ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কিশোররা ‘অপরাধী’ কিন্তু ‘আমরা’ দায়ী

ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ৮ জুন ২০২১  
কিশোররা ‘অপরাধী’ কিন্তু ‘আমরা’ দায়ী

‘শিশুরা মোবাইলে আসক্ত’, ‘কিশোর-কিশোরীরা টিকটক ভিডিওতে আসক্ত’, ‘তরুণেরা ড্রাগে আসক্ত’ ‘কিশোর গ্যাং অন্যায় কাজে জড়িত’ এবং ‘শিশুরা মোবাইল গেমে আসক্ত’। এই কথাগুলো সম্প্রতি আমাদের আলোচনায় স্থান পেলেও এই ধরনের উদ্বেগগুলো হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়নি। ধীরে ধীরে আমরাই আমাদের শিশুদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছি। ‘আমরা’ বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে, ‘আমাদের সমাজ’, ‘আমাদের রাষ্ট্র’, ‘আমাদের প্রশাসন’, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা’ এবং ‘আমাদের নিরানন্দ শিক্ষা সংস্কৃতি’। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমি ভিন্ন দেশ থেকে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি। 

উচ্চশিক্ষার জন্য আয়ারল্যান্ডে অবস্থানকালে আমি দেখেছি যে সেখানে শিশুদের উন্নত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিটি কমিউনিটিতে কিছু সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামো আছে। যেমন- খেলার মাঠ, পার্ক ও সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক রাস্তা। এগুলোর প্রতিনিয়ত যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। সেখানকার কমিউনিটি বলতে বাংলাদেশের পাড়া, মহল্লা, গ্রাম বা এলাকাগুলোকে বোঝানো যেতে পারে। শুধু আয়ারল্যান্ড নয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটিগুলোতে এই সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও, মার্কেটগুলোতে রয়েছে আইসক্রিম কর্নার, ফলের সরবত ও চকলেটের দোকান। দোকানগুলো মূলত শিশু, কিশোর ও কিশোরীদের লক্ষ্য করেই বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক পোস্টার দিয়ে সুসজ্জিত করা।

এই সুযোগ-সুবিধাগুলোর কথা আমাদের কাছে বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু, উন্নত দেশগুলোতে সেগুলো খুবই মৌলিক (basic) পর্যায়ের অবকাঠামো। অবশ্য, অভিজাত এলাকাগুলোতে এই সব অবকাঠামোগুলো আরও উন্নত ধরনের ও ব্যয়বহুল পর্যায়ের। কিন্তু, সেখানে সব কমিউনিটিতে খেলার মাঠ ও সাইকেল চালানোরা পৃথক রাস্তা আছে। ফলে, শিশুসহ সব বয়সের নাগরিকেরা সেখানে নিশ্চিন্তে সময় কাটাতে পারেন। মা-বাবা তাদের শিশুদের পার্কে নিয়ে যান। সেখানে কেউ বাস্কেটবল খেলছে, কেউ ফুটবল খেলছে, কেউ স্লিপারে উঠা-নামা করছে, কেউবা রডে ঝুলছে। মা-বাবা বসে তাদের সন্তানদের খেলা দেখছেন। ছুটির দিনে পরিবারের সব সদস্য বাসা থেকে সাইকেল চালিয়ে পার্কে যাচ্ছেন অথবা শপিংমলে যাচ্ছেন আইসক্রিম খেতে ও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। কেউ কেউ শারীরিক চর্চা ও বিনোদনের জন্য সুইমিং পুলে যাচ্ছেন। 

আমাদের দেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে স্কুল আছে কিন্তু খেলার মাঠ নেই। পার্ক আছে নিরাপত্তা নেই। খেলার মাঠ বা পার্কের সুবিধাগুলো অভিজাত এলাকা কেন্দ্রিক। যেমন- ঢাকার ধানমন্ডির লেক। আবার, কিছু অবকাঠামো আছে ব্যক্তি মালিকাধীন। যেগুলোর অর্থনৈতিক চরিত্র বাণিজ্যিক। যেমন- ফ্যান্টাসি কিংডম। বাংলাদেশের কমিউনিটি, পাড়া, গ্রাম বা মহল্লাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি। এর জন্য দায়ী কে?

লাখ লাখ মানুষ বাস করে খুব ঘনবসতি এলাকায়। সেখানে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই। যদিও থাকে, তা অপরিচ্ছন্ন, অনিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মাঠগুলো খুবই ছোট। তাছাড়া, মাঠের অভাবে একটি মাঠে এত মানুষ আসে যে, কেউ ঠিকমতো খেলতে পারে না। ছোট মাঠে একাধিক দল ক্রিকেট বা ফুটবল খেলছে। মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, বাইরে থেকে বোঝা কঠিন কে কোন দলের হয়ে খেলছে। এই ধরনের অনিরাপদ জায়গায় খেলতে গিয়ে প্রায় সময় শিশুদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে শিশু মনেই প্রতিহিংসার জন্ম নেয়। স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবা তাদের সন্তানদের এ ধরনের অনিরাপদ পরিবেশে নিয়ে যাবেন না বা পাঠাবেন না। 

উন্নত দেশগুলোতে একটি চিত্র খুব সাধারণ। সেটি হচ্ছে সাইকেল চালানোর জন্য বড় রাস্তার সাথে পৃথক লেন। সকাল বেলা দেখা যায় যে, সাইকেলের লেন দিয়ে বহু শিশু, কিশোর ও কিশোরী সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এতে, তারা আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান হয়ে উঠে। ব্যবহারিকভাবেই শিখছে যে কিভাবে রাস্তা ব্যবহার করতে হবে ও রাস্তায় আচরণ করতে হবে। তারা শিখছে ট্রাফিক সিগন্যালের অর্থ কি এবং রাস্তায় অঙ্কিত প্রতীকগুলোর অর্থ কি। আমাদের দেশে গ্রামের স্কুলগুলোতে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু, শহরে তা চিন্তাই করা যায় না। কারণ, শহরের রাস্তাগুলোতে প্রচুর গাড়ি, সেখানে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হাঁটতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সেখানে শিশুদের সাইকেল চালানো বা একা হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া তো প্রশ্নই আসে না। আমাদের সড়কগুলো এখনো প্রত্যাশিত নিরাপদ নয়।

ধনী পরিবারের শিশুরা অভিজাত এলাকায় বাস করে। তাদের স্কুলগুলো অভিজাত এলাকায়। তাদের পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হওয়ায় তারা শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কিছু সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করার সুযোগ পায়। এই ধরনের পরিবারের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই কম। বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও গরীব পরিবারের সংখ্যা বেশি। রাষ্ট্র যদি শিশুদের বিনোদনের ও খেলার জন্য অবকাঠামো গড়ে না দেয়, তাহলে অধিকাংশ শিশুই সুস্থ্যভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায় না। ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’-এটি বাস্তবায়ন করতে হলে শিশুদের কি কি প্রয়োজন সেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজকে বিবেচনায় আনতে হবে। শুধু নীতি কথা শিশুর উপর চাপ সৃষ্টি করবে।

খেলার মাঠ যদি না থাকে, তাহলে শিশুর সামনে কি উপায় (option) আছে? খুব স্বাভাবিক যে, যেগুলোতে তারা আনন্দ পাবে সেগুলোর প্রতি তারা আকৃষ্ট হবে। তন্মধ্যে, প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্র অন্যতম। এগুলো ব্যবহার করে সে আনন্দ পেতে চাইবে। তাদের পক্ষে বোঝা কঠিন ইন্টারনেট দুনিয়ায় কোনগুলো মন্দ ও কোনগুলো দরকারি। বুঝতে বুঝতেই তারা বয়সের তুলনায় অনুপযোগী সাইটে প্রবেশ করে এবং উত্তেজনা ও রোমাঞ্চকর বিষয়গুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। নিজের অজান্তেই কিশোর-কিশোরীরা সাইবারবুলি (cyberbully) বা অসম্মান বা বিরক্তি উৎপাদন করে এমন আচরণ করতে থাকে। সাইবারবুলির পরিণতি সম্পর্কে তারা জানে না।

শিক্ষাবিদরা বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে উঠার প্রাথমিক স্থান হচ্ছে পরিবার ও কমিউনিটি। এগুলো থেকে শিশু সৌজন্যমূলক আচরণ, শিষ্টাচার, সহিষ্ণুতা ও নৈতিকতা শেখে। শিশুরা পরিবারের ও কমিউনিটির মানুষকে দেখে শেখে।  আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশে পরিবার ও কমিউনিটি থেকেও শিশুরা প্রয়োজনী প্রাথমিক শিক্ষা পায় না। যেমন-পাড়া ও মহল্লায় দেখা যায় যে, কিশোর ছেলেরা অন্যের আম গাছে ঢিল মারছে। চুরি করে অন্যের গাছ থেকে ফল খাওয়াকে চ্যালেঞ্জ ও আনন্দের ভাবছে। এগুলো থেকেই যে অপরাধের যাত্রা শুরু, সেটি তারা জানে না। 

এছাড়াও, রাস্তায় কুকুর ও বিড়াল দেখলে ইট-পাথর ছুড়ে মারছে। অসহায় প্রাণীদের আঘাত করে আনন্দ পাচ্ছে। নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করছে। এই রুঢ় আচরণগুলো শিশু ও কিশোররা পাড়ার বা পরিবারের বড়দের দেখেই শিখেছে। এগুলো যে অপরাধমূলক, অনৈতি বা অগ্রহণযোগ্য আচরণ সে সম্পর্কে তাকে পর্যাপ্ত শিক্ষা দেওয়া হয়নি। 

সুতরাং, শিশুরা কাঠামোগতভাবে ভিকটিম (victim)। তারা সম্ভাব্য মানব সম্পদ। তাদেরও অধিকার আছে সুনাগরিক হয়ে ওঠা। এই জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিশুরা আনন্দময় স্কুল, খেলার মাঠ ও কমিউনিটি শিক্ষা পায়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

রিয়াদ/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়