ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ত্রিপুরার চোত্তাখোলা উদ্যান আমাদের যুদ্ধকালের ঠিকানা

সমীর চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ত্রিপুরার চোত্তাখোলা উদ্যান আমাদের যুদ্ধকালের ঠিকানা

সমীর চক্রবর্তী, চোত্তাখোলা (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে : চোত্তাখোলার মাঠ।এখানে ছিল ব্যাস ক্যাম্প। তৈরি হয়েছিল বাংকার। বীর বাঙ্গালী এখানে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ গড়েছে। এমনকী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসব স্থান টার্গেট করে শেলিংও করেছিল।

ত্রিপুরার আর দশটি জায়গার সঙ্গে এখানের পার্থক্য- ‘চোত্তাখোলার মাঠ’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে  স্মরণ করিয়ে দেয় । স্থানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে  মুক্তিযুদ্ধে দু’দেশের সম্পর্কের এক অনন্য ইতিহাস। আজো সেখানকার মানুষ  সেইসব স্মৃতি আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।

দুটি দেশের লাখো মানুষের আবেগ-ভালোবাসাকে কুর্ণিশ জানাতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার চোত্তাখোলার মাঠ হয়েছে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান’। যেখানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তৃষ্ণা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫০ একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা পার্কটিতে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিস্মারক। ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবয়ব। এই উদ্যানে নির্মিত হয়েছে ২টি সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের অনুকরণে স্মৃতিসৌধ, বেশ কিছু ভাস্কর্য। উদ্যানে বয়ে চলা প্রাকৃতিক হ্রদ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে উদ্যানের সৌন্দর্য। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা চিত্রকর্ম। বাংলাদেশের খুলনায় অবস্থিত ‘১৯৭১  গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সৌজন্যে এখানে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য পার্ক।

 


এছাড়া বিচ্ছিন্ন টিলাগুলোকে যুক্ত করে প্রাকৃতিক আবহ ধরে রাখতে তৈরি হয়েছে কাঠের সেতু। ভাস্কর্যের পেছনে টেরাকোঠায় চিত্রিত করা হয়েছে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নানা বাঁক। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এখানে রয়েছে একটি কমিউনিটি হল। প্রক্রিয়াধিন রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিকৃতি নির্মাণের কাজ।

উদ্যানের ৭টি টিলা, উঁচু জায়গায় অবস্থিত ৩ টি বাংকার আজও মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ভয়াবহ সেই দিনগুলোর কথা। প্রতিবেশি দেশে গিয়েও যারা আক্রমনের শিকার হয়েছিলেন এবং প্রতিবেশিদের সহযোগিতা করতে গিয়ে যারা আক্রমনের শিকার হয়েছিলেন তারাও।

প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পালন হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। পরম মমতায় সেখানকার মানুষ আগলে রাখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই উদ্যান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার দিনগুলো যেমন স্মরণ করিয়ে দেয়, পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলে একাত্তরে ত্রিপুরার সহমর্মিতা ও সহযোগিতা গাঁথা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্থানীয় রাজনগর এলাকার বিধায়ক সুধন দাস স্থানটিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ পার্ক’এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। মূলত, তিনিই এই উদ্যানের স্বপ্নদ্রষ্টা । বিষয়টি আলোচিত হলে নজরে আসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মানিক সরকারের। এগিয়ে এসে তিনিও হাত লাগান পার্কের কাজে। শুরু হয় বহুমুখী নির্মাণ কাজ। পরে নাম বদলে রাখা হয় ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান’। বাড়ানো হয় কাজের পরিধি।

 


২০১০ সালের ১১ নভেম্বর উদ্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি। পরে গত বছর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের পরিকল্পনায় এখানে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য বাগান। অংশ নেন শিল্পী হাসেম খান, শ্যামল চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান প্রমূখ।

স্থানীয়রা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী এই পাহাড় ঘেরা স্থানটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনীর অলিখিত ঠিকানা। ফেনীর আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমেদ এই জায়গায় ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের শুরুতে এখানে আশ্রয় দেওয়া হতো, একটু সুস্থ হলে তাদের আগরতলা, মেঘালয়, বিশালগড় এবং অনেক সময় ত্রিপুরার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এক সময় এটি ট্রানজিট ক্যাম্পের পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। বলা হয়ে থাকে, ত্রিপুরা থেকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারমধ্যে এখানকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই প্রথম পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেছিলেন।  পাকবাহিনীর আক্রমণেরও কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্থানটি।

বন বিভাগের বিট অফিসার প্রনব কুমার দাস বলেন, ‘আমরা এলাকাটি দেখভালের জন্য প্রায়ই এখানে আসি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এখানে মানুষের ঢল নামে। ত্রিপুরার পাশাপাশি বাইরের রাজ্য এবং বাংলাদেশ থেকেও অনেকে ঐতিহাসিক এই উদ্যানটিকে দেখতে আসেন। যদিও এখনো উদ্যানটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি।’

স্থানীয় বিধায়ক সুধন দাস বলেন, ‘প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্যানের প্রথম দফার কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। পার্কটিতে একটি জাদুঘর, ফোয়ারা এবং শিশুদের জন্য আলাদাভাবে কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উদ্যানটির ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তার প্রচেষ্টায় আমরা এটিকে আরো সমৃদ্ধ করার স্বপ্ন দেখছি।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতেও বাংকার ছিল। এখানেও পাকিস্তানিরা শেলিং করেছে। এই উদ্যান দুই দেশের বন্ধুত্বকে আরো সমৃদ্ধ ও নিবিড় করবে ।’

মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি রক্ষা কমিটি:

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানকে কেন্দ্র করে মুত্তিযুদ্ধের বার্তা ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ২০১০ সালে করা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি রক্ষা কমিটি’। বিধায়ক সুধন দাস এই কমিটির চেয়ারম্যান। তাছাড়া জীবন চন্দ্র শীলকে আহবায়ক এবং শ্যামল সরকারকে যুগ্ম আহবায়ক করা হয়। কমিটিতে বর্তমানে ৫০ জন সদস্য রয়েছে। উদ্যানটির কথা ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন প্রকাশনার পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান জানান এখানকার মানুষ। তখন এখানেই ফুটে উঠে আরেক বাংলাদেশ।

রাজনগরের বিধায়ক সুধন দাস


মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি রক্ষা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক শ্যামল সরকার  বলেন, ‘সীমানা আলাদা হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নিজেদের কোনদিন আলাদা ভাবিনি। দেশটিকে আমরা একান্তই আপন হিসেবে জানি। এই উদ্যানটি আমাদের কাছে আবেগের নাম। আমরা জানতে পেরেছি ইতিমধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। ১০ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে। সেই অর্থ ছাড় হলে উদ্যানটি আরো সমৃদ্ধ হবে।

তিনি জানান, আ.স.ম আব্দুর রবও এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ২০০১ সালে তিনিও এসেছিলেন স্মৃতিময় সে জায়গা ঘুরে দেখতে।

অপেক্ষা শেখ হাসিনার:
রাজনগরের বিধায়ক সুধন দাস বলেন, `আমরা চাই উদ্যানের উদ্বোধন করুন বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যোগাযোগ শুরু করেছেন। আশা করি বাকি কাজ শেষ করে কম সময়ের মধ্যেই আমরা উদ্যানটি উদ্বোধন করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে পারবো।’

যেভাবে যাবেন:
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা শহর থেকে ১৩২ কিলোমিটার দূরে বিলোনিয়ার প্রায় প্রান্তসীমায় চোত্তাখোলা। আগরতলা থেকে বাসে যেতে সময় লাগবে ঘন্টা পাঁচেক। তবে ভাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ব্রাহ্মণবাড়িয়া/৭ মে  ২০১৭/সমীর চক্রবর্তী/শহি মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়