ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘না খেয়ে মরে যাবো তবুও ভিক্ষে করবো না’ 

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ১৮ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:১৭, ১৮ জানুয়ারি ২০২১
‘না খেয়ে মরে যাবো তবুও ভিক্ষে করবো না’ 

তীব্র শীতের কুয়াশায় মোড়ানো ভোরে বাসা থেকে হুইলচেয়ার দিয়ে বের হন শারীরিক প্রতিবন্ধী এরশাদ খান। জীবন বড় কঠিন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে কেবল সংগ্রাম। সেখানে মাঘ মাসের কনকনে শীত কিছুই নয়৷ খুব ছোটবেলায় কোনো এক জ্বরে কপাল পোড়ে চা বিক্রেতা এরশাদ খানের।

নানীর কাছে কেটেছে শিশু আর বাল্যকাল। শারীরিক প্রতিবন্ধীতা তাকে আটাকাতে পারেনি। অন্য সবার মতো তিনিও স্কুলে গেছেন। প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ মেলেনি তার, তবুও কোনো আক্ষেপ নেই।

স্কুলজীবনের স্মৃতি তাকে এখানো আনন্দে ভাসায়। এলাকাবাসী থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব এমনকি শিক্ষকদেরও প্রিয় ছিলেন। সেই দিনগুলোতে কখনো মনে হয়নি তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। বন্ধুরা তাকে খেলায় নিতেন। ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন তিনি। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও হেরে না যাওয়া এই মানুষটির বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মাঝালিয়া গ্রামে।

এসএসসি পরীক্ষার পর পরিবার তাকে বিয়ে করিয়ে দেয়। তখনো কোনো কর্মসংস্থান ছিল না। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রা ফ্লাইওভারের নিচে তার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বাকি জীবনের গল্প শুনেছি সেদিন।

এরশাদ খান (৩৩) বলেন, ‘‘আমার জন্মের পরেই একটা জ্বর হয়। তারপর কবিরাজের ঝাড় ফুকে ভালো করার চেষ্টা করে পরিবার। তখন এত ডাক্তার ছিল না, তাছাড়া পরিবারের সচেতনতার অভাবে সঠিক চিকিৎসা পাইনি। আমার পায়ে সমস্যা, বেশি সময় হাঁটা বা দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।

এসএসসির পর বিয়ে করায় পরিবার। এরপর তো কাজ দরকার। কাজ না করলে খাবো কী। সিআরপিতে ট্রেনিং করি এবং আরেকটা ইনস্টিটিউটে ইলেকট্রনিকসের কাজ শিখি। এলাকার এক চাচা বললেন, তুই চন্দ্রা আয়, আমি তরে ওয়ালটনে চাকরি দেবো। তার কথামতো এসে তাকে আর খুঁজে পাইনি। 

কিছু ভেবে না পেয়ে চন্দ্রা বাসস্ট্যান্ডে বসে ছিলাম। শারীরিক প্রতিবন্ধী হতে পারি কিন্তু ভিক্ষে করবো না। আতত্মহত্যা মহাপাপ, তাই আত্মহত্যাও করবো না। না খেয়ে থাকতে থাকতে মারা যাবো, তবুও কারো কাছে হাত পেতে খাবো না। অনেক চিন্তাই তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ আমার এলাকার একজন মধ্যবয়স্ক ভিক্ষুক আমাকে দেখে কথাজুড়ে দিলেন। 

তিনি এখানে চা বিক্রির আইডিয়া দিলেন। তার কথাতে বাড়ি থেকে টেবিল এনে ৬২০ টাকায় ব্যবসায় শুরু করি। আস্তে আস্তে দারুণ আয় রোজগার হয়। চা বিক্রি করে আমি সংসারের হাল ধরি। এরমধ্যে বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সেখানে তিন লাখ টাকা ও সংসারের আরো দুই লাখ টাকা দিয়ে চিকিৎসা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। চা বিক্রি করে বাড়িতে বিল্ডিং ঘর দিছি এবং গরু কিনছি।

আল্লাহর রহমতে আমার সংসারে কোনো অভাব অনটন নেই। এক ছেলে পড়ে ক্লাস টেনে, আর মেয়ে পড়ে ফোরে। ওদের মানুষের মতো মানুষ বানানো আমার বড় স্বপ্ন। ওরা বড় হয়ে যা হতে চায় তাই হবে। প্রয়োজনে সব সম্পত্তি বিক্রি করে পড়ালেখা করাবো।’’

এই চা বিক্রেতা আরো বলেন, ‘‘লড়াই করেই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতিটি মানুষ সংগ্রাম করে টিকে থাকে। অনেকের জন্য খারাপ লাগে। এই বাসস্ট্যান্ডে কত মানুষ দেখি হাত পা ভালো তারপরেও চুরি, ছিনতাই, পকেট মারে ও ভিক্ষা করে। সৎ পথে থেকেও ভালোভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে যে প্রশান্তি, এরা বোঝে না। গত ১০ বছরে এমন অনেক মানুষ দেখছি।

একবার দোকানের সামনে ৩৫ হাজার টাকা পাইছিলাম, পরে সেটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছি। এরপর আমাকে যে আইডিয়া দিছিল, তাকে আমি দোকান করে দিয়েছিলাম। দুই তিন মাস দোকান আবার ভিক্ষে করে। এইজন্য তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে দিছি। আমার জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নাই। আমার বউ আমাকে অনেক সাহায্য করে।’’

সকাল ৯টায় গরম ভাত নিয়ে এসে খাওয়ার তাড়া দিলেন তার স্ত্রী নাসরিন বেগম। স্বামী আর সংসার নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে অনেক সুখী, ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করছে আর সংসারে কোনো জিনিসের কমতি নেই। উনারে নিয়া আমার কোনো আক্ষেপও নেই।’

লেখক: শিক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ। 

টাঙ্গাইল/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়