আমার একজন সংগ্রামী মা
শেখ উদয় || রাইজিংবিডি.কম
শেখ উদয়
আমার মাকে জনম দুঃখিনী বললেও অতিরঞ্জন হবে না। জন্মের ১১ মাস না যেতেই তিনি হারান তার বাবাকে। এক সময়ের প্রতিপত্তিশালী সেই মানুষটির মৃত্যুর পর নানার সম্পদ নিয়ে চলতে থাকে লড়াই, আর সেই টানাপোড়েনে আমার নানু আর আমার মা হয়ে ওঠেন ঘরছাড়া, সহানুভূতিশূন্য কিছু মানুষের কাছে তারা যেন বোঝা। সেই অল্প বয়সেই মা শিখেছিলেন কেমন করে অভাবের সাথে বোঝাপড়া করে বাঁচতে হয়। নানু একা হাতে মানুষ করেছেন তাকে। বিলাসিতা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে গিয়েও তারা প্রতিদিন লড়েছেন।
মা বড় হয়েছেন অনাড়ম্বর এক জীবনে। সহজ-সরল গ্রাম্য পরিবেশে। কাঠের বেড়া আর টিনের চালের ঘরে ছিল মা আর নানুর সংসার। আমি সেই মায়ের সন্তান। ঝড়বৃষ্টির রাতে বজ্রপাতের গর্জনে কেঁপে উঠলে মা নিজের ভয়কে আড়াল করে আমাকে আঁকড়ে ধরতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ভয় পাস না বাবা, আমি আছি তো।
আমার মায়ের অক্ষরজ্ঞান ছিল খুব সামান্য। কিন্তু তিনি ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষিকা। আমাকে তিনি শেখাননি ইংরেজি ব্যাকরণ, অঙ্কের সূত্র কিংবা রসায়নের জটিলতা। কিন্তু তিনি নিজের জীবন থেকে আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষ কেমন করে মাটিতে পা রেখে স্বপ্ন দেখে, দুঃখকে কীভাবে ধৈর্যে রূপ দেয় আর ভালোবাসার জন্য কীভাবে আত্মত্যাগ করে।
বাবা সারাদিন বাইরে খাটতেন, আর মা ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই একটা রাজত্ব চালাতেন। তিনি ছিলেন সংসারের চালিকাশক্তি, বাবার সঙ্গিনী, আর আমাদের জীবনের নিরাপদ আশ্রয়। অসংখ্য কাজের ভিড়ে মা হয়তো ক্লান্ত বোধ করতেন, কিন্তু ক্লান্তি আড়াল করার অসীম ক্ষমতা ছিল মায়ের। তিনি যেন সব সময় শক্তিতে পরিপূর্ণ এক মানুষ।
মায়ের এখন বয়স হয়েছে। মা আগের মতো দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে পারেন না। কিন্তু তার দৃষ্টি আগের মতো সচেতন, সাবধানী, কঠোর ও মমতায় পরিপূর্ণ।
আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোতে যিনি ছায়ার মতো পাশে ছিলেন, তিনি আমার মা। স্নাতক এডমিশনের সময় যখন কোথাও সুযোগ পাচ্ছিলাম না, জীবনের সব দরজা বন্ধ মনে হচ্ছিল—তখন মা ছিলেন আমার মনোবল। যখন রাতভর জেগে হতাশ হয়ে চুল টেনে ধরতাম, তখন মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, হবে রে বাবা, আল্লাহ ভরসা।
মা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে নিজেকে বিশ্বাস করতে হয়, আর কীভাবে নতুন স্বপ্ন দেখতে হয়। মা দিবস কি শুধু একটি দিন? মা তো প্রতিটি দিনের সঙ্গী, প্রতিটি মুহূর্তের ভালোবাসা। মা দিবস আমাদের একটা সুযোগ দেয়—একটু থেমে যাওয়ার, আর মনে করিয়ে দেয়—মা, তুমি ছাড়া আমি কিছুই না।
মা, আমি হয়তো প্রতিদিন বলি না, কিন্তু জানো, তোমার জন্যই আজকের আমি। তোমাকে ভালোবাসি, মা। শুভ মা দিবস।
(লেখক: শিক্ষার্থী, ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষ, বিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ, বাগেরহাট)
ঢাকা/স্বরলিপি