ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সাঁকোর ওপারে মা

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৯, ১১ মে ২০২৫  
সাঁকোর ওপারে মা

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম

১৯৯২ সাল। আমি তখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর এক শিশু শিক্ষার্থী। শহরের কোলাহল ছেড়ে মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়ায় খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ছোটবেলায় আত্মীয়ের বাড়ি মানেই ছিল এক উৎসব—নতুন মুখ দেখার আনন্দ, নতুন খাবার খাওয়ার মজা আর খেলার অবাধ স্বাধীনতা।

আমার খালু স্থানীয় বাজারে একটি মুদির দোকান চালাতেন। সন্ধ্যাবেলা দোকানে গিয়ে খুব আনন্দ লাগছিল, তাই খালুর প্রস্তাবে রাতে দোকানেই থেকে যাওয়ার সাহস দেখালাম। মা প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু আমার জেদে শেষমেশ অনুমতি দিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন:

রাত গড়িয়ে বারোটা। মায়ের শূন্যতা কেমন করে হৃদয়ে আঘাত করলো, বুঝতে পারলাম না। ছোট্ট বুকটা হঠাৎ মায়ের জন্য হাহাকার করে উঠলো। খালুকে বললাম, প্রস্রাব করে আসি। আর সেই ফাঁকে একাই রওনা দিলাম অচেনা অন্ধকার পথে। বাসার পথ জানতাম, কিন্তু শিশু মন যা বোঝে তা বাস্তবের সাথে মেলে না সব সময়। পুকুরপাড় পেরিয়ে ভুল পথে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ উঁচু থেকে নিচে পড়ে গেলাম। কাঁদিনি, শুধু উঠে দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু করলাম।

সাঁকো পার হতেই বড় সেই আমগাছটা দেখলাম, বুকের ভেতর কেমন চিপ মেরে উঠলো। অন্ধকারে কাঁপা পা নিয়ে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম। কাঁপা গলায় ডাক দিলাম, মা…।

প্রথমে দরজা খুলে দিল মাধুরী আপু। চোখে জল, মুখে রাগ—এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো, আরেক হাতে একটা থাপ্পড়। তারপর মা এসে আমাকে বুকে টেনে নিলেন, কেঁদে ফেললেন  দুজনেই। স্নেহের স্পর্শে শরীরের ধুলো মুছে, নতুন জামা পরিয়ে, কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন মা।

সেই রাতে বুঝেছিলাম, মায়ের ভালোবাসা শুধু কোমল নয়, কঠিনও। ভালোবাসার চড় থাপ্পড়ও কখনো কখনো দরকার হয় সন্তানকে আগলে রাখার জন্য।

পরদিন খালু বললেন, তোর খোঁজে পুকুরপাড়ে ডাক দিচ্ছিলাম... তোকে হারানোর ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল।– সেই দিনটা, সেই রাতটা, আমার মনে একটি আজীবনের ছাপ ফেলে গেছে।

ছেলেবেলার ভুল পথচলা আর মায়ের বুকে ফেরা—এই দুয়ের মাঝখানে ছিল একটা ছোট সাঁকো। আর সাঁকোর ওপারে ছিল আমার পৃথিবী—মা।

গ্রাম্য পরিবেশে বড় হওয়া আমাদের জীবনের পেছনে যে মানুষটি ছিলেন সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, তিনি হলেন আমার মা খোদেজা বেগম। মা ছিলেন সহজ-সরল একজন মানুষ, কিন্তু সংসার জীবনে ছিলেন অসাধারণ। ভাই-বোনসহ আমাদের প্রতিটি সন্তানের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। তার আদরে ছিল অফুরন্ত মমতা, আর শাসনে ছিল অটল ন্যায়বোধ।

মা নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি, কিন্তু আমাদের পড়াশোনার বিষয়ে ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল। কোনদিন আমরা যদি তার কথা অমান্য করতাম, হয়তো তখন কিছু বলতেন না, কিন্তু রাত হলে সেই ভুলের শাস্তি দিতেন কঠোরভাবে—সেই কঠোরতাতেই লুকিয়ে ছিল তার গভীর ভালোবাসা।

আজ মা নেই—তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে তার শূন্যতা আমাকে নাড়া দেয়। মায়ের আদর, মায়ের শাসন, মায়ের উপস্থিতি সবই এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো আজও আমাকে গড়ে তোলে, আমার পথচলায় শক্তি দেয়।

আমি এখন আমার সন্তানদের প্রতিও মায়ের শেখানো মূল্যবোধ প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। মা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন—এই প্রার্থনাই করি প্রতিনিয়ত।

(লেখক: শখের ফটোগ্রাফার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর)

ঢাকা/স্বরলিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়