ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মহালয়া, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং উত্তম কুমারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা 

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ৪ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৫:২৩, ৪ অক্টোবর ২০২১
মহালয়া, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং উত্তম কুমারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা 

বামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ডানে ‘মহালয়া’ সিনেমার পোস্টার

মহালয়ার সকাল মানে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে রেডিওর সামনে ঢুলুঢুলু চোখে বসা। রেডিওতে শঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু হয় আগমনী সংগীত। তারপর বেশ খড়খড়ে এবং বয়স্ক একটি গলায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' পাঠ: 
হে ভগবতী মহামায়া, তুমি ত্রিগুণাত্মিকা; তুমি রজোগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগ্দেবী, সত্ত্বগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, তমোগুণে শিবের বণিতা পার্বতী, আবার ত্রিগুণাতীত তুরীয়াবস্থায় তুমি অনির্বচনীয়া, অপারমহিমময়ী, পরব্রহ্মমহিষী; দেবী ঋষি কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নী, তিনি কন্যাকুমারী আখ্যাতা দুর্গি, তিনিই আদিশক্তি আগমপ্রসিদ্ধমূর্তিধারী দুর্গা, তিনি দাক্ষায়ণী সতী; দেবী দুর্গা নিজ দেহ সম্ভূত তেজোপ্রভাবে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা।

স্তোত্রপাঠের আবহতেই শুরু হয় সংগীত: 
জাগো মা, জাগো মা
জাগো দূর্গা, জাগো মা…
দ্বিজেন মুখার্জির গলায়।

একেবারেই মুখস্থ পরম্পরা। আমাদের কাছে মহালয়া ছিল আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান শোনা মানে ‘মহালয়ার পূজা’ করা। মাঝে মাঝে মিস হয়ে যেত। মনে হতো সেবারের পূজাটা অসম্পূর্ণতা দিয়ে শুরু হলো। এই মহালয়া শোনার জন্য আশির দশকের প্রথম ভাগে বাবা একটি ন্যাশনাল রেডিও কিনেছিলেন। সেই দশাসই রেডিও কালেভদ্রে ব্যবহার হতো। তার বিরল ব্যবহারের একটি দিন ছিল এই মহালয়া। কিছুটা কর্কশ গলায় বেশ দাপটের সঙ্গে চণ্ডীপাঠ হতো। তার ভেতর সুর ছন্দ লয়ের এক অদ্ভুত মিশেল! শরতের সকাল সেই স্তোত্রপাঠে যেন নির্মল হয়ে উঠত। অনেক পরে জেনেছি সেই স্তোত্র পাঠকের নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। যাঁর বাচিক গুণে আকাশবাণী রেডিওর মহালয়ার অনুষ্ঠান কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।

অথচ কর্কশ গলার জন্য প্রথমবার রেডিওর অডিশনে টেকেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। অবশ্য এতে তাঁর কিছু করার ছিল না। ছোটবেলায় ডিপথেরিয়ায় স্বর ভেঙে গিয়েছিল চিরকালের মতো। স্বাভাবিকভাবেই এই কণ্ঠ নিয়ে তাঁর আফসোসের অন্ত ছিল না। কিন্তু শেষমেশ এই কণ্ঠই শাপে বর হলো। বেতার নাটকে ‘রাক্ষস’ চরিত্রের জন্য একটা ভিন্ন ধরনের কণ্ঠের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সে সুযোগে তাঁর বেতার-প্রবেশ। তারপর দুটো নাটকে তিনি ভূতের কণ্ঠ দেন। এই ‘ভূতের কণ্ঠ’-ই শেষমেশ দেবীবন্দনার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

১৯০৫ সালে উত্তর কলকাতার আহিরীটোলাতে তাঁর জন্ম। বাবা কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন নিম্ন আদালতের দোভাষী। জানতেন ১৪টি ভাষা। সে সূত্রে বাড়িতে বহুভাষার চর্চা ছিল। ঠাকুরমা যোগমায়া তাঁকে সংস্কৃতের পাঠ দিতেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে চণ্ডীপাঠ করে তিনি সবাইকে চমকে দেন। ঠাকুরমা’র মুখেই ছোটবেলায় শেক্সপিয়ার আর গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকের পাঠ শুনতেন। সেই থেকে নাটকের প্রতি টান। আর ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। মাত্র দুদিনে ৪০ পৃষ্ঠার বীরাঙ্গনা কাব্য মুখস্থ করে স্কুলের শিক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন। কিন্তু গণিতের প্রতি ছিল আজন্মের ভীতি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে গণিতের সব বই খাতা নাকি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দপ্তরে যোগ দেন। কিন্তু কলেজ জীবন থেকে তিনি নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মন পড়ে থাকত মঞ্চে। অফিসের ফাঁকে ফাঁকে ছুটে যেতেন ডালহৌসির এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে বোম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির অফিসে। অল্প কিছুদিন রেলওয়েতে কাজ করে পাকাপাকিভাবে যোগ দেন রেডিওতে। সহকারী পরিচালক হিসেবে। 

১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথমবার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে ১৯৩১ সালে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে প্রথমবার শোনা গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠান, যেখানে বাণীকুমার শ্রীশ্রী চণ্ডীর কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয় সেটি। তখনই সকলে ভাবেন, ষষ্ঠীর সকালে এমন একটি অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ নাট্য রচনাশৈলী অনুসরণে নতুন ভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করলেন বাণীকুমার। কয়েকটি গানে সুরযোজনা করেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র ও রাইচাঁদ আর অধিকাংশ গানে পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থণা ও শ্লোক আবৃত্তিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। 

প্রথম দিকে টেক রেকর্ডিং করার সুযোগ ছিল না। বেতারের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। যারা মহিষাসুরমর্দিনীতে অংশ নিতেন তারা আগের দিন রাতেই রেডিও অফিসে চলে আসতেন। চলত মহড়া। আর ভোরের প্রস্তুতি। ভোরে অনুষ্ঠান শুরুর আগে স্নান করে গরদের ধূতি আর পাঞ্জাবি পরে চণ্ডীপাঠে বসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। প্রথম দিকে তিনি সুর ছাড়াই স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতেই পাঠ করতেন। একদিন স্টুডিয়োতে অনেকটা দুষ্টুমির ছলে সুর ধরে চণ্ডীপাঠ করছিলেন। বাণীকুমার সেটাই লুফে নিলেন। বললেন, এবার থেকে এভাবেই পাঠ করবে। সেই থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নিজস্ব একটি ঘরানা দাঁড়িয়ে যায়।

তাই বলে তাঁর যে খুব একটা ধর্ম-কর্মে মতি ছিল তা কিন্তু নয়। তাঁর কন্যা সুজাতাদেবীর কথায়, ‘বাবাকে কখনও ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের দিন বিয়ের জোড়টা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।’

উত্তম কুমারকেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে হার মানতে হয়েছিল

একবার কিংবদন্তি গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায় না-বলে-কয়ে বীরেনবাবুকে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি শীতলা মন্দির উদ্বোধন করাতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ খানিক অপ্রস্তুত, কিন্তু আয়োজকেরা তাঁর বক্তব্য শুনতে চান। তবে কথা বলাই যাঁর কাজ, তাঁকে কি আর আলাদা করে প্রস্তুতি নিতে হয়! পুরো আসরে একটু গুম মেরে ছিলেন, কিন্তু মাইক্রো ফোনে বলে দিলেন: ‘‘এমন এক মায়ের মন্দির উদ্বোধন করতে এসেছি, যাঁর কাছে দয়া চাইলেই বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে মশারি খাটিয়ে, সর্বাঙ্গে গুটি বেরিয়ে যাবে। মায়ের দয়ায় এক মাস কাত।’

তাঁর কাছে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির আবেদন ছিল ভিন্ন। তিনি বলতেন, ‘আমি কায়েতের ছেলে হয়ে মাতৃবন্দনার সুযোগ পেয়েছি। আর ওই অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজায় খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী এঁরা। এর থেকে সম্প্রীতির পূজার্চনা আর কী হতে পারে’!

১৯৭৬ সাল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বয়সের ভারে ন্যূজ্ব। গলায় সে জোর নেই। তাই নতুন করে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান করতে পারছেন না। মহানায়ক উত্তম কুমার তখন খ্যাতির মধ্যগগণে। চেষ্টা করা হলো তাঁকে দিয়ে স্তোত্রপাঠ করিয়ে আকাশবাণীর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার। ‘দুর্গা দুর্গতিহারিনী’ নামের একটি অনুষ্ঠান করা হলো। সে বারের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাতি সায়ন ভদ্র বলেন, ‘সেবছর, মহালয়ার রাতে উত্তমকুমার হাতিবাগানের বাড়িতে দাদুর কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে অনুমতি নিয়ে যান। দাদু এক সেকেন্ডের জন্যও দ্বিমত করেন নি। কিন্তু আঘাত পেয়েছিলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে। নায়কের চাহিদা তখন তুঙ্গে, অল ইন্ডিয়া রেডিও কর্তৃপক্ষ ভাবলেন এতে রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়বে। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কিছুই জানান নি দাদুকে। আমরা কানাঘুষা শুনে জানতে পারি, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর বাজবে না। নতুনভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর বারবার ফোন আসতে থাকে ভদ্র পরিবারের কাছে। সবার প্রশ্ন ছিল, কেন অনুমতি দিলেন? দাদু একটাই কথা বলেন, সবাইকে জায়গা করে দেওয়া উচিত। একটা সময়ের পর ফোনের রিসিভার পাশে নামিয়ে রাখা হয়’।

মহানায়কের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। আর দ্বিতীয়বার সে চেষ্টা করেননি তিনি। এমনই অবস্থানে পৌঁছেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। রেডিওতে প্রথম বাংলায় ধারাবিবরণী সম্প্রচারও শুরু করেন তিনি। ৭ আগস্ট ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর তাঁর শেষযাত্রা ও শবদাহের বিবরণ প্রচার করে আকাশবাণী। এর ভাষ্যকার ও ব্যবস্থাপক ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তারপর একে একে ডা. বিধানচন্দ্র রায়, হেমন্ত বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তমকুমারের অন্তিমযাত্রার ধারাভাষ্য দেন দিনি। বেতারের আদিযুগে তাঁরই উদ্যোগে শারদ পূজান্তে গঙ্গার ঘাট থেকে দুর্গাপ্রতিমার নিরঞ্জনের ধারাবিবরণী প্রচার করা হতো।  

ব্ল্যাকআউট, উনপঞ্চাশ নম্বর মেসসহ একাধিক নাটক রচনা করেন। বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসটি তিনি মঞ্চায়িত করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণ গোলক গল্পটিকে তিনি নাট্যায়িত করেন। ‘নিষিদ্ধ ফল’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন তিনি। ‘বিরূপাক্ষের নিদারুণ অভিজ্ঞতা’ নামে তার একটি রস-রচনার গ্রন্থ আছে।

পুরো একটা জীবন আকাশবাণীকে উৎসর্গ করে দিয়ে শেষ জীবনে বড়ো কষ্টে কেটেছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। বেতারের স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে আকাশবাণী ছাড়তে হয়েছিল। পেটের দায়ে রবীন্দ্র-ভারতীতে বেতার-নাটকের উপর প্রশিক্ষণ দিতেন। শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে কলকাতা ও অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান করতেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন, এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন! 

এতো বড়ো এক বাচিক শিল্পী ১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃতে বিদায় নেন। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কম কাজ হচ্ছে না। এই ঘটনার উপর ২০১৯ সালে চিত্রপরিচালক সৌমিক সেন ‘মহালয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে রূপদান করেন শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়। অন্যদিকে উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন যীশু সেনগুপ্ত।

২০০৬ সালের মহালয়ার দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্যা সুজাতা ভদ্র সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেডের তরফ থেকে তাঁর পিতার এই মহান কীর্তির রয়্যালটি স্বরূপ ৫০,৯১৭ টাকার একটি চেক পান।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ডেইলি হান্ট, আজতক, সববাংলায়, উইকিপিডিয়া
 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়