ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দুর্ভাগ্যই আমার মায়ের ভাগ্য

মোছা. ফারহানা জেবিন লিজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ১১ মে ২০২৫   আপডেট: ১৫:৫৪, ২৭ মে ২০২৫
দুর্ভাগ্যই আমার মায়ের ভাগ্য

মোছা. ফারহানা জেবিন লিজা

“অমন কালো মেয়ে ঘরে রেখে কি লাভ, পাত্র যা আসছে তার মধ্যেই দেখে বিয়ে দিয়ে দেন। এত পড়িয়ে আপনার নিজের কোনো লাভ আছে?” হাকিম সাহেব ঘটকের সব কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন আর কি যেন ভাবছেন শামীমা। ঠিক কিছুদিন পরেই শামীমার বিয়ে হয়ে যায় এক দরিদ্র ঘরে। স্বামী ছিলেন তার চেয়ে ১৫ বছরের বড়।

জমিদার ঘরের মেয়ে শামীমা। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় আর গায়ের রঙ কালো হওয়ায় তার কবিতার মত স্বপ্নগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে তাকে চলে যেতে হয় শ্বশুরবাড়ি। সাল তখন ১৯৯৮, স্বামীর সঙ্গে মোটামুটি মিলিয়ে থাকলেও শ্বাশুড়ি তাকে প্রথম থেকেই দেখতে পারেন না। কারণ একে তো গায়ের রঙ কালো, তার ওপর ভেবেছিলেন- জমিদার বাড়ির মেয়ে ঘরের বউ করে আনলে হয়তো তাদের অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু বিয়ের সময় উপঢৌকন হিসেবে শামীমার বাবা কিছুই দেননি।

আরো পড়ুন:

তার স্বামী অবশ্য ভেবেছিলেন, কিছুদিন শামীমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে হয়ত সে নিজে থেকেই তার বাপের বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসবে। কিন্তু ছোট্ট শামীমা সংসারের এসব ঘোরপ্যাঁচ কিছুই বুঝত না। তার চোখে শুধু ভাসত সেই স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো, মাঠে সবাই মিলে একসঙ্গে খেলা করা, গাছে গাছে চড়ে বেড়ানো আর পাখির বাসা খোঁজা।

বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই শুরু হয় তার স্বামী আর শ্বাশুরির অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন। এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শামীমা বাপের বাড়ি গিয়ে ঠাঁই নেয়। কিন্তু তার বাবা তো তাকে বিয়ে দিয়ে কাঁধের বোঝা নামিয়েছেন। সে বোঝা তিনি আর কাঁধে তুলতে চান না। তাই মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এদিকে ছোট ছোট ভুলের জন্য তার স্বামী প্রতিদিন তার গায়ে হাত তোলেন। শামীমা বুঝতে পারে, তার এত কষ্ট দেখার মত আসলে কেউই নেই।

এভাবে রীতিমত অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে শামীমা সংসার জীবনের ২৩ বছর কাটিয়ে দেন। স্বামীর অবহেলা, অত্যাচার উপেক্ষা করে সে পড়ে থাকে সংসারের এক কোণায়। আর ভাবে, তার জীবন অবশ্যই একদিন সুন্দর হবে, সে আশার স্বপ্ন দেখে। দুই কন্যার জননী শামীমার হঠাৎ একদিন মনে হলো, সে আবার নতুন করে লেখাপড়া শুরু করবে। কিন্তু তার স্বামী জানতে পারলে কখনোই তাকে লেখাপড়া করতে দেবে না। তাই স্বামীর অগোচরেই সে তার বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভর্তি হয়ে যায় উন্মুক্ত স্কুলে।

কিন্তু তার এই লুকোচুরি পড়াশোনা বেশিদিন চলল না। শ্বশুরবাড়ির সবাই জেনে গেলে সেদিন শামীমাকে অনেক মার খেতে হয়েছিল। তবুও স্কুল সে ছাড়েনি, হাজার বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। অবশ্য তখন সে তিন সন্তানের মা, তার কোল আলো করে এক ছোট্ট রাজা এসেছে। এতকিছু পেরিয়ে শামীমা যখন মাধ্যমিক পাশ করল, তখন তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা ধরনের রোগ।

চিকিৎসার জন্য তার স্বামী আগে থেকেই অপারগতা স্বীকার করেছে। নিরুপায় শামীমা তখন বাবার বাড়িতে শেষ আশাটুকু নিয়ে যায়। কিন্তু তারাও তার চিকিৎসা করাতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তখন শামীমার কিছু জমানো টাকা সে তার স্বামীর হাতে তুলে দেয়, যেটা ছিল তার ২৫ বছরের সংসারে কষ্টের জমানো সামান্য কিছু টাকা।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ৪২ বছর বয়সে এসে জীবনের একমাত্র স্বপ্ন মাধ্যমিক পাশ করতে পারলেও জীবনের হাল সে আর বইতে পারে না। স্বামী আর বাবার তীব্র অবহেলা তাকে ঠেলে দেয় জীবনের শেষ প্রান্তে। ৪২ বছর ১০ দিন বয়সে শামীমা পাড়ি দেয় দূর আকাশে। ২৫ বছরের সংসারের ইতি এখানেই।

শামীমা আমার মায়ের নাম, যাকে ভালোবেসে আমি ডাকতাম ‘মা জননী’ বলে। আর আমিই তার হতভাগ্য বড় সন্তান।

আজ ১ বছর ৯ মাস মা তুমি আর আমার কাছে নেই।

(লেখক: শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়