শহীদ হতে না পারার আফসোস
শিশু বলে অন্য দলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল না করি: শফিকুর রহমান
সমাবেশ বক্তব্য রাখছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান
চব্বিশে জীবন বাজি রেখে যাদের ত্যাগের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন এবং দেশ ও জাতির মুক্তি হয়েছে অহঙ্কার করে তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল না করতে রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে তিনি বলেন, “আবু সাইদরা যদি বুক পেতে না দাঁড়াতো, এ জাতির মুক্তির জন্য যদি বুকে গুলি লুফে না নিতো হয়তো এই বাংলাদেশ আর দেখতাম না। ইতিমধ্যে আরো জীবন হয়তো ফ্যাসিবাদিদের হাতে চলে যেতো।”
শফিকুর রহমান বলেন, “চব্বিশে জীবন বাজি রাখা যুদ্ধ যদি না হতো, তাহলে আজকে যারা বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করছেন, তারা তখন কোথায় থাকতেন। তাই আসুন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই নেয়ামত পেয়েছি, তাদের যেন অবজ্ঞা না করি। অবহেলা না করি। শিশু বলে যেনো তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল না করি। অহঙ্কার করে যাতে অন্য দলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় কথা না বলি। এগুলো যদি আমরা পরিহার করতে না পারি। কিংবা যারা পরিহার করতে পারবেন না তাদের বুঝতে হবে, ফ্যাবিবাদের রুপ তাদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে।”
“আমরা আশা করব, আমরা কেউ এগুলো করব না। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার রক্ষা করে জাতীয় ঐক্যের বীজ এক সাথে রোপন করবে,” বলেন তিনি।
চব্বিশের লড়াইয়ে শহীদ হতে না পারায় আফসোস করে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি অভিজাত শ্রেণির হয়ে কথা বলতে আসিনি। আজীবন সকল রক্তচক্ষুতে উপেক্ষা করেছি। জেল জুলুম পরোয়া করি নাই। আফসোস, ২৪ সালে জাতিকে মুক্তি দিতে গিয়ে যারা জীবন দিয়ে শহীদ হয়ে গেলো আমি তাদের একজন হতে পারলাম না।”
“দোয়া চাই। ইনসাফের ভিত্তিতে একটি দেশ গড়ে তোলার জন্য আগামীতে যে লড়াই হবে সেই লড়াইয়ে আল্লাহ আমাকে একজন শহীদ হিসাবে কবুল করেন, আল্লাহর কাছে এমন প্রার্থনা করেন,” জামায়াত আমির।
শিশু, তরুণ-যুবকদের উদ্দেশ্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “যুবকদের আমরা বলতে চাই, তোমাদের সাথে আমরা আছি। আজ জামায়াতের আমির হিসাবে কথা বলতে আসিনি। আমি এসেছিতো ১৮ কোটি মানুষের একজন হয়ে কথা বলতে এসেছি। আমি শিশুদের বন্ধু, যুবকদের ভাই। বয়স্কদের সহযোদ্ধা। বোনদের ভাই। তাদের মুক্তির জন্য দায়িত্ব নিয়ে এখানে দাঁড়িয়েছিলাম।”
“আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির মুক্তির জন্য আমাদের লড়াই নয়। রাস্তার একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা বাগানের একজন শ্রমিক, রক্ত পানি ঘাম ঝড়ানো রিকশাচালক ভাই। মাঠে ময়দানে মুখে একমুটো ভাত তুলে দিতে চায় সেই কৃষক ভাই। তাদের হয়ে কথা বলতে এসেছি।”
“আল্লাহ যতক্ষণ হায়াত দিয়েছেন ততক্ষণ কথা বলব। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকবে,” বলে ঘোষণা দেন জামায়াত আমির।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
“সব গণহত্যার বিচার দাবি করে শফিকুর রহমান বলেন, “পল্টন গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, সারা দেশের গণহত্যা, পিালখানার গণহত্যা, ২৪ এর গণহত্যা–এই সকল গণহত্যার বিচার বাংলার মাটিতে নিশ্চিত করতে হবে। এদের বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত পুরনো ব্যবস্থাপত্রে এই বাংলাদেশ আর চলবে না।”
তিনি বলেন, “এতগুলো মানুষে এমনি এমনি জীবন দেয়নি। জীবন দিয়েছেন জাতির মুক্তির জন্য।যারা বস্তাপচা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে আবার গড়তে চান তাদেরকে আমরা বলি জুলাইয়ে যুদ্ধ করে যারা জীবন দিয়েছে শক্তি থাকলে তাদের জীবন ফেরত এনে দেন। পারবেন না। কাজেই নতুন ব্যবস্থাপনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।”
“মা, শিশু-কিশোর, যুবক, বোন, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, ব্যবসায়ী সবাইকে যে দেশ যে সংবিধান যে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারবে সেই নতুন বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই,” বলেন জামায়াত আমির।
নতুন প্রজন্মের প্রথম ভোট, দাঁড়িপাল্লার পক্ষে হোক: পরওয়ার
সমাবেশে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, “জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ঘিরে যে জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রমাণ করে বিগত বছরগুলোতে দলটির ওপর, তথা ইসলামি শক্তির ওপর যে জুলুম-নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তারই প্রতিবাদে এই গণবিস্ফোরণ ঘটেছে।”
বৃদ্ধ বয়সে দলটির নেতাদের কারাগারে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে গোলাম পরওয়ার বলেন, “মজলুম বৃদ্ধ নেতাদের কারাগারে তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে। নিবন্ধন ও প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ার, রিমান্ড, আয়নাঘরে হাজার হাজার লোককে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। দুনিয়া জানে—বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে মজলুম দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।”
সংগঠনটির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে মানবিক নেতা উল্লেখ করে তিনি বলেন,“বন্যার্ত মানুষদের সাহায্য করতে তিনি নির্দেশ দিলেন। পূজার সময় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পাশে থেকে নিরাপত্তা দিতে বললেন।”
বাংলাদেশে সুশাসনের একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে নতুন প্রজন্মের প্রথম ভোট দাঁড়িপাল্লায় দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, “আমরা একটি সুশাসনের রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই। নতুন প্রজন্মের প্রথম ভোট, দাঁড়িপাল্লার পক্ষে হোক।”
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে, দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের, গণ-অধিকার পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হক নুর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, নেজামে ইসলামের মহাসচিব মুসা বিন ইযহার, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, শহীদ পরিবারের সদস্য, কয়েকজন পঙ্গু জুলাই যোদ্ধা।
দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ছাড়াও জাতীয় সমাবেশ যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম।
উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, নায়েবে আমির মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা আবদুল হালিম, মোয়াযযম হোসাইন হেলাল ও মাওলানা মুহাম্মাদ শাহজাহান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, আবদুর রব, অধ্যক্ষ মো. শাহাবুদ্দিন, অধ্যক্ষ মো. ইজ্জত উল্লাহ ও মোবারক হোসাইনসহ দেশের জেলা, মহানগর ও উপজেলা নেতারা প্রমুখ।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৭ দফা দাবিতে ডাকা জামায়াতের এই জাতীয় সমাবেশ লাখ লাখ নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে মহাসমাবেশে পরিণত হয়।সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকর্মীর ঢল নামে। দেশের প্রত্যক এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা গাড়ির বহর নিয়ে সমাবেশে যোগ দেয়। সমাবেশকে ঘিরে কেন্দ্রীয় নেতারাও নজরকাড়া মিছিল নিয়ে শোডাউন করেন। দুপুরের মধ্যেই নেতাকর্মীতে ভরে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একপর্যায়ে জায়গা না পেয়ে নেতাকর্মীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয় পল্টন, মৎসভবন, শাহবাগ, কাটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের এলাকাগুলোতে। সমাবেশকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপুর্ণভাবে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ সমাপ্ত হয়।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ