ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আহত পায়েলকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৫:২৫, ৩১ অক্টোবর ২০২০
‘আহত পায়েলকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়’

সাইদুর রহমান পায়েল (ফাইল ফটো)

বন্ধুদের সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ঢাকায় ফিরছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েল। পথে প্রস্রাব করতে বাসের স্টাফদের বলে গাড়ি থেকে নামেন।  পরে বাসে উঠতে গিয়ে গেটের সঙ্গে আঘাত লেগে আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। বাসের স্টাফরা পায়েলকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা না করিয়ে নদীতে ফেলে দেন। পায়েল হত্যা মামলার চার্জশিটে এমনটাই উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর মামলায় হানিফ পরিবহনের ৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গজারিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক মামুন আল রশিদ। 

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, পায়েল, তার বন্ধু হাকিমুর রহমান আদর, মহিউদ্দিন শান্তর সঙ্গে  ২০১৮ সালের ২১ জুলাই রাত ১০ টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। পায়েল ও আদর বাসে এক সঙ্গে এবং শান্ত আলাদা সিটে বসেছিলেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে বাসটি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ভাটেরচর ব্রিজের কাছে গেলে পায়েল প্রস্রাবের জন্য বাস থেকে নামেন।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, রাস্তায় তখন হালকা জ্যাম ছিল।  জ্যাম ছাড়লে ড্রাইভার জামাল হোসেন বাসটি চালিয়ে ভাটেরচর ব্রিজের ওপর ওঠায়।  পায়েল বাস মিস করার ভয়ে প্রস্রাব শেষ করে বাস ধরার জন্য দৌড় দেন। সুপারভাইজার জনি ড্রাইভারকে বাসের গেট খুলে দিতে বলেন। পায়েল বাসের গেটের কাছাকাছি গেলে জামাল বাসের অটো সুইচ দিয়ে গেট খুলে দেন।  তখন বাসের গেট পায়েলের মুখের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।  পায়েল ব্রিজের ওপর পড়ে যান।  ব্রিজের আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পায়েলের মুখ ও নাকে জখম হয়।  এতে সে অজ্ঞান হয়ে যান।  এ সময় পায়েলের দুই বন্ধু ও বাসের অন্যান্য যাত্রীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। যাত্রীরা কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই উদ্দেশ্যেমূলকভাবে পায়েলকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে না নিয়ে ভাটেরচর ব্রিজ থেকে ফুলদী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

মামুন আল রশিদ বলেন, তদন্তে জানা যায়, পায়েল তখনও জীবিত ছিলেন।  বিষয়টি কোনো যাত্রী অবগত হওয়ার আগেই বাসটি চালিয়ে ঢাকার দিকে চলে আসে। ঢাকার খিলগাঁওয়ে অবস্থানকালে পায়েলের বন্ধু আদর ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং তার পাশের সিটে বসে থাকা পায়েলের ফোনটি তার সিটে দেখতে পান।  পায়েলকে দেখতে না পেয়ে শান্তকে মোবাইলে কল দিয়ে ভিকটিমের কথা জিজ্ঞাসা করেন।  তখন শান্ত বলেন, পায়েল তার কাছে গিয়ে বসে নাই।  তারপর তারা দুজন মিলে পুরো বাসে পায়েলকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে বাসের সুপারভাইজার জনি, ড্রাইভার জামাল হোসেনকে পায়েলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।  তখন জনি জানান, পায়েল প্রস্রাবের কথা বলে বন্দর থানার  মদনপুরের ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে বাস থেকে রাস্তায় নেমেছিল।  কিন্তু প্রস্রাব শেষে তাকে বাসে ওঠার কথা বললেও সে আর বাসে ওঠে নাই। পায়েল তাদের জানান, সে পরের গাড়িতে করে ওঠে চলে আসবে।  একপর্যায়ে আসামিদের সঙ্গে আদর ও শান্তর পায়েলের বিষয় নিয়ে তর্ক হয়।

চার্জশিটে বলা হয়, বাসটি কুড়িল বিশ্বরোড পৌঁছালে পায়েলের মোবাইল নিয়ে তারা নেমে যান। কিছুক্ষণ পরেই পায়েলের মা ফোন দেন।  আদর ফোনটি রিসিভ করে এবং বিস্তারিত বিষয় পায়েলের মাকে জানান। পায়েলের মা বিষয়টি আত্মীয়-স্বজনদের জানান।  তারা হানিফ পরিবহনের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জনি, জামাল হোসেন ও ফয়সালের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।  জনি এবং পায়েলের বন্ধুদের নিয়ে ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে তাকে খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু সুপারভাইজার জনি একেক সময় একেক রকম কথা বলায় পায়েলের মামা বন্দর থানায় মামলা করেন।  পরে ২৩ জুলাই সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে গজারিয়া থানার ভাটেরচর সাকিনস্থ ব্রিজের নিচে ফুলদী নদীতে গলিত ও পচন অবস্থায় পায়েলের মৃতদেহ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। পায়েলের প্যান্টের পকেটে থাকা লন্ড্রির স্লিপে পায়েলের মোবাইলে ফোন দিয়ে পরিবারকে সংবাদ দেয় পুলিশ। পরে তারা এসে পায়েলের মৃতদেহ ও পরিচয় শনাক্ত করে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২১ জুলাই রাতে দুই বন্ধুর সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী মো. সাইদুর রহমান পায়েল। নিখোঁজের এক দিন পর ২২ জুলাই মুন্সীগঞ্জের ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করে গজারিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই পায়েলের মামা গোলাম সোহরাওয়ার্দী বিপ্লব মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর হানিফ পরিবহনের ওই বাসের সুপারভাইজার জনিকে ঢাকার মতিঝিল এবং চালক জামাল হোসেন ও তার সহকারী ফয়সাল হোসেনকে আরামবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামিরা জানায়, গজারিয়া এলাকায় গাড়ি যানজটে পড়ায় প্রস্রাব করার কথা বলে বাস থেকে নেমেছিলেন পায়েল। বাস চলতে শুরু করলে তিন দৌড়ে এসে ওঠার সময় দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে জ্ঞান হারান। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বদলে মুখ থেঁতলে দিয়ে ভাটেরচর সেতু থেকে নিচের খালে ফেলে দেন এবং বাস নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আসামিরা।

মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গজারিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক মামুন আল রশিদ। এরপর মুন্সীগঞ্জের আদালত থেকে মামলাটি চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মোহাম্মদ আবদুল হালিম তিন আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বিচার শুরু করেন। পরবর্তীতে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। 

গত ৪ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ১ নভেম্বর ধার্য করেন। মামলার তিন আসামি চালক মো. জামাল হোসেন, সুপাভাইজার মো. জনি ও হেলপার ফয়সাল হোসেন জামিনে ছিলেন। ওই দিন জামিন বাতিল করে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আরও পড়ুন: মা ভাবেন, এই বুঝি ফিরে এলো পায়েল

মামুন/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়