‘ওষুধ লাগবে না, সকালে ছেলের টাকা পাঠানো লাগবে’
মো. হাসিবুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম
মো. হাসিবুর রহমান
একবার আম্মুর খুব জ্বর হলো। হাড় ভাঙা জ্বর যাকে বলে। ঘূর্ণিঝড়ে কাহিল হয়ে উপড়ে পড়া গাছের মতো আম্মা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে থাকেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। দূরে থাকি বলে সাধারণত দুঃসংবাদ আমাকে জানান না। গোপন সিন্দুকের মতো সব দুঃসংবাদ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।
আব্বা যখন কাজ থেকে ঘরে ফিরে এলেন, তখন বেশ রাত। তারপর তিনি চুপচাপ রান্না ঘরে গিয়ে চুলায় ভাত চাপান, সঙ্গে আলু ভর্তা। প্লেটের এক মাথায় পেঁয়াজ, লবণ, ঝাল ও সরিষা তেল দিয়ে কিছুক্ষণ পিষে তারপর আলু ভর্তা করেন।
গরম ভাত আর আলু ভর্তা, আম্মা অল্প করে সেই ভাত কোনোমতে খান। তারপর আবার ঝিম মেরে শুয়ে পড়েন, জ্বর যায় কি না সেই দ্বন্দ্ব নিয়ে। মাঝ রাতে আর না পেরে উঠে বসেন- জ্বরে কাঁতরাতে কাঁতরাতে কাঁপেন শীতে।
আব্বা সেই মাঝরাতে উঠে ডাক্তার ডেকে আনলেন। জ্বর মেপে ডাক্তার বাঁকা বাঁকা অক্ষরে প্রেসক্রিপশন ভরে কি সব লেখেন। আম্মা ডাক্তারকে বলেন, “আরে বাবা, এসব প্রেসক্রিপশন বাদ দাও। প্যারাসিটামল খেয়ে দেখেছি কাজ হচ্ছে না। কোনোরকম দুটো ওষুধ দাও বা লাগলে একটা ইনজেকশন দিয়ে জ্বরটা তাড়াও।” এমন ভঙ্গি- যেন আম্মা ডাক্তারদের ডাক্তার।
ডাক্তার চোখ মোটা মোটা করে বলেন, “আপনার যে এত জ্বর, আর শরীরের যে দুর্বল অবস্থা, এখন স্যালাইনও দেওয়া লাগতে পারে। আর আপনি বলছেন, ওষুধ কম দিতে।”
আম্মা খুব সহজে ঢোক গিলে যেন জ্বর কমিয়ে ফেলেন আর বলেন, “আরে জ্বর সেরে যাবে। এত ওষুধ লাগবে না। সকাল হলেই ছেলের জন্য টাকা পাঠানো লাগবে।”
প্রতিবার বাড়ি থেকে ফেরার সময় আম্মা বটতলায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যতক্ষণ না আমি রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যাই। আম্মার চোখের এক ফোটা শিশির ছাড়া আমার আর কিছুই মনে থাকে না।
অনেক মাস পর পর বাড়ি ফিরি। বাজারে আসি, ঘুরি, চা খাই বা সব কাজ মিটিয়ে আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। আম্মা ঘুম থেকে উঠে বসেন। খোলা বারান্দায় অন্ধকারের ভিতর একটা পিঁড়ি পেতে চুপচুপ বসে থাকেন থুতনির নিচে হাত দিয়ে। বাড়ির গেটে তাকিয়ে থাকেন আমার ফেরার অপেক্ষায়।
অপেক্ষা শব্দের এই চরম দৃশ্য উঠোনের লেবু পাতার ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে যায়। আমি ঘরে ফিরতে ফিরতে আম্মার সমস্ত চুল সাদা হয়ে যায়। এসবের কিছুই আমি টের পাই না। মাঝে মধ্যে মন খারাপ হয়। কবি হাসান রোবায়েত এর মতো লিখতে ইচ্ছে করে, “আমার মায়ের অসুখের দিনে তাকে দেইখে রাইখো আল্লাহ। তুমুল গ্রীষ্মের দিনে মা যেইভাবে যত্ন করে গলার নিচে পাউডার লাগায় দিত।”
আম্মা ফুল গাছে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি ছিটানোর মতো মোনাজাতে দোয়া করেন, যেন আমি ভালো থাকি। যেন আমি পঁচা রুই মাছের মতো ফ্যাকাশে না হয়ে যাই। আম্মার কত কিছু নাই ঘরে, অভাবের বন্যায় যেন ডুবে আছেন। তবুও আব্বা বাজার থেকে তুলি কিনে আনেন আর আম্মা যেন বহুদূরে বসে কেবল আমাকে রঙ করেন।
মাবুদ গো, তোমার কাছে আকুল মিনতি, কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল হতে হতে আমারো যেন মনে থাকে- রব্বির হাম হুমা কামা রব্বাইয়ানি ছগীরা।
(লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী