ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মায়ের বকা শুনতে শুনতে আমরা ‘নির্বাণ লাভ’ করেছিলাম

আফরোজা খাতুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৭, ১১ মে ২০২৫   আপডেট: ১৫:৪৪, ২৭ মে ২০২৫
মায়ের বকা শুনতে শুনতে আমরা ‘নির্বাণ লাভ’ করেছিলাম

আফরোজা খাতুন

মা দিবসে সবাই মাকে নিয়ে আদর, ভালোবাসা, সংগ্রাম বা বেদনার কথা লেখে। আমি অন্য অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।

আমার মায়ের বিয়ে হয় ১৭ বছর বয়সে। তার যখন ২৭ বছর বয়স, তখন আমরা পাঁচ ভাই-বোন। সংসারের যাবতীয় কাজ একা সামলে পাঁচটা বাচ্চাকে (যারা বানরের নিকট আত্মীয়) সামলানো সহজ কথা নয়। মা সহজে আমাদের মারতেন না। তার  প্রধান অস্ত্র ছিল মুখ। গালি না দিয়েও কি করে যে সারাদিন বকাবকি করা যায়, তা আমার মাকে না দেখলে বোঝা যায় না।

আরো পড়ুন:

তার বকা শুনতে শুনতে আমরা প্রায় নির্বাণ লাভ করেছিলাম। মানে কি যে বলতেন মা, তা আমরা মন দিয়ে শোনারও চেষ্টা করতাম না। তিনি তার মতো বকতেন, আমরা আমাদের মত বাঁদরামি করেই যেতাম।

আমার মায়ের একটা বিখ্যাত উক্তি ছিল, সেটা হল- ‘চুপ করে থাকতে থাকতে যখন মাথা গরম হয়ে যায়, তখনই আমি চিল্লানো শুরু করি।’ আশ্চর্য, চুপ করে থাকলে মানুষের মাথা কেন গরম হবে? মাথা তো গরম হবে চিল্লাচিল্লি করলে, তাই না?

আমার মা, এক অদ্ভূত তত্ত্বের জননী ছিলেন। তা হল, তুলনামূলক তত্ত্ব। যদিও ব্যাপারটা আমাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পেত না। তবুও কয়েকটা উদাহরণ দেই।

আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন এক প্রতিবেশী ভাই আমার সঙ্গেই পড়তেন; অন্য কলেজে। অত্যন্ত নামাজি, ধার্মিক ও সুশৃংখল জীবনযাপন করতেন। সমস্যা হল, সেই ভাই এত জোরে জোরে পড়তেন যে, আমাদের বাড়ি থেকে শোনা যেত। মা প্রায়ই বলতেন, “দেখ তো, ও কত পড়াশোনা করে। আমি সেই ফজর থেকে শুনছি ওর পড়ার শব্দ। আর তুই পড়িস না...!”

এসব একদিন নয়, রোজ রোজ চলত। আরে বাবা, ওর দরকার, ও পড়ুক না। আমার পড়া তো মোটামুটি শেষ। কিন্তু না, সেই ভাই পড়েই যাবেন আর আমার মা বকেই যাবেন। আমি রাগ হয়ে মনে মনে বলতাম, “আরে বাবা, তুই কি ভলিউম কমিয়ে পড়তে পারিস না?”

আমি একদিন ভাবলাম, যাই, গিয়ে দেখি ভাই কি এত পড়ছে সকাল থেকে। গিয়ে দেখি তিনি হৈমন্তীর চরিত্র মুখস্ত করছেন। আমি হাসব না কাঁদব, খুঁজে পেলাম না। আমি কি শেষ অবদি হৈমন্তী চরিত্র পড়ব?

আমরা মায়ের তুলনামূলক তত্ত্বকে, একবার গুরুত্ব দিলাম; বেশ ভালো করেই দিলাম। আমাদের এলাকায় আমাদের তিন বোনের সমবয়সী আরো মেয়ে ছিল। আমার বড় আপা এত ভদ্র যে, তাকে ‘ভেদা মাছ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। দুষ্টু ছিল আমার মেজ বোন। মা বললেন, “দেখিস না অমুক বোরখা পরে, তমুক বোরখা পরে। আর তুই লাফিয়ে বেড়াস।” আমরা এসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেই।

কি কপাল! কিছুদিনের মধ্যে দুই বোরকাওয়ালী ভেগে গেল তাদের প্রেমিকের সঙ্গে। এবার মেজ বোন বললেন, “মা বোরখার কাপড় কিনতে যাব মার্কেটে। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?” তারপরে কি হলো, দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না।

আমি সবার ছোট হাওয়ায়, এসব ঝামেলা কম সইতে হয়েছে। কিন্তু চিরদিন তো ছোট থাকলাম না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এলাম বাসায়। এসেই এমন ঝামেলায় পড়লাম; আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকি, সেই বাসায় আরো দুই বোন থাকে। একজন আমার সমান হবে, অন্যজন অনেক ছোট। দুজনেই বোরকাওয়ালি এবং সংসারের কাজে পটু। আর ছোট বোন তো রাতদিন এক করে চিৎকার করে পড়াশোনা করে।

আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। মা বললেন, “ওদেরকে দেখে শেখ।” আহারে কপাল! কার? আমার, আমার মায়ের, নাকি দুই বোনের?

বড় বোন পালিয়ে গেল। আর বড় বোনকে বদনামের হাত থেকে বাঁচাতে ছোট বোনও পালিয়ে গেল। এবার বললাম, “মা, দেখে দেখে কি শিখব?”

মা পুরো হতভম্ব। আমরা বিয়ের দাওয়াত না পেয়ে মনমরা।

যা হোক, কম বয়সে মানে বিশেষ করে টিনএজ বয়সে মায়ের নানাবিধ দোষ প্রকট হয়ে সন্তানের চোখে লাগে। কিন্তু নিজে যখন বড় হয়, নিজে যখন মা হয়, তখন সে তার মায়ের মত হবারই চেষ্টা করে; আমিও করি। ভালো থাকুক সব মা।

(লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ)

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়