ঢাকা     বুধবার   ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পোষ্য কোটা থেকে রাকসু: রাবির উত্থান-পতনের এক বছর

রাবি প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫  
পোষ্য কোটা থেকে রাকসু: রাবির উত্থান-পতনের এক বছর

২০২৫ সাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইতিহাসে লেখা থাকবে এক অস্থির, দ্বন্দ্বময় কিন্তু একই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ বছরের নাম হিসেবে। বিগত বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে নতুন শুরুর প্রত্যাশা থাকলেও পুরো বছরজুড়ে আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলন, প্রতিবাদ ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনেই আবর্তিত হয়েছে ‘প্রাচ্যের কেমব্রিজ’ খ্যাত এই বিদ্যাপীঠ। পোষ্য কোটা বিতর্ক, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রাকসু নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা প্রশ্নে অনাস্থা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনায় বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল রাবি।

বছরের শুরু থেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিচারের দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝোলানো, বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়। ক্ষমতা, দায়বদ্ধতা ও সংস্কারের প্রশ্নে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের দূরত্ব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন:

পোষ্য কোটা: ত্রিমুখী সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু

২০২৫ সালের সবচেয়ে আলোচিত ও বিস্ফোরক ইস্যু ছিল ভর্তি পরীক্ষার পোষ্য কোটা। দীর্ঘদিনের দাবির মুখে প্রশাসন কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেও শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। মানববন্ধন থেকে শুরু করে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। চাপের মুখে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথে নামেন। এক শিক্ষার্থীর কাফনের কাপড় পরে প্রশাসন ভবনের সামনে আমরণ অনশন দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রবল আন্দোলনের মুখে সিন্ডিকেট সভা ডেকে পোষ্য কোটা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় প্রশাসন।

রাকসু নির্বাচন ও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

দীর্ঘ কয়েক দশক পর রাকসু নির্বাচন আয়োজন ছিল বছরের বড় চমক। তবে নির্বাচনের তারিখ ও ভোটকেন্দ্র পরিবর্তনকে ঘিরে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ হয় একাধিকবার। একাধিকবার তারিখ পরিবর্তনের পর শেষ পর্যন্ত ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় রাকসু নির্বাচন। ভিপি ও এজিএসসহ ২৩টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয়লাভ করে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’। ডাকসু ও চাকসুর পর রাকসুতে এমন সাফল্য ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। নির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যা; সব মিলিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়।

ধর্মীয় অনুভূতি, শাটডাউন ও সম্পর্কের টানাপোড়েন

বছরের আরেকটি সংবেদনশীল অধ্যায় ছিল ক্যাম্পাসে পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্যারিস রোডে বিক্ষোভ করে দোষীদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট একজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করলে সাময়িক স্বস্তি আসে। এই ঘটনার পর এক যুগ পর প্রকাশ্যে বিক্ষোভে নামে ইসলামী ছাত্রশিবির।

এদিকে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ, বিভিন্ন দাবিতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ও কর্মচারী ইউনিয়নের কর্মবিরতিতে একাধিকবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ পালিত হয়। জুবেরী ভবনে শিক্ষকদের হেনস্তার ঘটনার পর দীর্ঘমেয়াদি কর্মবিরতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে বড় সংকট তৈরি করে। আলোচনার মাধ্যমে কিছু কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের টানাপোড়েন বছরজুড়ে স্পষ্ট ছিল।

অস্থিরতার মাঝেও অর্জন

সব অস্থিরতার মধ্যেও কিছু সাফল্য রাবিকে আলোকিত করেছে। প্রথমবারের মতো একটি ব্যাচ থেকেই বিজেএস (সহকারী জজ) পরীক্ষায় ২৫ জন শিক্ষার্থীর সাফল্য জাতীয় পর্যায়ে প্রশংসিত হয়। উচ্চতর গবেষণার জন্য ইউজিসির প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়, যার আওতায় ছয়টি নতুন আবাসিক হল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সমাবর্তনে পাঁচ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট সনদ গ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সহজ করতে ক্যাম্পাসে যুক্ত হয় পরিবেশবান্ধব ই-কার।

শূন্য সহনশীলতা ও শোক

যৌন হয়রানি ও দুর্নীতির প্রশ্নে প্রশাসন এ বছর তুলনামূলক কঠোর অবস্থান নেয়। একাধিক শিক্ষক বরখাস্ত ও শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ডিকেট। তবে বছরটি রাবির জন্য ছিল শোকাবহও। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক পুরনজিত মহালদার। সুইমিংপুলে ডুবে মারা যান সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সায়মা হোসাইন। বিভিন্ন হল থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দায় নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বছরের শেষ প্রান্তে নতুন উত্তেজনা

বছরের শেষদিকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি, প্রশাসনিক ভবনে তালা, ডিনদের দায়িত্ব পালন করতে না পারার ঘোষণা এবং রাকসু জিএসকে ঘিরে ছাত্রদলের হুঁশিয়ারি—সব মিলিয়ে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস রাজনীতি।

সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল একদিকে অধিকার ও সংস্কারের লড়াইয়ের বছর, অন্যদিকে শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলার সময়। অস্থিরতার মধ্যেও যে সম্ভাবনার আলো নিভে যায়নি, সেটিই এই বছরের সবচেয়ে বড় বার্তা।

ঢাকা/ফাহিম/জান্নাত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়