তারেক রহমান: প্রত্যাবর্তনে রাজনীতির নতুন হিসাব
মো: জসিম উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে আলোচিত হয়। তারেক রহমান তেমনই একটি নাম। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান, আইনি বাস্তবতা, রাজনৈতিক অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন একধরনের দূরবর্তী কেন্দ্র, যাকে ঘিরে দলীয় রাজনীতি আবর্তিত হলেও সরাসরি দৃশ্যপটে তাঁর উপস্থিতি ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত খবর নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই খবর শুধু একজন রাজনীতিকের দেশে ফেরার সম্ভাবনার বিষয় নয়; বরং এটি বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমীকরণ নতুন করে হিসাব করার একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান দেশে ফিরেছেন। এরপর শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, বাসস্ট্যান্ড ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রে একটাই নাম—তারেক জিয়া। সেদিনের শুরু থেকেই রাজধানীতে এক ধরনের অদৃশ্য উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় সকাল গড়াতেই নেতা-কর্মীদের উপচে পড়া ভিড় সেই উত্তেজনাকে দৃশ্যমান করে তোলে। ব্যানার, স্লোগান ও মুখে মুখে উচ্চারিত নামে স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রত্যাশা ও আবেগের মিশ্রণ। অনেকের চোখে এটি দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান, আবার কারও কাছে এটি রাজনীতির নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত। যে যেভাবেই দেখুক, এটি প্রমাণিত হয়েছে—তারেক জিয়াকে ঘিরে কৌতূহল ও আলোচনার জায়গা এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবলভাবেই উপস্থিত।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিচয় নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই পরিচয় তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে এনেছে, তেমনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রেও রেখেছে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের সময়ে তাঁর প্রভাব, পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ১/১১ পরবর্তী প্রেক্ষাপট, মামলা ও দেশত্যাগ—সব মিলিয়ে তাঁর নামটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবেগ ও বিরোধিতার দুই মেরুতেই সমানভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর প্রত্যাবর্তনের খবর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্য একটি কারণে। বাংলাদেশের রাজনীতি বহুদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, কূটনৈতিক বক্তব্য ও বৈশ্বিক গণমাধ্যমে আগ্রহ বেড়েছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এসব ইস্যুতে বিদেশি দৃষ্টিভঙ্গি এখন আর উপেক্ষণীয় নয়। তারেক রহমানকে ঘিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর তাই কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে বৈশ্বিক আগ্রহের প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচ্য।
প্রত্যাবর্তনের এই আলোচনা বিএনপির ভেতরেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দলটি আন্দোলন, নির্বাচনী কৌশল ও নেতৃত্বের প্রশ্নে এক ধরনের স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও সীমিত রাজনৈতিক সক্রিয়তা, শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো অনেকটাই ভার্চ্যুয়াল হয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের খবর দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ও উদ্দীপনা তৈরি করেছে। অনেকের চোখে এটি দলকে সাংগঠনিকভাবে চাঙা করার সুযোগ, আবার কারও কাছে এটি নতুন চ্যালেঞ্জের সূচনা।
তবে এখানে একটি বাস্তব প্রশ্ন থেকেই যায়—প্রত্যাবর্তন মানেই কি রাজনৈতিক পুনরুত্থান? বাংলাদেশের রাজনীতি ‘আবেগপ্রবণ’ হলেও শেষ পর্যন্ত এটি বাস্তবতার মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারেক রহমানের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা, জনমত এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতা—সব মিলিয়ে বহুমুখি সমীকরণ রয়েছে। সম্প্রতি দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা বেশ কিছু মামলার রায় ও আইনি প্রক্রিয়ার পুনর্বিবেচনা শুরু হয়েছে। এগুলো তাঁর দেশে ফেরার পথকে আগের চেয়ে অনেকটা প্রশস্ত করেছে। শুধু দেশে ফেরা বা প্রকাশ্যে সক্রিয় হওয়া দিয়ে এই সমীকরণ সহজ হবে, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। বরং প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর ভূমিকা কী হবে, দল ও দেশের রাজনীতিতে তিনি কী ধরনের বার্তা দেবেন—এগুলো মূল বিবেচ্য।
ক্ষমতাসীন রাজনীতির দিক থেকেও এই খবর গুরুত্বহীন নয়। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবার পাশাপাশি এক ধরনের ‘নেতিবাচক প্রতীক’ হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কৌশলে নতুন হিসাব যোগ করতে পারে। একদিকে বিরোধী রাজনীতির সংগঠিত হওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে পুরোনো ইস্যু ও বিতর্ক পুনরায় সামনে আনার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ফলে এই প্রত্যাবর্তন কেবল বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক মাঠের শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়ে নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা প্রথাগত রাজনীতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। যারা রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কার চান, তাদের কাছে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে বিএনপির ঘোষিত ‘৩১ দফা’ রূপরেখা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির ওপর। কেবল রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নয়, বরং আধুনিক ও জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করাটাই হবে তাঁর বড় চ্যালেঞ্জ। তাই পুরোনো কৌশল ও ভাষার পুনরাবৃত্তি না করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এই প্রত্যাবর্তন অর্থবহ হবে না।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও সংবেদনশীল। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতি, ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটন ও লন্ডনের মতো পশ্চিমা শক্তিগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেওয়া এবং মানবাধিকার ইস্যুতে বিএনপির সাথে ধারাবাহিক যোগাযোগ তারেক রহমানের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাকে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। তাঁর প্রত্যাবর্তন এ কারণে কেবল একটি অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ভারসাম্যের একটি অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর বার্তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্যের ওপর। তিনি যদি গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির পথে হাঁটার সংকেত দেন, তবে তা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ভিন্ন মাত্রা দিতে পারে; আর যদি পুরোনো সংঘাতের ভাষা ফিরে আসে, তবে উদ্বেগও বাড়বে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘প্রত্যাবর্তনের খবরে রাজনীতির নতুন হিসাব’ কথাটি কেবল একটি শিরোনাম নয়; এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ। এই হিসাবের মধ্যে আছে বিএনপির সাংগঠনিক ভবিষ্যৎ, ক্ষমতাসীন হওয়ার কৌশল, জনমতের অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ। মনে রাখতে হবে, শেষ পর্যন্ত রাজনীতির সাফল্য নির্ধারিত হয় দলীয় লক্ষ্য, নীতি ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
এ কারণেই তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে উত্তেজনা বা আশাবাদের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সংযত বিশ্লেষণ। এটি সুযোগও হতে পারে, আবার চ্যালেঞ্জও। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি সত্যিই একটি নতুন পথে যেতে চায়, তবে এই প্রত্যাবর্তনকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবেগের বাইরে এনে গণতান্ত্রিক সংস্কার, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। নইলে প্রত্যাবর্তনের খবর থাকবে, কিন্তু রাজনীতির হিসাব বদলাবে না।
ঢাকা/তারা//