ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রাক্তন সৈনিকদের রক্তশপথ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:৪৬, ২২ মার্চ ২০২১
প্রাক্তন সৈনিকদের রক্তশপথ

একাত্তরে রাজধানীতে আউটার স্টেডিয়ামে প্রাক্তন সৈনিকদের এসেমব্লি (ছবি:সংগ্রহ)

একাত্তরের ২২ মার্চ ছিল সোমবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিন। আজো স্বাধিকারের দাবিতে বিক্ষুব্ধ মানুষের সভা, শোভাযাত্রা এবং গগনবিদারী স্লোগানে রাজধানীর আকাশ-বাতাস ছিল মুখরিত।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য মিছিলে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা প্লাবিত।  রাজপথজুড়ে যেন মানুষের বান ডাকে। এ রকম বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্যে সকাল সাড়ে ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। এ সময় প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে চলছিলো বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে সংগ্রামী জনতার ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি এবং ভুট্টোবিরোধী বিক্ষোভ।

প্রায় ৭৫ মিনিটব্যাপী আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অথচ বিষণ্ণ অবয়বে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মি. ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, ৪টি শর্ত পূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।’

আসলে আজকের আলোচনায় ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার আচরণে জনমনে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং ভুট্টো আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। অর্থাৎ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।

আজ পত্রিকায় প্রেরিত এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।’

বাংলাদেশের সকল দৈনিক পত্রিকার জন্য প্রেরিত এ বাণীটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তি।’ সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীটিতে ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক আসন্ন গণহত্যার চক্রান্ত প্রতিহত করার এবং প্রস্তুতি গ্রহণের সতর্ক সঙ্কেত।

এদিকে সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, ‘পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।’

পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে এ রকম কোন দিন তারিখ উল্লেখ না করেই বিবৃতিটি প্রদান করা হয়।  অর্থাৎ, ২৫ মার্চ তারিখেই গণহত্যার নীল নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেজন্য লোক দেখানো একটি বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পাকাপোক্ত করা হলো।

বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের এক সম্মিলিত সমাবেশে বাংলাদেশের সকল অবসরপাপ্ত সৈনিকদের নিজ নিজ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

মেজর জেনারেল (অব) এমআই মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশটি পরিচালনা করেন কর্নেল (অব) এমএজি ওসমানী, এমএনএ। সমাবেশে দেশের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত সকলে শপথ গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সৈনিক এবং অফিসারদের কর্মস্থল ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। 

সমাবেশ শেষে প্রাক্তন সামরিক অফিসার ও সৈনিকগণ মিছিল সহকারে প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান। সেখানে কর্নেল ওসমানী এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উপস্থিত সকলকে রক্তশপথ অঙ্গীকারনামা পাঠ করান। এরপর মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ির সদর দরজায় এসে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান। মেজর জেনারেল (অব) এমআই মজিদ, কর্নেল (অব) ওসমানীসহ মোট ৪ জন বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি কক্ষে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে কর্নেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হাতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে একটি তরবারি তুলে দেন।

আলোচনা চলাকালে একপর্যায়ে ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’

ওসমানী পুনরায় প্রশ্ন রাখেন, ‘কালতো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না?’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু করতে পারে। তার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না।’

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত বিষয়:

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়