ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ‘সায়েন্স বি’ 

অন্বয় দেবনাথ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৯, ৮ জুন ২০২১   আপডেট: ১২:৩০, ৮ জুন ২০২১
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ‘সায়েন্স বি’ 

আমাদের দেশে জিপিএ-৫ ধারীর অভাব না থাকলেও আগ্রহ নিয়ে বুঝে বুঝে পড়বে এমন শিক্ষার্থীদের যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। E=mc2সূত্র জানা লোকের অভাব না থাকলেও এই সূত্র সৃষ্টির কারণ জানা লোকের বড্ড অভাব রয়েছে। জিপিএ-৫ পাওয়ার আশায় শিক্ষার্থীরা যেমন মুখস্ত বিদ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, ঠিক তেমনি বাবা-মাও সন্তান পড়াশোনা করে আনন্দ পাচ্ছে কিনা এই বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে তার যেন জিপিএ-৫ মিস না যায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে বেশি উদ্যোগী। কিন্তু হওয়া উচিৎ ছিল এর উল্টোটি। 

আমরা কৌতুহলী, চমৎকার চিন্তাশক্তি রয়েছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে বিজ্ঞানশিক্ষা হতে হবে আনন্দময়। প্রশ্ন করলে শিক্ষার্থীদের ধমক দিয়ে দমিয়ে না দিয়ে তাদের উত্তর যথাযথভাবে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি নিজের চিন্তাশক্তিকে যতটা শাণিত করতে পারবো, ততই শক্তিশালী বিজ্ঞান নির্ভর এক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। 

পত্রপত্রিকায় হরহামেশাই বিদেশি বিভিন্ন বিজ্ঞানীর নোবেল পুরস্কার জয়ের এবং তাদের অনন্য অবিষ্কারের খবর চোখে পড়ে। আর আমাদের? বছরে একটা কি দুইটা খবর চোখের সামনে পড়লে সেটাই অনেক বলে মনে হয়৷ কিন্তু মুখস্ত বিদ্যা থেকে বের হয়ে বিজ্ঞানকে আরও আনন্দের সাথে উপলব্ধি করতে পারলে গণিত, রসায়ন এবং পদার্থের মতো বিষয়গুলো আমাদের জন্য হয়ে উঠতো আরও আনন্দময়, আরও প্রাণবন্ত৷ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের খবরও দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার নিউজের হেডলাইনে ভেসে উঠতো। আর এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই ২০১৮ সালের ৩১ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মবিন সিকদারের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম ‘সায়েন্স বি’।

সায়েন্স বি’র শুরুটা হয়েছিল একটি বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন প্রকাশের মাধ্যমে। মবিন সিকদার ও কিছু বিজ্ঞানপ্রেমী তরুণের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ‘অরবিটাল’ নামের একটি মাসিক ম্যাগাজিন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তারা।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই স্বপ্নের ম্যাগাজিন রূপ বদলে আজ রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইটে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে ‘সায়েন্স বি’র কার্যক্রম।

আর এসব বিষয় সবার কাছে সহজলভ্য ও বোধগম্য করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে সায়েন্স বি’র স্বেচ্ছাসেবকরা। নিজেরা শেখার পাশাপাশি অন্যদেরও বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী করে তুলছেন তারা। 

সায়েন্স বি’র ওয়েবসাইটের প্রথম আকর্ষণ হচ্ছে বিজ্ঞান সংবাদ। এটি বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞান ভিত্তিক সংবাদ প্রচারের জন্য পরিচিত৷ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞানের জগতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেক দিনের আপডেট ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় পড়ার সুযোগ পাওয়া এক অচিন্তনীয় বিষয় ছিল। কিন্তু এই বিজ্ঞান সংবাদের মাধ্যমে সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। 

বর্তমানে ২০০০ এর বেশি শিক্ষার্থী নিয়মিত এই সাইটের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ৫০০ এর বেশি সংবাদ এই সাইটে প্রকাশিত হয়েছে, যার সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও অধিক হারে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

এছাড়াও ওয়েবসাইটে রয়েছে ‘বি ব্লগ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। যেখানে নতুন লেখকদের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখির প্রতিভা ঝালাইয়ের পাশাপাশি অভিজ্ঞ লেখকদের বিভিন্ন তথ্যবহুল লেখার সম্মিলনও। বর্তমানে ব্লগে ২০ জন লেখক নিয়মিত লিখছেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে প্রায় আড়াইশর বেশি লেখা। 

এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ‘প্রশ্নোত্তরে বিজ্ঞান’। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্নোত্তরের আর্কাইভ এটি, যেখানে আছে ৬০০০ এর বেশি প্রশ্নোত্তরের চমৎকার সংগ্রহ। বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্ন চাইলেই এখান থেকে খুঁজে নিতে পারছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া উত্তর না পেলে প্রশ্ন করার সুযোগও থাকছে এখানে। এমনকি বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করার মাধ্যমে নিয়মিত পুরস্কারও জিতে নিচ্ছেন বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীরা। তিন বছরের মাথায় দৈনিক এক লাখ ভিজিটরের মাইলফলক স্পর্শ করেছে ‘সায়েন্স বি’র ওয়েবসাইটটি।

ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সায়েন্স বি ফেসবুকে ‘Science Bee’ পেজ ও ‘Science Bee-বিজ্ঞান গ্রুপ’ এবং ‘এই পোস্টে বিজ্ঞান কই’ নামে দুইটি গ্রুপ পরিচালনা করে। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত প্রশ্ন করতে পারেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একে-অন্যের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পান৷ এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিজ্ঞানের ভীতি অনেকাংশে দূর হয় ও প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে। বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সায়েন্স বি কর্তৃক বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। 

এসব উদ্যোগের পাশাপাশি আরও চমকপ্রদ কিছু তথ্য জানান মবিন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা চার টিমে ভাগ হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৩৫ জনের বেশি সদস্য কাজ করছি। এছাড়াও রয়েছে ১২৫ এর বেশি ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর এবং টিম লিডার। যারা ‘সায়েন্স বি’র সঙ্গে কাজ করে নিজেদের যেমন ঝালিয়ে নিচ্ছেন, ঠিক তেমনি দেশে বিজ্ঞান চর্চাকে জনপ্রিয় করে তুলছেন। 

এছাড়াও ইউটিউবে প্রচার করে হয় ‘দ্য বি শো’ নামে একটি অভিনয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান। যেখানে অভিনয়ের মাধ্যমে ও চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্সের মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে সহজভাবে বোঝানো হয়৷ 

তবে যদি বলতে হয় সায়েন্স বি’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাহলে ফেসবুক লাইভে প্রচারিত ‘লাইভ সায়েন্স’ অনুষ্ঠানটির কথা না বললেই নয়৷ এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা লেখক, গবেষক, নির্মাতা, ওয়েব ডেভেলপার এবং বিজ্ঞানীরা নিয়মিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন ও শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। 

ওয়েব ডেভেলপার এবং লেখক ঝংকার মাহবুব, চলচিত্র পরিচালক ও হলিউডে ভিএফএক্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করা ওয়াহিদ ইবনে রেজা, আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাদাত রহমান, সায়েন্স নিউজ কর্তৃক নির্বাচিত ২০২০ সালের সেরা ১০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন তনিমা তাসনিম অনন্যা, ভিডিও নির্মাতা ফাতিহা আয়াত, চিকিৎসক ড. তাসনিম জারা, গুগলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অনিক সরকারসহ আরও অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি ‘লাইভ সায়েন্স’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন।

সম্প্রতি তিন বছরে পা দিয়েছে বিজ্ঞান চর্চার এই জনপ্রিয় মাধ্যমটি। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশব্যাপী গাছ লাগিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে সংগঠনটি। 

পাশাপাশি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় কেক কাটা হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ চর্চার মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যতে অসংখ্য বড় বড় বিজ্ঞানী এবং গবেষকের সৃষ্টি হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা।

ঢাকা/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়