ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রক্তাক্ত তটরেখা

বলেশ্বর তীরের জনপদ কাঁদে নীরবে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৪, ৪ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বলেশ্বর তীরের জনপদ কাঁদে নীরবে

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। মার্চে মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। সবার প্রত্যয় ছিল একটাই- দেশকে শত্রুমুক্ত করা। যুবক-তরুণেরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অবশেষে আসে মুক্তি। সারাদেশের ন্যায় মুক্তি সংগ্রামের সেই ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল উপকূলীয় জনপদের তটরেখা পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ঐতিহাসিক তথ্যাবলী নিয়ে ধারাবাহিকের আজকের পর্বে রয়েছে পিরোজপুর জেলার কথা।  

রক্তে লাল বলেশ্বরের জল গড়িয়েছে বহুদূর। জনপদে এসেছে পরিবর্তন। প্রত্যন্ত পল্লীর বুক চিড়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পিচের রাস্তা। উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে লেগেছে। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন আজও সাক্ষী হয়ে আছে সেই ভয়াল দিনের। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও থামেনি স্বজনদের কান্না। সেই হৃদয়বিদারক নির্মম দৃশ্যের কথা মনে করলেও আঁৎকে ওঠেন তারা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে উপকূলীয় পিরোজপুর জেলার মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন নিপীড়ণ চালিয়েছিল পাকসেনা। গ্রামের পর গ্রাম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। গুলি করে কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নিরীহ মানুষদের সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। সেই ভয়াল স্মৃতি জড়িত জেলা পিরোজপুর মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর।

পিরোজপুর জেলার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কিছু মানুষ নদী-সমুদ্রে মাছ ধরেন, কিছু মানুষ সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করেন। এ জেলার একপ্রান্ত সুন্দরবন সীমান্তের গা ঘেঁষে জেগে আছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমা ছিল সুন্দরবন সাব-সেক্টরের আওতাধীন। মার্চ মাসেই পিরোজপুর সরকারি স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধকালে এই জেলার নিরীহ মানুষের ওপর পাক বাহিনী ব্যাপক নির্যাতন নিপীড়ণ চালিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, এ জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক বধ্যভূমি রয়েছে, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ব্যক্তিগণ। তবে বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি এরইমধ্যে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। কিছু আবার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বছর ঘুরে মার্চ আসে। ’৭১-এর সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে এলাকাবাসীর। উত্তাল মার্চের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে ভিজে ওঠে তাদের চোখ। জেলা সদরের খুব কাছে পাড়েরহাটের বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার কথা তারা মনে করতে পারেন না। স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা, নাজিরপুরের বিভিন্ন এলাকা, কাউখালী উপজেলার লঞ্চঘাট, ভান্ডারিয়ার পশারিবুনিয়ায় একাত্তরে নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। পিরোজপুর সদরের তেজদাসকাঠির বধ্যভূমিতে ঘুমিয়ে আছেন ১৪জন শহীদ। অন্য একটি হিসাবে পাওয়া যায় এখানে ২৩জনের প্রাণহানি ঘটেছে। মঠবাড়িয়া উপজেলার সূর্যমণি বেড়িবাঁধ বধ্যভূমিতে ফেলা হয়েছে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ। জেলার বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা বধ্যভূমির কথা অনেকেরই জানা। এখানকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিকটে এই বধ্যভূমিতে চারশ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই উপজেলার সোহাগদলে একই পরিবারের ৭জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। একই কবরে তাদের দাফন করা হয়। এই ঘটনা এ জেলার মুক্তিযুদ্ধে এক হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য বহন করছে। এছাড়াও এই উপজেলার অলঙ্কারকাঠি, পাইলট বিদ্যালয়, স্বরূপকাঠি মাদ্রাসা, ভীমকাঠি, ছেলাবুনিয়া, বাঁশতলা, দৈহারী চিলতলা, বরছাকাঠি এবং গুয়ারেখা বধ্যভূমিতে ঘুমিয়ে আছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।

পিরোজপুর জেলার কাউখালী লঞ্চঘাটে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। সেখানে কুড়াল দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সুভাষচন্দ্র ও কালু মহাজনসহ ৫জনকে। সেখানে একজন কলেজ ছাত্রকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এই এলাকায় অসংখ্য মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করে পাকিস্তানী বাহিনী। ভান্ডারিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি। এ উপজেলা পশারিবুনিয়া, কাপালির হাট এবং ভান্ডারিয়া খেয়াঘাটের বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে জবাই করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। উপজেলার দৈহারি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বাড়িতে ১৭জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর অত্যাচার এতটাই নির্মম ছিল, যা এখনও বাসিন্দাদের কাছে বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে।

পাক বাহিনীর আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পিরোজপুরেও প্রস্তুতি শুরু হয় মার্চে। তৎকালীন মহকুমার সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন ডা. ক্ষিতিশ মণ্ডল, আবদুল হাই, আ স ম সিদ্দিক, শফিজউদ্দিন আহমেদ, হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, ওমর ফারুক, শহীদুল আলম নীরু, আবুল কালাম মহিউদ্দিন, লুৎফুল কবির দুলাল, ওবায়দুল কবীর বাদল, নূর দিদা খালেদ রবি, ফজলুল হক ফজলু, ন্যাপ নেতা আলী হায়দার খান, নিরোদ নাগ প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা হয়, প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাক বাহিনীর প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রস্তুত হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। পিরোজপুর শহর ১৪০০ জন মুক্তিযোদ্ধার দখলে ছিল। এছাড়া সকল থানা, বাজার এমনকি গ্রামে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। রায়েরকাঠি জমিদারবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। জেলার বিভিন্ন স্থানে অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। এমনকি জেলার সকল থানার পুলিশের অস্ত্র পর্যন্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তাদের বিশেষ নজর ছিল পিরোজপুর ট্রেজারির দিকে। সংগ্রাম পরিষদ চেয়েছিল ট্রেজারির অর্থ সুন্দরবনে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এক গ্রুপের হঠকারিতায় ট্রেজারি লুট হয়ে যায়। ওদিকে ২৬ এপ্রিল বরিশাল পতনের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ মে পিরোজপুর দখলে নেয় পাক সেনারা।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনায় পাক বাহিনী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফজলুল হক খোকনকে ধরিয়ে দেয়া হয়। পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে ফজলুল হক খোকন, বিধানচন্দ্র, সেলিমসহ আরও অনেককে। পাক সেনারা ফারুক হোসেনের মাথায় পতাকা স্ট্যান্ড বসিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বাধ্য করে। কিন্তু ফারুক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করেন। জেলাজুড়ে পাক সেনাদের অত্যাচার নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যায়। বরিশাল পতনের পর লে. জিয়াউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবন চলে যান। এ সময় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সুন্দরবনে আশ্রয় নেন। এদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। প্রধান কেন্দ্রটি ছিল শরণখোলার বগীতে। মুক্তিবাহিনী গঠনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে শরণখোলার শামসুদ্দিন, মোড়েলগঞ্জের মধু, আসাদ, মঠবাড়িয়ার শহিদুল আলম বাদল, আলতাফ, মজিবুল হক মজনু, সুবেদার গাফফার, খলিলুর রহমান প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদিকে জিয়াউদ্দিন মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা থানা আক্রমণ করে সব অস্ত্র নিয়ে নেন। সুন্দরবন চলে যায় মুক্তিবাহিনীর দখলে। ফলে হাজার হাজার শরণার্থী ও ছাত্র-যুবকদের ভারতে যেতে সুবিধা হয়েছে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পটুয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন স্থানে যেতেন এই সুন্দরবন দিয়ে।

সুন্দরবনজুড়ে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীর এই আধিপত্য নজরে পড়ে পাক বাহিনীর। তারা সুন্দরবন দখলের জন্য নৌ ও বিমান হামলা চালায়। সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। এতে পাক বাহিনীর গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাকবাহিনী পিছু হটে। উপর থেকে সুন্দরবনে হামলা চালালেও মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পাক সেনারা সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী সুন্দরবনে তাদের ঘাঁটি আরও দৃঢ় করার সিদ্ধান্ত নেয়। জিয়াউদ্দিন পিরোজপুর থেকে টুঙ্গিপাড়া এবং সেখান থেকে সুন্দরবনে যান। মুক্তিযোদ্ধারা জিয়াউদ্দিনকে কমান্ডার হিসাবে গ্রহণ করে। বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরবনে সমবেত হতে থাকে। জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে গভীর সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। জিয়াউদ্দিন ভাবলেন, আর বসে থাকা যায় না। জুলাই মাসে তিনি চারজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারতে অবস্থিত নবম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেন। হিরণ পয়েন্ট ও মংলা পোর্টে জাহাজ আক্রমণের জন্য নৌ কমান্ডো চান জিয়াউদ্দিন। তাকে ৩৪জন নৌ কমান্ডো দেয়া হয়। সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি ২২ জুলাই সুন্দরবন যাত্রা করেন। এখান থেকেই জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। তার নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী দখল করে মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রায়েন্দা ও মঠবাড়িয়া থানা। তার নেতৃত্বে ১০ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর রায়েন্দা ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। সেখানে এ যুদ্ধ চলে তিনদিন ধরে। যুদ্ধে মোড়েলগঞ্জের আসাদ, পাথরঘাটার আলাউদ্দিন এবং বরিশালের কলেজ রোডের টিপু শহীদ হন। এক সময় জিয়উদ্দিনের বাহিনী ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর দখল করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন।

’৭১-এর জুন মাসে গাভা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেনুলাল দাশগুপ্ত একটি দল গঠন করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হন আরও অনেকে। পহেলা নভেম্বর তার নেতৃত্বাধীন দল বানারীপাড়া থানা দখল করে নেয়। এসময় সংঘর্ষ বাঁধে। সেখানে শহীদ হন রাজাপুরের হারুন-আর-রশিদ। গেরিলা হাবিবের নেতৃত্বে গুলিশাখালী হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোল রুম ছিল মঠবাড়িয়া পোস্ট অফিসে। কমান্ডার কবির আহমেদ মোড়েলগঞ্জ থানা আক্রমণ করে দখল করতে ব্যর্থ হন। পরে সাব-সেক্টর কমান্ডার জিয়াউদ্দিন মোড়েলগঞ্জ আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। মুক্তিযোদ্ধারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে মোড়েলগঞ্জ থানা, রাজাকারদের ঘাঁটি, হাইস্কুল ও কুঠিবাড়ির রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। পাক সেনারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। জিয়াউদ্দিন গুলিবর্ষণ করলে পাক বাহিনীর গান বোট ফিরে যায়। এখানে কিছু রাজাকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, কিছু গ্রেফতার হয়। ওদিকে সুবেদার লতিফ গ্রুপ ভান্ডারিয়া থানা দখলে নেয়। কাউখালী থানা দখলে নেতৃত্ব দেন হাবিলদার হাবিবুর রহমান। থানা দখলের পর পাক বাহিনী ভান্ডারিয়া ও কাউখালী বন্দর পুড়িয়ে দেয়। সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তুষখালী খাদ্য গুদাম দখল করে মুক্তিবাহিনী। সেখানে ছিল ৬ হাজার মণ খাদ্য।

সুন্দরবন সাব-সেক্টরে ৩৪ জন নেভাল কমান্ডো দেয়া হয়। কমান্ডোদের নির্দেশ দেয়া হয়, বাংলাদেশ বেতার থেকে একটি নির্দিষ্ট গান বাজলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মংলা ও হিরণ পয়েন্টে হামলা চালতে হবে। নেভাল কমান্ডোরা ১৩টি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে দেন। রণকৌশলের দিক দিয়ে ১৩টি জাহাজ ধ্বংস পাকিস্তানের নৌশক্তিকে দমিয়ে দেয়। শরণখোলার ফরেস্ট অফিসের মাত্র ৩ মাইল ভেতরে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার। এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল ১১শ’র বেশি। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১০ হজার। একদিনে সাড়ে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হয়। ভোলা নদীর উত্তর পাড়ে জনবসতি এবং দক্ষিণ পাড়ে গভীর সুন্দরবন-বগী, তাফালবাড়ী, মাছুয়া, তুষখালী, চরদুয়ানী, সুপতি প্রভৃতি। বলেশ্বর নদীর দুই পাড়ে ছোট বন্দর। পিরোজপুরে পাকবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ। পিরোজপুর আক্রমণের জন্য তখন দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝে মঠবাড়িয়া থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। অভিযানে ছিলেন ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা। নদী অতিক্রমের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গানবোট আক্রমণ করে।

এদিকে মুক্তিবাহিনীর একের পর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। তুষখালীসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তানি মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে সুন্দরবন আক্রমণ করে পাক বাহিনী। ঘাতক নাদের পারভেজ পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরের আটঘর-কুড়িয়ানার গণহত্যার জল্লাদ। ৪০টি লঞ্চ নিয়ে বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালীর পাক বাহিনীর সদস্যরা এই আক্রমণে অংশ নেয়। পাক হায়েনাদের এই আক্রমণে ভীত হয়নি জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর দল। এক পর্যায়ে সুন্দরবনে গুরু-শিষ্যের যুদ্ধ শুরু হয়। নাদের পারভেজ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে জিয়াউদ্দিনের ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। এই যুদ্ধে পাক বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনী একত্রিত হয়ে বড় মাছুয়া, চরদোয়ানি, সুপতি, তাফালবাড়ী, বগী, শরণখোলা, জিউধরাসহ বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ করে। জলে, স্থলে, আকাশে চলে পাক বাহিনীর আক্রমণ। আক্রমণ হয় লোকালয়, বনজঙ্গল এমনকি ফরেস্ট অফিস। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা একটু দূরে ঘন বনে লুকিয়ে থাকে। পাকসেনারা বগী এলাকায় অবস্থানকালে তাদের গানবোট এলএমজি দিয়ে ধ্বংস করে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। বলেশ্বর ও ভোলা নদীতে পাক বাহিনী অবস্থানকালে তাদের ওপর আক্রমণ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকবাহিনী শরণখোলা, বগী, তাফালবাড়ী আক্রমণে ব্যর্থ হয়। সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে হামলা চালালেও তাদের মূল ঘাঁটিতে বোমা ফেলতে পারেনি পাকসেনারা। ওই সময় ১২দিন যুদ্ধের পর পাকবাহিনী বলেশ্বর ও ভোলা নদী দিয়ে পালিয়ে যায়। আর তখন সুন্দরবনে উড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। এসময় সুন্দরবনের বনজীবী হিসাবে পরিচিত বাওয়ালী ও জেলেরা দুটো পতাকা সঙ্গে রাখতো। সুন্দরবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়াতো আর সুন্দরবনের বাইরে এলে উড়াতো পাকিস্তানি পতাকা। এই ঘটনার আরও পরের দিকে ১৬ আগস্ট নৌ কমান্ডো বাহিনী ১৩টি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করে।

পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় নাম জাহাঙ্গীর বাহাদুর। তিনি ছিলেন স্বরূপকাঠি ও নাজিরপুরের কমান্ডার। ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি। তার বাবা সোহাগদলের নূর মোহাম্মদ। ভাই আলমগীর বাহাদুরকে নিয়ে শুরু করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। কিন্তু আলমগীর ১২ মে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাকে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে ছোট ভাই জহিরুল ইসলাম ২৭ মার্চ ঢাকায় নিহত হন। দুই ভাই হত্যার প্রতিশোধের আগুন জ্বলে জাহাঙ্গীর বাহাদুরের বুকে। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তিনি লেখালেখিও করতেন। জাহাঙ্গীর বাহাদুর এবং এনামুল হকের সম্পাদনায় নাজিরপুর থানার মনোহরপুর থেকে ‘আমার বাংলা’ নামে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পহেলা আগস্ট প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম সংখ্যা। একুশ সংখ্যা প্রকাশের পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। মুক্ত অঞ্চলে ‘আমার বাংলাদেশ’ পত্রিকাটি ছিল প্রথম সারির। ডা. মুজাহার উদ্দীন এমপিএ এর শাহ প্রিন্টিং থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। যুদ্ধকালে প্রেস নিয়ে আসা হয় নাজিরপুর। যুদ্ধ চালিয়ে যান জাহাঙ্গীর বাহাদুর। তিনি স্বরূপকাঠি ও নাজিরপুর থানা আক্রমণ করে অস্ত্র কেড়ে নেন। পাক বাহিনী জাহাঙ্গীর বাহাদুরকে ঘায়েল করতে পারেনি। তবে স্বাধীনতার পর একদল কুচক্রী মহল তাকে হত্যা করে। তার মৃত্যুর খবর শুনে প্রাণ হারান তার স্ত্রী। অন্যদিকে তার আরেক ভাই আবদুল খালেককেও হত্যা করা হয়।    

পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঘটনা কাউখালীর কেউন্দিয়ার যুদ্ধ। সেখানকার হাবিববুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বরিশাল পতনের পর তিনি একটি রাইফেল নিয়ে দল গঠন করেন। তার নেতৃত্বে গ্রামের অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৯ আগস্ট থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে নেন হাবিবুর রহমান। এই দলটি শাহজাহান ওমরের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বানারিপাড়া থানা আক্রমণ করে। কাউখালীর কেউন্দিয়ায় ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। ঝালকাঠি ও কাউখালীর ১৮০জন পাকসেনা ২২ সেপ্টেম্বর কেউন্দিয়া আক্রমণ করে। পাক বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ শুনে আবদুল হাই পনা ১৮জন এবং হাবিববুর রহমান ৪২জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একইদিন গেরিল পদ্ধতিতে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে ১৭ পাকসেনাসহ নিহত হন ৩০ জন। ৯ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান ও তার দল কাউখালী থানা মুক্ত করে। তৎকালীন শর্ষিনার পীর শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ পাকিস্তান সমর্থন করতেন। ফলে শর্ষিনা ছিল পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। সেখান থেকে বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ চালাতো পাক বাহিনী। পাক বাহিনীর সেই ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে ২৫ নভেম্বর। নেতৃত্ব দেন মতি কাজী। দুদিন ধরে চলে সে যুদ্ধ।  

অবশেষে পিরোজপুর জেলা মুক্ত হয় ’৭১-এর ৭ ডিসেম্বর। শরণখোলা ও মঠবাড়িয়া পতনের পর পাক বাহিনী সুন্দরবন হয়ে পালাবার চেষ্টা করে। তাদের প্রতিরোধ করে মুক্তিবাহিনী। প্রতিরোধের মুখে তারা হুলাহাট হয়ে বরিশাল চলে যায়। পিরোজপুর থেকে খবর আসে, ৬ ডিসেম্বর রাতেই পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গেছে পাক বাহিনীর সদস্যরা। এরপর আসে ৭ ডিসেম্বরের সেই নতুন সকাল। যেদিন মুক্ত হয় স্বাধীন পিরোজপুর। বছর ঘুরে সেই উত্তাল মার্চ এলে এই জলাবাসীর মনে পড়ে মুক্তি সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করা হয় শহীদদের। শহীদ পরিবারের সদস্যরা হন সম্মানিত। এভাবেই কেটে যায় যুগের পর যুগ।       

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, পিরোজপুর
২. বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জু
৪. বরিশাল পিডিয়া





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়