স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান
তানজিনা ইভা || রাইজিংবিডি.কম
হাসান হাফিজুর রহমান
তানজিনা ইভা : হাসান হাফিজুর রহমান আমাদের সংস্কৃতির একজন অসাধারণ কৃতীপুরুষ । কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, রাজনৈতিক কলাম, সমালোচনা- সবকিছুতেই আছে তার অসামান্যতার স্বাক্ষর।
তিনি একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, অধ্যাপক, কথাশিল্পী, সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠক, সাংবাদিক, সমালোচক, সফল সম্পাদক। মৃত্যুর পূর্বে ১৫ খণ্ডের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র সম্পাদনা করে সর্বোচ্চ মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। প্রথম ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের প্রকাশক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
আজ প্রতিভাবান এই কৃতীপুরুষের ৮৩তম জন্মদিন। ১৯৩২ সালের আজকের এই দিনে জামালপুর জেলায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একই জেলার ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে তার বাবার বাড়ি।
হাসান হাফিজুর রহমানের শিক্ষাজীবনের প্রায় সবটুকুই কাটে ঢাকায়। ১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশোনা করেন তিনি।
১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন এবং এ বছরই ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্সে বিএ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন এবং ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম পর্ব এমএতে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে এমএ দুই পর্ব একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন তিনি।
বৈচিত্র্যময় ছিল হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি একাধারে সওগাত (১৯৫৩), ইত্তেহাদ (১৯৫৫-৫৪) ও দৈনিক পাকিস্তান (১৯৬৫)-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত হন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭-৬৪ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৭৩ সালে মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তার সাহিত্যজীবনও বর্ণাঢ্য। ১৯৪৬ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘অশ্রুভেজা পথ চলাতে’। তখন তিনি স্কুলছাত্র। এর দুই বছর পর সোনার বাংলায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন। একুশের চেতনার ওপর ভিত্তি করে তার কবিতা ‘অমর একুশে’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেই। ১৯৫০ সালে পূর্বাশায় তার কবিতা ‘যে কোনো সর্বহারার প্রার্থনা’ ছাপা হলে একজন তরুণ কবি রাতারাতি আলোচিত হয়ে ওঠেন সাহিত্যাঙ্গনে। এরপর বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায় ‘কোনো একজনের মৃত্যুর মুহূর্তে’ খুব সম্মান সহকারে ছাপা হয়। ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী এবং আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত বিভাগোত্তরকালের প্রথম আধুনিক কবিতা সংকলনেও এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার ভেতরে বাঘ কবিতার বই ।
তার দাঙ্গাবিরোধী অনবদ্য গল্প ‘আরো দুটি মৃত্যু’ ১৯৫০ সালে প্রথমে অগত্যায় এবং পরে দিলরুবা পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় (১৩৫৮ বাংলা সন) প্রকাশিত হয় তার ছোটগল্প ‘অস্বস্তি’। ‘জরিমানা’ গল্প মুদ্রিত হয় সওগাত-এর পৌষ ১৩৫৯ সংখ্যায়। ১৯৬৩ সালে বিমুখ প্রান্তর, ১৯৬৮ সালে আর্ত শব্দাবলী ও অন্তিম শরের মত, ১৯৭২ সালে যখন উদ্যত সঙ্গীন, ১৯৭৬ সালে বজ্রচেরা আঁধার আমার, ১৯৮২ সালে শোকার্ত তরবারি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
এ ছাড়া ১৯৬৫ সালে সমালোচনা গ্রন্থ আধুনিক কবি ও কবিতা, ১৯৭০ সালে সাহিত্য প্রসঙ্গ ও মূল্যবোধের জন্য, ১৯৭৭ সালে আলোকিত গহ্বর ও ১৯৭৫ সালে দক্ষিণের জানালা (প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই), ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি নামক তার সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার বহু রচনা ইংরেজি, উর্দু, ও রুশসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি।
সাহিত্য অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে লেখক সংঘ পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে আদমজী পুরস্কার, ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে সূফী মোতাহার হোসেন স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, সওগাত সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।
তিনি ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল হাসপাতালে মারা যান। ৫ এপ্রিল তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন হাসান হাফিজুর রহমান।
তিনি আজও অমর হয়ে আছেন তার সৃষ্টিকর্মের জন্য। জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৫/ইভা/শাহ মতিন টিপু/এএন
রাইজিংবিডি.কম