মাংস দেখলে নাকি তার হুঁশ থাকে না।

তার মা গরুর মাংসের কালোভুনা আইটেমটা খুব ভালো রান্না করতে পারেন। আমরা বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। স্বল্প বিরতিতে আমাদের জন্য আনা খাবার অভ্র রাক্ষসের মতো সাবাড় করে ফেললো। আমি অবাক চোখে তার ভুঁড়িভোজ দেখছি। সে আজ একবারও তার মা’কে দেখতে আইসিইউতে প্রবেশ করেনি। মাংসের লোভ তা ভুলিয়ে দিয়েছে। আমার ‘আরেক ফাল্গুন’ পড়া শেষ।

ডলির প্রত্যাবর্তন গল্পটিকে সুন্দর করেছে। আসাদের জন্য খুব মায়া হচ্ছে। তার মা নেই। তাকে কেউই দেখতে আসেনি। যার মা নেই, সে বুঝে পৃথিবীর রঙ কত বিবর্ণ। সিকিউরিটি এসে নম্বর হাঁকে। ১০ নম্বর। এ নম্বরে কেউ আছেন? ১০ নাম্বার বেড অভ্র’র মায়ের। অবস্থা বেশ খারাপ। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বললেন। কিন্তু অভ্র-ই যে হাসপাতালে নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে সে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে। এখনো ফিরেনি।

এদিকে আমার চাচার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ভাইয়ার মুখ মলিন। বারংবার বইয়ের মধ্যে মনযোগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। সন্ধ্যায় ফেরে অভ্র। এসেই গালগল্প জুড়ে দেয়। আজ সারাদিন কি কি করেছে ইত্যাদি। বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছে। ঈদের ফাঁকা ঢাকার গল্প। তেজী গরুর দৌঁড়ে পালানোর গল্প। আরও কত কি!

অভ্রকে দেখেই ভাইয়া বললেন, ‘তোমাকে সিকিউরিটি এসে খুঁজে গেছে।’ 'ওরা খুঁজবেই ভাই। পরে যাবো।’ অভ্র ভাইয়ার কথাটি গ্রাহ্যই করেনি। আবার কথা জুড়ে দেয়। পড়াশোনা নিয়ে কথা। মায়ের স্বপ্ন নিয়ে কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতির কথা। দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে সে যথেষ্ট অভিজ্ঞ।

গত কয়েক দিন আগে পড়া সাধারণ জ্ঞানের শীটগুলো জাবর কাটছে। প্রতিটা অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনর্গল বলে যাচ্ছে। ছেলেটা যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু বেশ উদাসীন। সিকিউরিটি এবার জোর গলায় হাঁকে, দশ নম্বর বেড। অভ্র উঠে দাঁড়ায়। এপ্রোণ আর মাস্ক পরে রওয়ানা হয়। মায়ের জন্য আনা দুধ আর গরম পানি নিয়ে আইসিইউতে ঢুকে। সিকিউরিটি দূর থেকে আবার ডাকে, সাত নম্বর।

আমি চমকে উঠি। ভয়ে কাঁপুনি দেয় পুরো শরীর। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটে গেলো! কাছে যেতেই আমাকে বলে, ‘কি ভাই, মন খারাপ করে আছেন কেন?’ আমার চোখ দিয়ে জল বেয়ে পড়ে। তবে বুঝি, চাচা নেই! সিকিউরিটি আমার হাতে একটা ঔষধের ফর্দ ধরিয়ে দেয়। বলে, ‘ঔষধগুলো নিয়া আসেন, আল্লাহ সারানোর মালিক।’ চোখ মুছতে মুছতে ইলেক্ট্রিক যন্ত্র বেয়ে নিচে চলে যাই।

ঈদের ছুটিতে ডাক্তারদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের দোকান বন্ধের কোনো অবকাশ নেই। তারাও দোকান খুলে বসে আছে। আনন্দের চেয়ে আত্মত্যাগই যেন পরম তুষ্টি। ঔষধ নিয়ে যখন হাসপাতালে ফিরি। তখন ছয় তলা জুড়ে কান্নার রোল পড়েছে। অভ্রের কান্নার উচ্চস্বরে পুরো হাসপাতাল কাঁপছে। একটু উদাসীন না হলে শেষ মুহুর্তে মায়ের অন্তিম চাহনিটা দেখতে পারতো। মার্তৃবিয়োগের চিৎকার সে কি বিষাদময়! অভ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে আমি সান্ত্বনা দিচ্ছি।

স্টাফরা লাশ বের ব্যবস্থা করলেন। রাত ১০টা। আমরা অ্যাম্বুলেন্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অভ্রের মাকে সকালে গ্রামের বাড়িতে মাটি দেওয়া হবে। চলে যাওয়ার আগে আমার গলা জড়িয়ে অনেকক্ষণ বিলাপ করলো ছেলেটি। গাড়ি ছাড়ার পূর্বে একটা কথা মনে গেঁথে গেছে, ‘ভাই, দোয়া করবেন যেন আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। মায়ের স্বপ্নের শূন্যস্থানটা পূরণ করতে পারি’। ‘ইনশাআল্লাহ ক্যাম্পাসে দেখা হবে।’

অ্যাম্বুলেন্স আড়ালে মিলিয়ে গেলো। আমি ফাঁকা রাস্তায় তাকিয়ে আছি। ছেলেটা খুব আত্মবিশ্বাসী। হয়তো মাতৃবিয়োগ তাকে আরও উদ্যমী করে তুলবে। ভাগ্য ভালো হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পাবে। কিন্তু আনন্দে জননীকে জড়িয়ে ধরে কান্নার আর সুযোগ হবে না। আসাদের মতো মা শব্দের উচ্চারণে আড়ালে গিয়ে অশ্রু ঝরাবে। আমি আনমনে কত কি চিন্তা করছি। অভ্রের চরিত্রে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে কল্পনা আঁকছি। সহসা পেছনে থেকে কে যেন ডেকে উঠলেন- এই সাত নম্বর আছেন? সাত নম্বর?

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহফুজ/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়